পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল এবং কর্ণফুলী টানেলের পর বাংলাদেশ সরকার ১৭ আগস্ট আরও একটি জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি চালুর ঘোষণা করেছে। এটা হলো সর্বজনীন পেনশন। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো- সমাজের বয়স্ক নাগরিকদের জন্য একটি টেকসই সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা। অনেক আগে থেকেই এ কার্যক্রম শুরুর আলোচনা থাকলেও এখন তা বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে। এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের প্রসারিত অর্থনীতি এবং কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে প্রবেশের দিকে একটি বড় পদক্ষেপ।
Advertisement
স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এখন মানুষের পেছনে বিনিয়োগ করতে হবে। এতে দীর্ঘ মেয়াদে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নধারার ভিত্তি আরও জোরদার হবে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থায়নের দিকেই প্রসারিত করতে হবে উদ্ভাবনীমূলক আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ধারা।
সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হলে দেশের ১০ কোটিরও বেশি মানুষ এ প্রকল্পের আওতায় আসবে। বিবিএসের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশে মোট শ্রমশক্তি ৫ কোটি ৮৭ লাখ এর মধ্যে ৫ শতাংশ সরকারি কর্মচারী এবং ১০ শতাংশ বেসরকারি খাতে কর্মরত। এদের মধ্যে শুধু সরকারি, আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই অবসর গ্রহণের পর পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্রাচ্যুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই। অবসরবিষয়ক সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা এখনো আমাদের দেশে অনুপস্থিত। ফলে সর্বজনীন পেনশন চালুর বিষয়টি যুগান্তকারী।
বর্তমান পেনশন কর্মসূচির আওতায় দেশের সব কর্মজীবী মানুষ পেনশন প্রকল্পের আওতায় আসবে। এমনকি বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিরাও এতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন। জীবনচক্রের বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষ বিভিন্ন ঝুঁকি, বিপদ এবং বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। ঝুঁকির মাত্রা বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন রকম হয়। উদাহরণস্বরূপ একজন ষাট বছর বয়সী ব্যক্তির ঝুঁকি একজন সক্রিয় ব্যক্তির ঝুঁকির চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং। এই সময়ে, একজন ব্যক্তি আয় হ্রাস, যত্নের অভাব এবং সহনশীলতা হ্রাসসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় ভোগেন। এ প্রেক্ষাপটে প্রত্যেকের জীবনচক্রের শেষ পর্যায়ে বা বার্ধক্যে সামাজিক নিরাপত্তা একান্ত প্রয়োজন।
Advertisement
আবার বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের যুগে আছে। বর্তমানে দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশির বয়স ১৮ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই দেশটি একটি প্রবীণ জাতির পর্যায়ে প্রবেশের অপেক্ষায়। বর্তমানে সারাদেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ১৩ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ। ২০২৫ সালে মোট প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা হবে ২.৮০ কোটি। ২০৫০ সালে এ সংখ্যা হবে ৪.৫০ কোটি এবং ২০৬০ সালে হবে ৫.৬১ কোটি। ২০৫০ সালে দেশে প্রবীণ জনসংখ্যা হবে দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ।
দেশে বর্তমান গড় আয়ু ৭৩ বছর। এ হার ২০৫০ সালে ৮০ বছর এবং ২০৭৫ সালে ৮৫ বছর হবে বলে অনুমান করা হয়েছে। তার মানে আগামীতে প্রবীণদের সংখ্যা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাবে। অতএব, বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সরকারি রাষ্ট্রীয় নীতিগুলো প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
