দেশজুড়ে

কোটি কোটি টাকা খুইয়ে বিনিয়োগকারীদের বোবা কান্না

বগুড়া শহরের জলেশ্বরীতলা এলাকার এমদাদ প্রায় ৫০ লাখ খুইয়েছেন অনলাইন অ্যাপ ‘এমটিএফই’ চক্করে পড়ে। তিনিসহ তার পরিবারের আটজন সদস্য এ জালিয়াতি চক্রের সদস্য হয়েছিলেন। প্রথম দিকে ভালো টাকা লাভ পাওয়ায় লোভে পড়ে একটি থেকে পরিবারের প্রতিটি সদস্যদের নামে অ্যাকাউন্ট খোলেন এমদাদ। এখন সব টাকা হারিয়ে পথে বসেছে পরিবারটি।

Advertisement

একই অবস্থা ব্যাংকার হাসান ইমামের। মাত্র দুই মাসে নিজের বিনিয়োগ করা দুই লাখ টাকা তুলে নিয়ে লোভে পড়েন তিনি। এরপর নিজের স্ত্রী, শিশুসন্তানের নাম দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলে ১২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। এখন সব হারিয়ে পাগলপ্রায় হাসান ইমাম।

বগুড়ার শেরপুর উপজেলার বাসিন্দা আকবর আলী। পেশায় একজন ব্যবসায়ী। বন্ধুর কথা শুনে তিনি অনলাইন বিটে বিনিয়োগ করেন। তার কত টাকা বিনিয়োগ রয়েছে সেটি না বললেও তা কোটির কম নয় বলে জানিয়েছেন।

আকবর আলী প্রায় পাঁচ মাসে এ টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে নিয়েছিলেন বাইনান্স ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে। এখান থেকে ১৩ হাজার টাকায় ১০০ ডলার পেয়েছেন। সেই ডলার পরবর্তী সময়ে এমটিএফইয়ের অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করেন। আকবর আলী বলেন, ‘আমি লোভে পড়ে আজ সর্বস্বান্ত। নিজের ব্যবসা বলে আর কিছুই থাকলো না।’

Advertisement

বগুড়ার একটি সুনামধন্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালক এমটিএফইতে বিনিয়োগ করেন কয়েক কোটি টাকা। তার মাধ্যমে এ কার্যক্রমে যুক্ত হন আরও শতাধিক ব্যক্তি। এদের মধ্যে ছাত্র, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও গৃহিণীও রয়েছেন। তারা সবাই আজ নিজের ‘জিরো অ্যাকাউন্ট’ দেখে হায় হায় করছেন। অনেকে নিজেদের নাম-পরিচয়ও প্রকাশ করতে পারছেন না। কারণ এ ব্যবসাটি সরকার অনুমোদিত নয়।

আলিমুল হক তার বন্ধু মনিরের কাছে জানতে পারেন, এমটিএফই নামের একটি বিদেশি সংস্থায় অ্যাকাউন্ট খুলে ২০০ ডলার জমা দিলে ন্যূনতম আয় দিনে পাঁচ ডলার দেওয়া হবে। দেরি না করে শুরু করেন তিনি। প্রথম একমাসে প্রায় ১২০ ডলার ইনকাম হয়। এতে আরও প্রলুব্ধ হন তিনি। ব্যাংক থেকে নিজের জমানো ১৫ লাখ টাকা তোলেন। আরও ২০ লাখ টাকা লোন করেন। জানতে পারেন তার রেফারেন্সে অন্য অ্যাকাউন্ট খোলা হলেই তার ইনকামের ৩ শতাংশ তার অ্যাকাউন্টে যোগ হবে। এমন তথ্যে হাতে চাঁদ পেয়ে যান আলিমুল। তার বাড়ির প্রতিটি সদস্যের নামে, এমনকি তিন বছরের শিশুর নাম দিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলেন রাতারাতি বড়লোক হওয়ার আশায়। এখন সব হারিয়ে পথে বসেছেন তিনি।

জুনে দুই হাজার ডলার করে ১৯টি অ্যাকাউন্ট খোলেন মিজান। এক মাসের মধ্যে নিজের পাঁচ লাখ টাকাসহ আরও চার লাখ টাকা কমিশন পান। তার এ ব্যবসায়িক উন্নতি দেখে বন্ধুরা ২০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন জুলাইয়ের শেষের দিকে। এখন সবার অ্যাকাউন্টই ফাঁকা।

