ভ্রমণ

একদিনের নোয়াখালী ভ্রমণে কী কী দেখবেন?

তানজিদ শুভ্র

Advertisement

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার আগেই বাসা থেকে বের হয়েছিলাম। তবে ঢাকা শহরের যানজট পার হতেই বেশ দেরি হয়ে যায়। আমার জন্য গন্তব্য নোয়াখালী নতুন হলেও আমাদের ৭ জনের টিমের অনেকেই এর আগে এসেছে একই গন্তব্যে। শুরুতে বের হয়েই পড়তে হয়েছিল ভোগান্তিতে।

ভোগান্তি বলতে বৃষ্টি শেষে রাস্তায় জমে থাকা পানি। গাড়িতে উঠে অল্প যেতেই যানজটে বসে বসে সময় দেখি। ধীরে ধীরে গাড়ি এগিয়ে গেল ব্যস্ত শহর ছাড়িয়ে, কমতে শুরু করল নাগরিক কোলাহল আর এদিকে আমাদের নীরবতা ভাঙতে লাগল। গাড়িতে বেজে ওঠা গানের সঙ্গে সঙ্গে গলা মেলাতে শুরু করেছিল অনেকেই।

আরও পড়ুন: ভারতের বিপজ্জনক ৫ পাহাড়ি রাস্তা

Advertisement

আমরা নোয়াখালী পৌঁছাই রাত সোয়া ১টায়। শহরের সদর উপজেলা পরিষদের পাশেই নাইস গেস্ট হাউজে আমাদের জন্য রুম বুক করা ছিল আগে থেকেই। সেখানে পৌঁছে চাবি নিয়ে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়েই ঘুম দেই। যাত্রাপথের ক্লান্তি আর পরদিন খুব সকালে উঠে ঘুরতে বের হওয়া দুটোই ছিল ঘুমাতে যাওয়ার কারণ।

সকাল ৫টা ৪৫ মিনিটে আমাদের কয়েকজনের অ্যালার্ম বাজতে শুরু করে। যার যার মতো উঠে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট না করেই বের হলাম। স্বল্প সময়ে কোথায় কী দেখা যায় এই ভেবে-

চেয়ারম্যান ঘাট

নোয়াখালীর মূল ভূখণ্ডের প্রান্তসীমা এই চেয়ারম্যান ঘাট। উত্তর থেকে দক্ষিণ ক্রমেই প্রশস্ত হয়ে আসা মেঘনার জলরাশি নোয়াখালিতে এসেই আছড়ে পড়ে বঙ্গোপসাগরে। এরপর দৃষ্টির শেষ সীমায় নদী আর সাগর একাকার হয়ে যায়।

Advertisement

আরও পড়ুন: রাঙ্গামাটির বিস্ময়কর এই লেকের পানি রং বদলায় ক্ষণে ক্ষণে

মাইজদী থেকে চেয়ারম্যান-ঘাট আসতে প্রায় ঘণ্টা খানেক সময় লেগে যায়। যাওয়ার পথে রাস্তার দু’ধারে সবুজ বৃক্ষরাজিতে ঘেরা। আমাদের চলার পথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির শুরু, পৌঁছাতে পৌঁছাতে বৃষ্টির মাত্রা বেড়ে যায়। চট্টগ্রামগামী অনেক বাস ওই চেয়ারম্যান ঘাট থেকেই ছেড়ে আসছিল যাওয়ার পথে সামনে পড়েছিল।

বৃষ্টির মধ্যেই আমাদের গাড়ি থামলো ঘাটের একটু আগে। গাড়ি থেকে বের হয়ে দেখলাম ঘাটে প্রবেশের আগে বেশ কয়েকটা গাড়ির জটলা। মানে সামনে আর এগোনোর সুযোগ নেই। দুটো রিকশা নিয়ে পাশেই আরেকটা ঘাট সেখানে গেলাম। বৃষ্টি পড়ছিল তখনো।

রিকশা থেকে নেমে আমরা টং দোকানে দাঁড়ালাম। ওই মুহূর্তে অন্য দর্শনার্থী না থাকলেও স্থানীয় মানুষজন ছিল আরও কিছু মানুষ ছিল নদী পাড় হওয়ার। তারা অপেক্ষা করছিল বৃষ্টি থামার। তবে বৃষ্টি পুরোদমে থামার আগেই তারা স্পিড বোটে করে চলতে শুরু করে। সামনে তাকাতে যতদূর দৃষ্টি গেল ততদূর মেঘনার ঘোলা জল।