অন্যদিকে উল্লেখ্য যে, অন্তর্ভুক্তিমূলক অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় আমাদের মাথাপিছু আয়ও বাড়ছে। আমাদের জনশক্তির একটি বড় অংশ এখন কর্মে নিযুক্ত এবং দারিদ্র্য পরিস্থিতিও নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। সুতরাং তারা এখন থেকে তাদের ভবিষ্যতের জন্য কিছু অর্থ বিনিয়োগ করতে পারে। এ প্রেক্ষাপটে সব নাগরিকের জন্য পেনশন প্রকল্প চালু করা সময়ের প্রয়োজন ছিল।
ইউনিভার্সাল পেনশন স্কিম বাংলাদেশে একেবারেই নতুন হলেও তা সময়োপযোগী। চীন তার সব নাগরিককে পেনশন সুবিধা দিচ্ছে তিন ধরনের এবং ভারত সাত ধরনের স্কিম চালু করেছে। নেদারল্যান্ডসসহ অনেক উন্নত দেশে এ স্কিমটি রয়েছে। আসলে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা থেকেই এ উদ্যোগটির উৎপত্তি। বাংলাদেশে এ কার্যক্রম চালু করার জন্য বর্তমান সরকারকে অবশ্যই ধন্যবাদ দেওয়া যেতে পারে।
Advertisement
বর্তমান প্রচলিত সামাজিক নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক প্রাথমিকভাবে ১৯৭০ এর দশকে একটি ত্রাণ কর্মসূচি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা দারিদ্র্য ও ঝুঁকি হ্রাসে একটি প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি বাস্তবায়নে দেশের সাফল্যের যে অনবদ্য ট্র্যাক রেকর্ড রয়েছে, সেই সঞ্চিত অভিজ্ঞতা অবশ্যই এ ক্ষেত্রেও সাহায্য করবে। সর্বজনীন পেনশন পরিকল্পনার মাধ্যমে এ সুরক্ষা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হবে। এই কর্মসূচির সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, এটি নিম্ন আয়ের ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে।
এ পেনশন প্ল্যান প্রাথমিকভাবে চারটি বিভাগে পাওয়া যাবে: প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা এবং সমতা। ১৮-৫০ বছর বয়সী সব বাংলাদেশি নাগরিক যুক্ত হতে পারবেন পেনশন ব্যবস্থার সঙ্গে। ৬০ বছর বয়স থেকে তিনি পাবেন পেনশন সুবিধা। পেনশন ভোগী যদি ৭৫ বছরের আগে মারা যান, তবে তার নমিনি ৭৫ বছর বয়স পর্যন্ত পাবেন এই সুবিধা। ইতোমধ্যে পেনশনারদের জন্য চাঁদাও নির্ধারিত হয়েছে। প্রগতি ও সুরক্ষা স্কিমের আওতায় অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেক পেনশনারের জন্য সর্বনিম্ন ১ হাজার এবং সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা।
প্রবাসী স্কিমের অন্তর্ভুক্ত প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য সর্বনিম্ন চাঁদা ৫ হাজার টাকা। তবে এর বেশি অর্থ জমা রাখার সুযোগও আছে। প্রবাসীদের নির্ধারিত চাঁদা পরিশোধ করতে হবে বৈদেশিক মুদ্রায়। সমতা স্কিমের অন্তর্ভুক্তদের চাঁদার হার ৫০০ টাকা। এই স্কিমে সরকার দেবে সমপরিমাণ চাঁদা। অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর স্কিম পরিবর্তনসহ চাঁদার হার বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। কোনো চাঁদাদাতা ১০ বছর চাঁদা প্রদানের পর মারা গেলে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ ফেরত দেওয়া হবে তার নমিনিকে।
ইউনিভার্সাল পেনশন স্কিম বাংলাদেশে একেবারেই নতুন হলেও তা সময়োপযোগী। চীন তার সব নাগরিককে পেনশন সুবিধা দিচ্ছে তিন ধরনের এবং ভারত সাত ধরনের স্কিম চালু করেছে। নেদারল্যান্ডসসহ অনেক উন্নত দেশে এই স্কিমটি রয়েছে। আসলে কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা থেকেই এ উদ্যোগটির উৎপত্তি। বাংলাদেশে এ কার্যক্রম চালু করার জন্য বর্তমান সরকারকে অবশ্যই ধন্যবাদ দেওয়া যেতে পারে।
সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা নির্ভর করে কল্যাণমূলক কর্মসূচির ওপর। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় একটি মাইলফলক। সম্পদের সুষম বণ্টন একটি কল্যাণমুখী-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূলমন্ত্র। দেশব্যাপী ‘ইউনিভার্সাল পেনশন সিস্টেম’ হবে দেশের একটি অনন্য সামাজিক নিরাপত্তা উদ্যোগ। আমরা আশা করি, সর্বজনীন পেনশন প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ সামগ্রিকভাবে তার ভবিষ্যৎ প্রবীণ নাগরিকদের জন্য আরও মানবিক ও উন্নত জীবন নিশ্চিত করতে পারবে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম