মতামত

জামায়াতের সঙ্গী বিএনপিও জঙ্গিবাদী সংগঠন ফের প্রমাণিত

জামায়াত ইসলামের সঙ্গী বিএনপি আসলেই জঙ্গিবাদী দল। কানাডার ফেডারেল আদালত ঠিক কথাই বলেছেন। কারণ এই দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান নিজেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত। জন্মলগ্ন থেকেই বিএনপির সঙ্গে যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানের দোসর ও সন্ত্রাসীদের যোগাযোগ ছিল। খালেদা জিয়ার শাসনামলে তারেক রহমান সরাসরি জঙ্গিবাদীদের মদদ জুগিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনাকেও হত্যার চেষ্টা হয়েছে তারেকের নির্দেশেই। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীকে বাংলাদেশের জমি অবাধে ব্যবহারের সুবিধা করে দিয়েছিল বিএনপি-জামাত জোট।

Advertisement

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কথা বাংলাদেশ ভুলতে পারেনা। তাই কানাডার ফেডারেল আদালত বিএনপিকে যথার্থভাবেই এক সরকার উৎখাতকারী দল আরও স্পষ্ট করে বললে সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী দল বলে ঘোষণা করেছে। বিএনপি শুধু জঙ্গিবাদীদের সমর্থক ও মদদদাতাই নয়, তারা নিজেরাও সরাসরি জঙ্গিবাদী কার্যকলাপে যুক্ত। দেশজুড়ে হরতালের নামে অশান্তি এবং জ্বালানো-পোড়ানোর রাজনীতির মাধ্যমে তারা নিজেরাই সেটা প্রমাণ করেছে।

এদিকে, কানাডার ফেডারেল আদালত বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তথ্যমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বিএনপিকে নির্লজ্জ বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, কানাডা তাদের জঙ্গিবাদী বলে ঘোষণা করলেও বিএনপি নেতাদের কোনও লজ্জা নেই।

সম্প্রতি কানাডার ফেডারেল আদালত বিএনপি দলটাকেই ফের সন্ত্রাসী দল বলে ঘোষণা করেছেন। এই নিয়ে ৫ বার বিএনপিকে তারা সন্ত্রাসী দল বলে ঘোষণা করলেন। বিএনপি বা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে সন্ত্রাসী দল বলে ঘোষণার পাশাপাশি একাধিক বিএনপি নেতার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনও খারিজ করে দিয়েছে কানাডা। এমনকি, বিচারিক পর্যালোচনার আবেদনও মঞ্জুর করতে রাজি হননি তারা। বিএনপির সদস্য মোহাম্মদ জিপসেদ ইবনে হক কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন। কিন্তু ফেডারেল কোর্ট সেই আবেদন খারিজ করে দিয়ে বলেছেন, সন্ত্রাসী সংগঠনের কোনও সদস্যকে আশ্রয় দিতে পারেনা কানাডা। তাদের পর্যালোচনায় বিএনপি দলটি গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করতে সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের কাজে যুক্ত ছিল। সরাসরি জঙ্গিবাদী কার্যকলাপের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলেও চেষ্টা করেছিল বিএনপি। তাই জিপসেদ ইবনে হকের রাজনৈতিক আশ্রয়ের অনুরোধ খারিজ করে দেন কানাডার আদালত।

Advertisement

১৫ জুন ফেডারেল কোর্টে ছিল জুডিশিয়াল রিভিউ পিটিশন। সেখানেই স্পষ্ট ভাষায় তারা বিএনপিকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বলে মন্তব্য করেন। জিপসেদ ইবনে হকের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন আগেই কানাডা খারিজ করে দিয়েছিল। আদালতের দ্বারস্থ হয়েও কোনও লাভ হয়নি। তার অভিযোগ ছিল, বাংলাদেশে তার ওপর রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা হচ্ছে। রাজনৈতিক সহিংসতার অভিযোগ তুলে কানাডায় আশ্রয় চেয়েছিলেন জিপসেদ ইবনে হক। কিন্তু সন্ত্রাসী কোন সংগঠনের সদস্যকে আশ্রয় দিতে আদালতও অস্বীকার করেন।

