আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশ যেন আন্তর্জাতিক মহলের খেলার মাঠ হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, রাশিয়া, ভারত- সবাই যার যার স্বার্থে বাংলাদেশের ব্যাপারে নিজ নিজ অবস্থান পরিষ্কার করছে। তবে সবচেয়ে সক্রিয় অবস্থান নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর নানামুখী চাপ সৃষ্টি করেছে।
Advertisement
র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা, নতুন ভিসানীতিসহ দৃশ্যমান নানা চাপ তো আছেই, আছে নির্বাচন-পরবর্তী নানা নিষেধাজ্ঞার শঙ্ক। এছাড়া মার্কিন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দফায় দফায় বাংলাদেশ সফর করে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলছেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ইদানীং বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যস্ত মানুষ। দিনরাত দৌড়ঝাঁপ করছেন তিনি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো মুখে সবসময় জনগণের কথা বলে। বলে জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। জনগণের জন্যই তারা রাজনীতি করেন, আন্দোলন করেন। আসলে তারা তাকিয়ে থাকেন বিদেশিদের দিকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতার সাথে মিলিয়েই আমাদের বিরোধী দল আন্দোলনের দফা ও তারিখ ঠিক করে। টানা ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় ফেরার জন্য মরিয়া। তাই তারা নিরপেক্ষ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়।
২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে, বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন করেও বিএনপি সাফল্যের মুখ দেখেনি। এবার তারা মরণকামর দিতে তৈরি। আন্দোলন করে সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায় করা যাবে না। তখন তারা দ্বারস্থ হয় বিদেশি শক্তির। নানাভাবে তদবির, লবিং করে মার্কিন প্রশাসনকে বাংলাদেশের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতে পারে। এটা তাদের বিশাল সাফল্য।
Advertisement
বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি বিএনপি শিবিরকে দারুণ চাঙা করে তোলে। আর ব্যাপক চাপের মুখে পড়ে সরকার। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বিপাকে ফেলেছে বিএনপিকেও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের কথা বললেও কখনো অংশগ্রহণমূলক বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেনি। এটা বলা একটু দুষ্করও বটে। একটি দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে নাক গলানোটাও যথেষ্ট আপত্তিকর। সেখানে একটি দেশের সরকারকে সংবিধানের বাইরে কিছু করতে বলা এবং যেটা তাদের দেশে নেই; সেটা চাপিয়ে দেওয়া অসম্ভবও।
তাই যুক্তরাষ্ট্র কখনোই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেনি। তারা বিদ্যমান ব্যবস্থায় অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করতে কাজ করছে। সে নির্বাচনে কারা আসবে না আসবে তা নিয়ে আপাতত যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ না হলে; প্রশ্নবিদ্ধ হলে তার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া যে আওয়ামী লীগের জন্য ভালো হবে না; সেটা আন্দাজ করা যায়। মার্কিন অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগ ব্যাপক চাপে পড়েছে, এটা যেমন ঠিক, বিএনপিও খুব স্বস্তিতে আছে সেটা বলা যাবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান মানলে, তাদের ওপর ভরসা করলে বিএনপিকে বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনে যেতে হবে। এতদিনের আন্দোলনের পর বিএনপি এখন বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে কতটা প্রস্তুত, তা নিয়ে সংশয় আছে। তারপরও সব বিবেচনায় মার্কিন তৎপরতা বিএনপিকে কিছুটা হলেও এগিয়ে রেখেছিল। ভিসা নীতির পর সরকার বিএনপির ওপর আগের মতো চড়াও হতে পারছে না। বিএনপি অনেকটা নির্বিঘ্নে আন্দোলন করতে পারছে। বিএনপির এ স্বস্তির ঘরে ঝড় তুলেছে ভারত। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে মার্কিন অবস্থানকে বরাবরই স্বাগত জানিয়ে আসছে বিএনপি। আর আওয়ামী লীগ তাদের অসন্তোষ গোপন করেনি। বরং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বরাবরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতীত ও বর্তমান তৎপরতার কঠোর সমালোচনা করে আসছে। তারা বলছেন, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। কিন্তু হঠাৎ ভারতের মাঠে নামায় পাল্টে যাচ্ছে পরিস্থিতি। গত শুক্রবার ভারতের আনন্দবাজার এবং জার্মানভিত্তিক ডয়েচেভেলের দুটি নিউজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন বোমা ফাটিয়েছে। এ সংবাদে বলা হয়েছে, ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি কূটনৈতিক নোট পাঠিয়েছে। সেই নোটে বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছে ভারত। প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী কূটনৈতিক নোটে ভারত জানিয়েছে, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার দুর্বল হয়ে পড়লে ভূরাজনৈতিক দিক থেকে তা ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র কারও পক্ষেই সুখকর হবে না।
