আয়নাল হোসেন ৪১তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার শেখপাড়া (চরপাড়া) গ্রামে তার জন্ম। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তিনি কখনো পত্রিকার হকারি করেছেন। কখনো গার্মেন্টস আবার কখনো কাজ করেছেন কুরিয়ার সার্ভিসে।
Advertisement
সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে তিনি সংগ্রামী জীবন, বিসিএস জয় ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মামুনূর রহমান হৃদয়—
জাগো নিউজ: আপনার শৈশব কেমন কেটেছে?আয়নাল হোসেন: যখন ছোট ছিলাম; তখন আমার বাবা নিখোঁজ হয়ে যান। আমাদের পৈতৃক ভিটা থেকে মা আমাকে নিয়ে চলে আসেন। তারপর কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের গ্রামেই থাকা শুরু করেন। সেখানেই আমার শৈশব। সেখানেই আমার বেড়ে ওঠা।
আরও পড়ুন: প্রথম বিসিএসেই কাস্টমস অ্যান্ড এক্সসাইজে প্রথম সাব্বির
Advertisement
জাগো নিউজ: পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধতা ছিল?আয়নাল হোসেন: আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি; তখন অভাব-অনটনের কারণে পড়াশোনা এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায়। পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার পর আমি পত্রিকা বিলি করার কাজ নেই। কাজ করার ফাঁকে পত্রিকায় দেখতাম জীবন সংগ্রাম করে অনেকে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করছে। গল্পগুলো থেকে আমি এক প্রকার অনুপ্রাণিত হই। আমার এক ভাইকে সব খুলে বলি। তিনি আমাকে নিয়ে স্কুলে যান। দীর্ঘ একটি গ্যাপের কারণে স্কুল আমাকে ভর্তি করছিল না। তারপর এক বন্ধুর মাধ্যমে ত্রিবেণী স্কুলের নবম শ্রেণিতে ভর্তি হই। তখনো পত্রিকার কাজটি চলমান। ভর্তি হওয়ার এক পর্যায়ে মনে হয়েছে পড়াশোনা হয়তো আর হবে না। দীর্ঘ গ্যাপের কারণে একটা জড়তা চলে আসে। সেখান থেকেই আবার অনাগ্রহ তৈরি হয়। পত্রিকার কাজটি ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় চলে আসি। এসে একটি গার্মেন্টসে চাকরি নিই। বেতন খুবই সামান্য। সবার বেতন বাড়ানোর জন্য কর্তৃপক্ষকে বলি। তারা জানান, বেতন বাড়াতে এসএসসি পাসের সনদ লাগবে। তখন আমার মধ্যে জেদ তৈরি হয়। ঠিক করলাম, এসএসসি পাস করেই চাকরি করবো। তখন বাড়ি ফিরে আবার পড়াশোনা শুরু করি। তবে কখনো ক্লাস করতে পারিনি। স্কুলের স্যারদের থেকে, বড় ভাইদের থেকে অনেক উপকার পেয়েছি। এক পর্যায়ে এসএসসি পরীক্ষা দিই। ভালো ফলাফল হয়।
এসএসসিতে ভালো ফলাফলের পর ভাবলাম আরেকটু পড়াশোনা করি। তারপর আমি কলেজে ভর্তি হই। তখন পত্রিকার কাজটা চলমান। কিন্তু কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে উঠে পত্রিকার কাজটি ছেড়ে দিই। আমার কাছে জমানো কিছু টাকা ছিলো। সেটি দিয়ে পড়াশোনার খরচ চালাতে থাকি। পরে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাই। শিক্ষকরা বললেন, তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য পড়াশোনা করো। এতে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ভর্তি প্রস্তুতি নিই। যতটুকু সময় পেয়েছি, চেষ্টা করেছি নিজেকে প্রস্তুত করার। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিই। আমি সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাই। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেই প্রথম পছন্দ হিসেবে বেছে নিই।
আরও পড়ুন: পরিবার আমাকে সাহস জুগিয়েছে: মীম জাহান তন্বী
জাগো নিউজ: বিসিএস জয়ের পেছনের গল্পটি কেমন ছিল?আয়নাল হোসেন: অনার্স শেষে মাস্টার্সে ভর্তির পর করোনার জন্য টিউশনিটা চলে যায়। আমার বাড়ির পাশে এক ভাই ছিলেন। তিনি এনজিওতে চাকরি করতেন। তাকে বললাম, আমি তো পড়াশোনা এভাবে চালাতে পারছি না। আপনি আমাকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। তখন ভাই বললেন, তোর চাকরি করা লাগবে না। তুই সরকারি চাকরির জন্য পড়াশোনা কর। তোর যখন যেই খরচ লাগে, আমি সাহায্য করবো। তারপর আমি সরকারি চাকরির জন্য পড়াশোনা করি। ৪১তম বিসিএস ছিল আমার প্রথম বিসিএস। এতেই আমি সুপারিশপ্রাপ্ত হই।
Advertisement
জাগো নিউজ: আপনার সফলতায় কার অনুপ্রেরণা সবচেয়ে বেশি ছিল?আয়নাল হোসেন: আমার জীবনে দুজন নারীর অবদান আছে। একজন হলেন আমার মা। যিনি আমার জন্মের পর থেকে এখন পর্যন্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। আমার মায়ের ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারবো না। আরেকজন আমার সহধর্মিণী। শেষ মুহূর্তে হলেও আমাকে মানসিকভাবে যথেষ্ট শক্তি জুগিয়েছে। যোগদান করার আগ পর্যন্ত আমি বেকার। পুরো সংসার সে একা সামলাচ্ছে। আমি আজীবন এই দুজনের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো।
আরও পড়ুন: দারিদ্র্যকে জয় করে বিসিএস ক্যাডার আসাদ
জাগো নিউজ: তরুণদের উদ্দেশ্যে কী বলবেন?আয়নাল হোসেন: তরুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে বলবো, হতাশ হওয়া যাবে না। হতাশা আমাদের সম্ভাবনাকে অনেক হ্রাস করে। আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। নিজের দুর্বল বিষয়গুলোতে বেশি সময় দিতে হবে। ভাগ্য সহায় হলে পরিশ্রমের ফল পাবেন।
এসইউ/জেআইএম