আমরা টং দোকান থেকে পাউরুটি খেয়ে বৃষ্টিতে ভিজেই দু চারটা ছবি তুলে চলে আসলাম গাড়ির কাছে। বৃষ্টি না থামায় আমরা আর বিলম্ব না করে এবার ছুটছি নোয়াখালী শহরের দিকে।

আরও পড়ুন: যে দেশে নেই রাস্তা, মধ্যরাতেও আকাশে থাকে সূর্য

নোবিপ্রবি

১০১ একরের নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকজন বন্ধু পড়াশোনা করে। তাদের একজন কাউছার, তার সঙ্গে যোগাযোগ করে চেয়ারম্যান ঘাট থেকে ফেরার পথে আমরা চলে গেলাম নোবিপ্রবি ক্যাম্পাসে।

বন্ধের দিন, তার মধ্যে বৃষ্টি। অনেকটা নিরিবিলি, কোলাহল মুক্ত সকালের পরিবেশ। ক্যাম্পাসের ভেতরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে প্রশাসনিক ভবনের সামনে, শহীদ মিনার আর প্রধান ফটকের সামনে সবাই ছবি তোললাম। এরপর গেস্ট হাউজে ফিরলাম।

গেস্ট হাউজে এসে আমরা সবাই আমাদের ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম। এরপর আমাদের গন্তব্য গান্ধী আশ্রম। তখন আমাদের সহযাত্রী সংখ্যা তিনজন কমে গেলো। বিকালে আমাদের এক সেমিনার থাকায় তারা ব্যস্ত ছিল সেসব গোছানো নিয়ে।

আরও পড়ুন: পাহাড়ি ঝরনায় গিয়ে কেন পথ হারাচ্ছেন পর্যটকরা?

ব্যস্ত থাকার তালিকায় ছিল হক পাবলিকেশন এর রুহুল আমীন ভাই, রাশেদ ভাই আর আক্তার ভাই। তারা কাজে মনোযোগী হলো আর আমরা আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের জন্য।

তখন আমি ও মো. তৌহিদুজ্জামান ভাই, বিডি জবস এর এজিএম (প্রোগ্রামস) মোহাম্মদ আলী ফিরোজ ভাই, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার (এইচআরএম) জুবায়ের হোসেন ভাই।

এদিকে সমস্যা করল গাড়ির চালক। গাড়িতে সমস্যা হয়েছে তা বিলম্বে জানিয়ে আমাদের বেশ সময় নষ্ট করে। এরপর সিএনজি চালিত অটোরিকশা নিয়ে আমরা যাচ্ছিলাম গান্ধী আশ্রমের দিকে।

আরও পড়ুন: ২১ বছরেই ১৯৬ দেশ ভ্রমণ তরুণীর, জানালেন অভিজ্ঞতা

গান্ধী আশ্রম

১৯৪৭ সালের ২৯ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধী এই জয়াগ গ্রামে এসেছিলেন সাম্প্রদায়িক মনোভাব দূর করার উদ্দেশ্যে ঘুরতে ঘুরতে। জানা যায়, ওই সময় নোয়াখালীর প্রথম ব্যারিস্টার হেমন্ত কুমার ঘোষ তার সব সম্পত্তি গান্ধীজির আদর্শ প্রচার ও স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে আম্বিকা কালিগঙ্গা চ্যারিটেবল ট্রাস্ট ও গান্ধী আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৭৫ সালে ট্রাস্টের নাম পরিবর্তন করে ‘গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট’ রাখা হয়। আর ২০০০ সালের অক্টোবরে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে গান্ধী আশ্রমের মূল ভবনে যাত্রা শুরু করে ‘গান্ধী স্মৃতি জাদুঘর’।

মাইজদী কোর্ট থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে সোনামুড়ী উপজেলার জয়াগ বাজারের কাছে অবস্থিত মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক এই নিদর্শন। শাওন নামের যে চালক ওই সময় আমাদের গান্ধী আশ্রমের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল সে আগে নাকি কখনো যায়নি, চিনেও না। এবার ভরসা আমাদের গুগল ম্যাপ। আমরা বেলা ১২টার আগেই পৌঁছাই।

আরও পড়ুন: শাপলার রাজ্য সাতলা গ্রামে ঘুরতে যাবেন কীভাবে, খরচ কত?