রায় পর্যালোচনা করতে গিয়ে ফেডারেল আদালত বলেছেন, ইবনে হক ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিএনপির সদস্য ছিলেন। কানাডার অভিবাসন দফতরের কাছে তার বিরুদ্ধে যথাযথ তথ্য রয়েছে বলেও আদালত জানিয়েছেন। অভিবাসন দফতরের তথ্যও বলছে, সাংবিধানিক ভাবে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকারকে হঠাতে বিএনপি সন্ত্রাসী কার্যকলাপে যুক্ত ছিল। ব্যাপক হিংসা ছড়িয়েছে বিএনপি। সহিংসতার মাধ্যমেই তারা ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল। ফেডারেল কোর্টের সাফ কথা, বিএনপি অবশ্যই জঙ্গিবাদী সংগঠন। তাই তাদের সদস্যদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে পারেনা কানাডা।

এর আগেও অবশ্য বিএনপি নেতাদের কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয়ের অনুরোধ একাধিকবার খারিজ হয়েছে। প্রতিবারই বিএনপিকে সন্ত্রাসী তথা জঙ্গিবাদী দল বলে ঘোষণা করেন আদালত। গত বছরই সেলিম বাদশা নামে বিএনপির এক সদস্য কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করলেও সেটিও খারিজ হয়। ২০১৮ সালে মাসুদ রানাকেও একইভাবে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে অস্বীকার করে কানাডা। নিজস্ব প্রক্রিয়াতেই কানাডা বিএনপিকে জঙ্গিবাদী দল বলে মনে করে। নিজেদের বক্তব্যের সমর্থনে প্রমাণও রয়েছে দেশটির হাতে। তাই সেখানকার আদালতও সরকারের সিদ্ধান্তকে মান্যতা দিয়েছে।

আসলে জন্মসূত্রেই বিএনপির অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে পাকিস্তান-প্রেম, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা এবং জঙ্গিবাদী তৎপরতা। জিয়ার হাত ধরেই পাকিস্তানের দালাল ঘাতক শাহ আজিজ প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। খন্দকার আবদুল হামিদ, আবদুল আলীমসহ বেশ কয়েকজন ঘাতককে মন্ত্রিসভার সদস্য করেছিলেন জিয়া। তিনি উগ্র সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবৃক্ষ রোপণ করেছিলেন, পরবর্তীতে এরশাদ-খালেদা জিয়া সেটিকে লালন-পালন করেন।

Advertisement

বাংলাদেশে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের প্রত্যক্ষ তৎপরতা শুরু হয় ১৯৮৬ সালে ‘ফ্রিডম পার্টি’ এবং মুসলিম মিল্লাত বাহিনীর হাত ধরে। এরশাদ ও বেগম খালেদা এই ‘ফ্রিডম পার্টি’কে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন। বেগম জিয়া ‘ফ্রিডম পার্টি’কে সংসদের প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদাও দিয়েছিলেন। এরপর ১৯৮৯ সালে এরশাদ আমলে জন্ম নেয় হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি-বি)। বিএনপির শাসনামলে ১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে তারা আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করলেও বেগম খালেদার প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রথম আমলে সংগঠনটির উত্থান ও বিস্তার ঘটে।

আসলে বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলে জেএমবি, হরকাতুল জিহাদসহ প্রায় শতাধিক জঙ্গি সংগঠনের উত্থান ঘটে। অনেকেই মনে করেন, বিএনপির সাথে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সংযোগ আর বাংলাদেশে জঙ্গি উত্থান একই সূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বারবার সামনে চলে আসে পাকিস্তান, জামাত, শিবির ও বিএনপির নাম। তাই কানাডার আদালতের পর্যালোচনা শতভাগ সঠিক। বিএনপি আসলে জঙ্গিবাদীদের সঙ্গে চলতে চলতে নিজেরাই জঙ্গিবাদী সংগঠন হয়ে উঠেছে।

বিএনপি-জামাত জোটের আমলে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াকে হত্যা করা হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলায় নারী নেত্রী আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২৪ নেতা-কর্মী নিহত হন। গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি মুফতি হান্নানসহ একাধিক জঙ্গি নেতা জবানবন্দিতে বলেছেন- বেগম জিয়ার পুত্র ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরসহ বিএনপি-জামাতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করে ২১ আগস্টের হামলার পরিকল্পনা করা হয়। মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তি মতে, এই হামলার মাস্টারমাইন্ড ছিলেন তারেক রহমান ও জামাত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং এই হামলার গ্রেনেড এসেছিল পাকিস্তান থেকে।

বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০৫ সালের ১৭ই আগস্ট বাংলাদেশের ৬৩টি জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালানো হয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গিদের বোমা হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল সুপ্রিম কোর্ট, জেলা আদালত, বিমানবন্দর, মার্কিন দূতাবাস, জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়, প্রেস ক্লাব ও সরকারি, আধা-সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহ। মাত্র আধঘণ্টার ব্যবধানে চালানো সেই হামলায় ৫ শতাধিক বোমার বিস্ফোরণে দুই জন নিহত ও দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়েছিল। দেশে জঙ্গি কায়দায় ইসলামি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে সারা দেশে সিরিজ বোমা হামলা করেছিল জেএমবি। সেদিন তারা নিজেদের একটি প্রচারপত্র বা লিফলেটও ছড়িয়ে দিয়েছিল।

হুজি-বি’র পর ১৯৯৮ সালে জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) যাত্রা শুরু করলেও বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় এলে পাকিস্তানের লস্কর-ই-তৈয়বার সহায়তায় জেএমবি সংগঠিত হয়। জেএমবি ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দেশে ২৬টি হামলা চালায়।

এ সময় হুজিও জড়িত ছিল বেশ কয়েকটি নাশকতামূলক হামলায়। জঙ্গি নেতা শায়েখ আবদুর রহমান এবং সিদ্দিকুর রহমান বাংলাভাইয়ের তখনই উত্থান ঘটে। কিন্তু এ সকল জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে উপেক্ষা করে বিএনপি-জামায়াত জোটের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর বলেন, দেশে কোন জঙ্গি নেই। গণমাধ্যম এ বিষয়গুলো সামনে নিয়ে এলেও তিনি বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বলেন, বাংলা ভাইটাই সব মিডিয়ার সৃষ্টি। এমনকি বিদেশী চাপের মুখে যখন জঙ্গিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হন বাবর তখনও তার মন্তব্য গুলো ছিলো অসংলগ্ন। তিনি কখনও মিডিয়ার সামনে মন্তব্য করে বসেন, 'উই আর লুকিং ফর শত্রুস'।

দক্ষিণ এশিয়ায় জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটানো, বিশেষত ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহায়তার জন্য এই দেশে তারেক রহমান ও জামায়াত ইসলামের প্রত্যক্ষ সহায়তায় এসেছিলো ১০ ট্রাক অস্ত্র। পাকিস্তান বহু আগেই জঙ্গিবাদী এক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিলো। কিন্তু বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার ছাড়া এই দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে প্রকৃত জঙ্গিবাদের বিস্তার করা সম্ভব ছিলো না। আর এ কারণেই বিএনপি-জামায়াতের সহায়তায় বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তান বানাবার চেষ্টা করা হয়।

আফগানিস্তান থেকে জঙ্গিদের এনে বাংলাদেশে থাকা জঙ্গিদের ট্রেনিং প্রদান করা হয়। শুধু তাই নয়, এই দেশ থেকে আল কায়েদার রিক্রুট হিসেবে জঙ্গিদের প্রেরণ করা হয় আফগানিস্তানে। এর অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার নথিতে। কিন্তু বাংলাদেশকে নতুন এক পাকিস্তানে পরিণত করবার তাদের সেই স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। তবে বাংলাদেশকে ব্যর্থ ও জঙ্গিবাদী এক রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত করার সকল চেষ্টাই করেছিলো বিএনপি-জামায়াত জোট।

আসলে বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলে জেএমবি, হরকাতুল জিহাদসহ প্রায় শতাধিক জঙ্গি সংগঠনের উত্থান ঘটে। অনেকেই মনে করেন, বিএনপির সাথে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সংযোগ আর বাংলাদেশে জঙ্গি উত্থান একই সূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বারবার সামনে চলে আসে পাকিস্তান, জামাত, শিবির ও বিএনপির নাম। তাই কানাডার আদালতের পর্যালোচনা শতভাগ সঠিক। বিএনপি আসলে জঙ্গিবাদীদের সঙ্গে চলতে চলতে নিজেরাই জঙ্গিবাদী সংগঠন হয়ে উঠেছে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম