প্রবাস

প্রবাসে প্রাণের ভাগ্যবদলের গল্প

নিষ্ঠা, একাগ্রতা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকলে একজন সাধারণ শ্রমিকও যে সাফল্যের চূড়ায় উঠতে পারেন, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মালয়েশিয়া প্রবাসী কুষ্টিয়ার মো. রইছ (৩০)। পরিবার-পরিজন ছেড়ে জন্মভূমি থেকে বহুদূরে দীর্ঘ নয় বছর ধরে কঠোর পরিশ্রম করে নিজেকে সফল একজন মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এই রইছ। আর তার এই সফলতার গল্পে একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের নাম।প্রতিষ্ঠানের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহসান খান চৌধুরীর সঙ্গে রইছ ও অন্যরা।সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন রইছ। শুনিয়েছেন তার সফলতার পথ কতটা বন্ধুর ছিল  সে কথা, কঠোর পরিশ্রম করে কীভাবে নিজের ভাগ্যের চাকা তিনি ঘুরিয়েছেন আলাপে উঠে এসেছে তার পরিষ্কার একটা চিত্রও। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের দীঘলকান্দি গ্রামের আমজাদ হোসেনের ছেলে রইছ ভাগ্য বদলের আশায় ২০০৭ সালে পাড়ি জমান মালয়েশিয়াতে। কলিং ভিসায় মালয়েশিয়া যাওয়ার পর সেদেশের একটি কৃষি কোম্পানিতে  মাসিক মাত্র ৬শ রিঙ্গিতে কাজ শুরু করেন তিনি। জাগো নিউজকে রইছ জানিয়েছেন, এ সময়টা তার জন্য খুবই কষ্টের ছিল। কারণ, প্রথম মাসের বেতন হাতে পাওয়ার পর তিনি কোনোভাবেই হিসাব মেলাতে পারছিলেন না। ওই টাকা দিয়ে তার নিজের চলাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল। অন্যদিকে দেশের মাটিতে বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই তাকিয়ে আছেন রইছের দিকে। রইছের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। ৬শ রিঙ্গিতের মধ্যে নিজের জন্য খরচ করবেন কী, বাঁচাবেন কী আর দেশে পাঠাবেন কী।   রইছ জানান, তিনি যখন এ বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিশেহারা তখন তার সঙ্গে পরিচয় হয় গাজীপুরের মতিন নামে এক এজেন্টের। মতিনের কথা মতো ওই চাকরি ছেড়ে দেন রইছ। যোগ দেন ইপু-তাপা নামক এলাকার আরেকটি কোম্পানিতে, তবে বেতন সেখানেও ওই ৬শ রিঙ্গিতই।  রইছের বিশ্বাস ছিল, কাজে সন্তুষ্ট হয়ে তার বেতন হয়তো বাড়ানো হবে। কিন্তু তেমনটা হলো না। বেতন না বাড়লেও দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকলো রইছের। ভেবে কোনো কূলকিনারা করতে পারছিলেন না তিনি। এরইমধ্যে কুমিল্লার শরিফ নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয় রইছের।  শরিফের কথা মতো রইছের এবারের যাত্রা রাওয়াং-এ। রাওয়াংয়েও তিনি কাজ পান সেই ৬শ রিঙ্গিতেই। এখানে কাজের পাশাপাশি নিজের দক্ষতার দিকে মনোযোগ দেন রইছ। শিখতে শুরু করেন মালয় ভাষা। উপার্জন বাড়াতে সকালে-সন্ধ্যায় অন্য জায়গায় বাড়তি কাজও করতে শুরু করেন তিনি। এভাবে কাজ করে মাস শেষে তার আয় হতো ১৬শ থেকে ১৭শ রিঙ্গিত। এভাবে তিন বছর চলেন তিনি।   রইছ জানান, ২০১১ সালের প্রথম দিকে রাওয়াং-এ তার সঙ্গে পরিচয় হয় প্রাণ কোম্পানির সেলসম্যান জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। জাহাঙ্গীর তাকে বলেন, প্রাণে ভালো বেতনে কর্মী নেয়া হচ্ছে। জাহাঙ্গীরের পরামর্শে তিনি পরদিনই প্রাণের অফিসে চলে যান। তার ইন্টারভিউ নেন মাইন উদ্দিন। আকর্ষণীয় বেতনে ভালো একটা চাকরি হয়ে যায় তার।মূলত এখান থেকেই রইছের ভাগ্যবদলের গল্প শুরু। মাসিক ১১শ রিঙ্গিতে কাজের পাশাপাশি প্রাণের সিনিয়র সেলসম্যান আখতারের সঙ্গে চারটি ট্রেইনিং সম্পন্ন করেন তিনি। রইছের কাজের দক্ষতা দেখে তার মধ্যে সম্ভাবনা দেখেন প্রাণের জেড এম মোশাররাফ হোসেন। প্রতিষ্ঠানের ক্যাটালগের প্রাইস লিস্ট দিয়ে রইছকে তিনি পাঠিয়ে দেন বান্তিং (এল এইচ এস মাজু ট্রেডিং) ডিলার পয়েন্টে। সেখানে তিন মাস কাজ করার পর রইছ চলে আসেন প্রাণের হেড অফিসে। রইছ জানান, মাঝে একটু দ্বিধা থাকলেও একসময় তিনি সিদ্ধান্ত নেন যা হওয়ার হবে, প্রাণের চাকরি তিনি ছাড়বেন না। সময়ের ব্যবধানে রইছের সেই সিদ্ধান্ত সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে তিনি জোনাল ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন। রইছ বলেন, প্রাণ আমার ভবিষ্যৎ। বর্তমানে সাড়ে ৪ হাজার রিঙ্গিত বেতন পাচ্ছি। ২০১৪ সালে কাজের দক্ষতার পুরস্কার হিসেবে একটি গাড়ি পেয়েছি, বাড়ি ভাড়া ফ্রি।চাকরি করে ২০ লাখ টাকা খরচ করে ১ তলা একটি বাড়িও করে ফেলেছেন রইছ। রইছের একমাত্র ছেলের বয়স ১২, নাম অমিত হাসান। এছাড়া তার তিন ভাই ও তিন বোন রয়েছে। ছোট ভাই সোহানুর রহমান ঢাকা তিতুমির কলেজে লেখাপড়া করছেন। সোহানের লেখাপড়ার খরচও বহন করছেন রইছ।

Advertisement

তার মতে, নিজে এইচএসসি পাস করে আর পড়ালেখা করতে পারেননি, তাই ছোটভাইকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারলে বাবা-মা খুশি হবেন। রইছের মতে, বাংলাদেশিরা কাজে দক্ষ, পরিশ্রমী এবং সৎ। রইছ জাগো নিউজকে বলেন, প্রাণের পণ্যের বড় বাজার এখন মালয়েশিয়ার ৯টি প্রদেশ। সেখানকার কয়েকশ শপিং সেন্টার ও গ্রোসারি শপে প্রাণের পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই মালয়েশিয়ার অন্যতম ব্র্যান্ডের খেতাব অর্জন করেছে প্রাণ।কুয়ালালামপুরের কুতারায়া বাংলা মার্কেটসহ মালয়েশিয়ার বিভিন্ন প্রদেশে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রাণের পণ্যের মাঝেই খুঁজে পান মাতৃভূমি বাংলাদেশকে। স্থানীয় মালয় ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত মালয়েশিয়ানদের কাছেও প্রাণ একটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ড।পণ্যের গুণগত মান ও স্বাদের কারণে খুব অল্প সময়ের মধ্যে মালয়েশিয়ায় মানুষের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছে প্রাণ। এমনকি ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের হাতে এখন প্রাণের পণ্য হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে। রইছ বলেন, বাংলাদেশি, ভারতীয় ও নেপালিদের জন্য তাদের রুচি ও স্বাদের সমন্বয় করে বিশেষ পণ্য বাজারজাত করছে প্রাণ। গত দু’বছর ধরে মালয়েশিয়ানদের জন্যও শুরু হয়েছে তাদের পণ্য উৎপাদন। ফলে সবাই প্রাণের পণ্যে পাচ্ছেন দেশীয় স্বাদ। বর্তমানে মালয়েশিয়ানদের জন্য সর্ম্পূণ আলাদা মোড়কে প্রাণের জুস উৎপাদন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে জুসটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। মালয়েশিয়ার বিখ্যাত সব শপিংমলসহ সবখানেই মিলছে প্রাণের পণ্য।এমএম/এনএফ/আরআইপি