তথ্য ছিল রবিবার বন্ধ থাকে। তবে আমরা যখন গেলাম তখন প্রবেশের অনুমতি ছিল না। দায়িত্বরত একজন জানালেন উর্ধ্বতনদের মিটিং হচ্ছে, ভেতরে যাওয়া যাবে না। তার ‘না’ শুনে আমরা হেঁটে হেঁটে গান্ধী মেমোরিয়াল ইন্সটিটিউট আর গান্ধী মেমোরিয়াল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আঙিনায় ঘুরে আসলাম।

বেশ কিছু ছেলেপেলে খেলছিল মাঠের মধ্যে। তারা জানালো ওই স্কুলের শিক্ষার্থী তারা। শেষ অবধি ভেতরে গিয়ে আমাদের পুরনো কোনো নিদর্শন দেখার সুযোগ হয়নি। জেনেছি এ জাদুঘরে গান্ধীর বিভিন্ন দুর্লভ ছবি, বই, ব্যবহার্য জিনিসপত্র সংরক্ষিত আছে।

আর বর্তমানে জাদুঘরে প্রবেশ মূল্য ২০ টাকা। এপ্রিল-সেপ্টেম্বর মাসে সকাল ৯টা থেকে বিকাল সাড়ে ৫টা অবধি আর অক্টোবর-মার্চ মাসে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকাল ৫টা অবধি প্রবেশ করার সুযোগ আছে রবিবার বাদে।

আরও পড়ুন: পাহাড়ি ঝরনায় গিয়ে কেন পথ হারাচ্ছেন পর্যটকরা?

বজরা শাহী মসজিদ

নোয়াখালীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর একটি ৩০০ বছরের পুরনো বজরা শাহী মসজিদ। ১৮শ’ শতাব্দীতে নির্মিত এই মোঘল স্থাপনা দিল্লি শাহী মসজিদের আদলে নির্মাণ করা হয়।

গান্ধী আশ্রম থেকে ফেরার পথে আমরা চলে যাই বজরা শাহী মসজিদ চোখে দেখতে। শুক্রবার আর জুম্মার সময় হয়ে যাওয়ায় সময় নিয়ে দর্শনার্থী হিসাবে ভেতরে দেখার সুযোগ হয়নি। সামনে ঘাট বাধানো দীঘি আর মসজিদ আঙিনা ছিলো লোক সমাগমে ভরপুর।

আমরা ভেতরের অংশ প্রবেশ করে অল্প সময়েই বের হয়ে আসি। বের হওয়ার সময় আমাদের এক মজার অভিজ্ঞতা হয়। সেখানে জিলাপি বিতরণ করছিল। আমরাও ভাগ বসাই তাতে। সিএনজিতে উঠে জিলাপি খেতে খেতে এগিয়ে আসি মাইজদীর দিকে।

আরও পড়ুন: পৃথিবীর রহস্যময় এক স্থান, যেখানে আজও পৌঁছাতে পারেনি কেউ

শহরে পৌঁছে আমরা উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে জুম্মার নামাজ আদায় করে মধ্যাহ্নভোজ করি পাশের নোয়াখালী আইডিয়াল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে। সেখানেই ৩টা থেকে সন্ধ্যা অবধি চলে তৌহিদ অ্যাসোসিয়েটস এর ক্যারিয়ার মিটআপ প্রোগ্রাম। প্রোগ্রাম শেষে আর বিলম্ব না করে যাত্রা শুরু করি ব্যস্ততম রাজধানীর উদ্দেশ্যে।

ফিরতি পথে আমরা প্রথম যাত্রা বিরতি দেই ফেনীতে, দোয়েল চত্ত্বরে। পাশেই ছিল শহীদ মিনার। ফেনীতে আমাদের স্বল্প সময়ের যাত্রা বিরতিতে সহযাত্রী লিও ক্লাব চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী ফিরোজ ভাইকে শুভেচ্ছা জানায় ক্লাবের সদস্যরা। ফেনী মূহুরি লিও ক্লাব আমাদেরও আমন্ত্রণ জানায় তাদের অফিস দেখে আসার।

আমরাও যাই, অল্প সময়ে তাদের আন্তরিকতা আমাদের মুগ্ধ করেছে। এসব মুগ্ধতা নিয়ে আমরা কুমিল্লায় এসে রাতের খাবারের জন্য বিরতি দেই আরেকবার, এরপর আবার যাত্রা শুরু। তবে মেঘনাঘাট এসে যানজটে কবলে আমাদের অবস্থা একেবারেই করুণ। সবশেষে নিরাপদে যখন বাসায় আসি তখন ঘড়ির কাটায় সময় ভোর ৪টা।

লেখক- তানজিদ শুভ্র, শিক্ষার্থী ও ফিচার লেখক।

জেএমএস/এএসএম