আরও পড়ুন: এমটিএফইর ফাঁদে সর্বস্বান্ত হাজারো মানুষ

Advertisement

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বগুড়া শহরের সেউজগাড়ির একজন সাড়ে তিন কোটি টাকা এবং চারমাথার একজন চার কোটি ৪৬ লাখ টাকা হারিয়ে এখন সর্বস্বান্ত। এরা দুজনই কোম্পানির পক্ষ থেকে ফ্রিতে দুবাই ঘুরে এসে বিনিয়োগ করেছিলেন। তিন লাখ ৭০ হাজার টাকা খুইয়েছেন বগুড়ার মহাস্থান এলাকার ইলেকট্রনিকস ব্যবসায়ী রবিউল আলম। তিনমাস আগে ঢাকায় তার এক ব্যবসায়ী বন্ধুর মাধ্যমে ওই কোম্পানিতে নিবন্ধন করে সদস্য হন। প্রথমদিকে ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে ২০ হাজার টাকা লাভ পান। এভাবে চলার একপর্যায়ে গত ২৩ জুলাই তিন লাখ ৭০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করার পর কোম্পানির সাইট বন্ধ দেখতে পান। তখন তার ঢাকার বন্ধুর ফোনও বন্ধ। বুঝতে পারেন প্রতারিত হয়েছেন। রবিউল বলেন, তার মতো অনেক যুবক, ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীরাও প্রতারণার শিকার হয়েছেন ওই কোম্পানিতে যুক্ত হয়ে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়া জেলা ছাড়াও পাশের জেলা সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ ও জয়পুরহাটসহ উত্তরের বিভিন্ন জেলার এক লাখেরও বেশি মানুষ এ অনলাইন জাতিয়াতির চক্র এমটিএফইয়ের সঙ্গে ব্যবসা করতো। বিগত ছয় মাসে এসব জেলার প্রতিটি উপজেলায় নিজস্ব অফিস খুলে বসেছিলেন তারা। যদিও এসব অফিস নিয়ন্ত্রণ করতেন স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সিও পদধারী একজন। কোম্পানির মূল ব্যক্তিরা দেশের বাইরে থেকে কলকাঠি নেড়েছেন।

ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এমটিএফই দুবাইভিত্তিক কানাডিয়ান কোম্পানি। এদের অ্যাপ এতটা লোভনীয় যে এখানে লোকসানের কোনো অপশন নেই। শুরুর দিকে বিভিন্ন অ্যাপ বানিয়ে অ্যাপগুলোতে বিকাশ অথবা নগদের মাধ্যমে মূল অ্যাকাউন্টে টাকা ঢোকানো শুরু করে। এরপর সাপ্তাহিক একটি অপশন চালু করলেই টাকা জমা শুরু হয়। যার নিচে যত মানুষ (রেফারেন্স) তার তত ইনকাম। ৯ হাজার ডলার জমা হলে সেই ব্যক্তিকে ওই এলাকার সিইও বানানো হয়। তিনি অতিরিক্ত কমিশন পান আরও তিন হাজার ডলার।

একাধিক সদস্য জানান, এফটিএফই দেশের বিভিন্ন স্থানে স্কুলনির্মাণ থেকে শুরু করে রিজিওনাল সিইও নিয়োগ করে স্থায়ী অফিস নেয়। উত্তরবঙ্গের ভেতরেই তাদের আট মাসে ৫০টির অধিক অফিস তৈরি করা হয়। রাতারাতি এ অফিসগুলো এখন বন্ধ।

আবু তাহের নামের একজন জানান, তারা অনেক পরে জানতে পেরেছেন মূলত অর্থনৈতিক মন্দাকবলিত কিছু দেশকে টার্গেট করে এরা মূল ব্যবসার প্ল্যান করেন। তাদের এ ফাঁদে পড়েছে নাইজেরিয়া ও আফ্রিকার কিছু দেশসহ শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারত। যেসব সদস্যের বিনিয়োগ বেশি তাদের দুবাই নিয়ে পাঁচতারকা হোটেলে রেখে নারীসঙ্গসহ বিভিন্ন অফারের ফাঁদে ফেলেন কোম্পানির মালিকরা। অল্প টাকায় ভাড়া করা সাদা চামড়ার মানুষদের স্যুট-টাই পরিয়ে দেখানো হয় কোম্পানির চেয়ারম্যান। সবাই থাকেন দুবাই। আর দুবাই যাওয়ার লোভ পড়ে অনেকেই ফাঁদে পা দেন।

এমটিএফইয়ের মূল হোতা মোবাশ্বের ইবাদ মাসুদ দুবাই থাকেন। তার সম্পর্কে কেউ সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেননি। তবে তিনি বাংলাদেশি এটা নিশ্চিত করেছেন অনেকেই।

বগুড়ার চারমাথা এলাকায় এ সংস্থার অফিস পরিচালনাকারী সিইও পদধারী আবু হানিফ নামের এক ব্যক্তি মোবাইলে বলেন, তার নিজেরও অনেক টাকা খোয়া গেছে। এটা যে একটি প্রতারক প্রতিষ্ঠান তা তিনি আগে বুঝতে পারেননি। এখন অনেক গ্রাহক তাকে টাকার জন্য চাপ দিচ্ছেন। তিনি নিজেও যে এক অসহায় পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন সেটা বোঝাতে পারছেন না।

বগুড়া গোয়েন্দা পুলিশের ইনচার্জ মোস্তাফিজ হাসান বলেন, তাদের কাছে এখনো কেউ লিখিত অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে সাইবার ইউনিটের সহযোগিতায় তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এসআর/এমএস