Advertisement
যুক্তরাষ্ট্রকে দেওয়া ভারতের নোটেও বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতও চায় বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। বাংলাদেশ সরকারও বারবার বলছে, তারা দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। এটা বাংলাদেশের জনগণেরও আকাঙ্ক্ষা। আগামীতে কে বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসবে সেটা বাংলাদেশের জনগণই ঠিক করবে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন নয়। আমাদের সবার কাজ হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করা।
ভারত মনে করে শেখ হাসিনা সরকার দুর্বল হয়ে পড়লে জামায়াতের মতো সংগঠনের ক্ষমতা বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্র জামায়াতকে মডারেট ইসলামী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করলেও ভারতের চোখে তারা উগ্র মৌলবাদী সংগঠন। ভারতের বার্তায় বলা হয়েছে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘ স্থলসীমান্ত আছে। বাংলাদেশে জামায়াতের মতো সংগঠন শক্তিশালী হলে ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা সমস্যার মুখে পড়বে। জামায়াতের মতো সংগঠনের সঙ্গে পাকিস্তানের নিবিড় যোগ আছে বলেই মনে করে ভারত।
শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষে ভারতের এ সুস্পষ্ট অবস্থানে পাল্টে যেতে পারে আগামী নির্বাচন নিয়ে সব হিসাব-নিকাশ। বাংলাদেশের অনেকেই মনে করেন আওয়ামী লীগের টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার পেছনে ভারতের একটা বড় অবদান রয়েছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি না এলেও জাতীয় পার্টিকে আনার ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা গোপন কিছু নয়। ভারতের সাথে আওয়ামী লগের সম্পর্ক বরাবরই ভালো। ভারতও অতীত অভিজ্ঞতা থেকে জানে, আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকাটাই তাদের জন্য স্বস্তিদায়ক।
বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকার সময় ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য আনা ১০ ট্রাক অস্ত্র আনার কথা তারা ভুলে যায়নি। গত ১৪ বছরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময়টায় ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উষ্ণতর হয়েছে। ভারত তাদের সীমান্তের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পেরেছে। এই নিশ্চিন্তটা তারা হারাতে চায় না। সে কারণেই নির্বাচন সামনে রেখে ভারত সরাসরি আওয়ামী লীগের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
কয়েকদিন আগেই আওয়ামী লীগের একটি শক্তিশালী প্রতিনিধিদল ভারত সফর করে এসেছে। সেই সফরের পরপর ভারতের এ অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া আগামী মাসেই দিল্লিতে অনুষ্ঠেয় জি২০-র বৈঠকে যোগ দেবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে বৈঠকে আসছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও। জি-২০ বৈঠককে সামনে রেখে ভারতের এ অবস্থানও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তবে ভারতের এ অবস্থান প্রকাশ্যে আসার সাথে সাথে বদলে গেছে বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপট। এতদিন বিএনপি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাইরের হস্তক্ষেপ নিয়ে উল্লসিত ছিল। কিন্তু এখন আবার ভারতের অবস্থানকে দুর্ভাগ্যজনক বলছে বিএনপি। আর এতদিন বিদেশি শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে অসন্তুষ্ট আওয়ামী লীগ আবার ভারতের অবস্থানে খুশি।
তবে যুক্তরাষ্ট্রকে দেওয়া ভারতের নোটেও বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতও চায় বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। বাংলাদেশ সরকারও বারবার বলছে, তারা দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। এটা বাংলাদেশের জনগণেরও আকাঙ্ক্ষা। আগামীতে কে বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসবে সেটা বাংলাদেশের জনগণই ঠিক করবে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন নয়। আমাদের সবার কাজ হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করা। জনগণ যাতে ভোট দিতে পারে, তা নিশ্চিত করা। আগে থেকেই যেন আমরা কিছু ঠিক করে না রাখি। জনগণ যাতে সত্যিকার অর্থেই সব ক্ষমতার উৎস হয়ে উঠতে পারে।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম