ভ্রমণ

শাপলার রাজ্য সাতলা গ্রামে ঘুরতে যাবেন কীভাবে, খরচ কত?

রুবেল মিয়া নাহিদ

Advertisement

বরিশাল সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে উজিরপুর উপজেলার সাতলা ইউনিয়নের উত্তর সাতলা গ্রাম। গ্রামের নামেই বিলের নাম, সাতলা বিল। তবে শাপলার রাজত্বের কারণে সেটি এখন শাপলা বিল নামেই বেশি পরিচিত।

প্রাকৃতিকভাবেই শাপলা বিলের রঙিন হাসিতে উজ্জ্বল গ্রামটি। টলটলে পানিতে ভরা সেই বিল। বছরের একটা সময়ে কয়েক একর এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে লাল টুকটুকে শাপলা। সন্ধ্যা নদীর প্লাবন ভূমি এই ছোট্ট গ্রাম, যা এখন সবার কাছে শাপলা রাজ্য।

আরও পড়ুন: ভাসমান পেয়ারা বাজরে কীভাবে যাবেন ও কত খরচ?

Advertisement

গ্রামের নিম্নাঞ্চল বর্ষার পানিতে ডুবে গেলে জুলাই থেকে শাপলা ফোটা শুরু হয় ও নভেম্বর পর্যন্ত ফুল ফুটতে থাকে। বিলের মাঝেই যাদের বাড়ি, যাতায়াতে নৌকাই তাদের একমাত্র বাহন। এক পলকে মনে হবে, লাল শাপলার কোনো চাদর। পুরো বিলজুড়ে বিছানো শাপলা।

এই বিলকে শাপলার রাজধানী বললেও ভুল হবে না। এ বিলে ভ্রমণের জন্য রয়েছে ছোট আকারের নৌকা। সূর্যের স্নিগ্ধ আলো পড়া মাত্রই এক সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে পরিণত হয়। ছোট নৌকায় করে পুরো বিল বেড়ানো, পানির কল কল ধ্বনি আর তাজা ফুলের দৃশ্য মনে ভিন্ন এক অনুভূতির জোগান দেয়। আর নয়নাভিরাম দৃশ্যে চোখ তো জুড়াবেই।

আবার তার মাঝেই সাদা বক, পানকৌড়ি, মাছরাঙ্গা, ফিঙে, শালিক, দোয়েল, চড়ই, কাঠঠোকরাসহ বিভিন্ন ধরনের দেশীয় প্রজাতির পাখির কলকাকলিও তো আছেই। এখানে কবে থেকে শাপলা ফোটা শুরু হয়েছে তা কারো জানা নেই।

আরও পড়ুন: যে দেশে রাতেও ঝলমল করে সূর্যের আলো

Advertisement

তবে গ্রামের বৃদ্ধদের কাছ থেকে জানা যায় জন্মের পর থেকেই তারা এই বিলে শাপলা ফুটতে দেখেন। স্থানীয়রা প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ শাপলার চাষ করে। তিন ধরনের শাপলার দেখা মিলবে এই বিলে লাল, সাদা ও বেগুনি। তবে লাল শাপলাই বেশি দেখা যায়।

সাতলার প্রায় ১০ হাজার একর জলাভূমিতে শাপলার চাষ করা হয়। শাপলা গ্রাম থেকেই সারাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে শাপলা ফুল সরবরাহ করা হয়। তাছাড়া শাপলার বিল শুধু সৌন্দর্য নয় বিল থেকে শাপলা তুলে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে ওইসব এলাকার অসংখ্য পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছেন।

এখাকার বাসিন্দাদের অনেকেই এই বিলের শাপলার ওপর নির্ভরশীল। এদের কেউ শাপলা তুলে,কেউবা বিল থেকে মাছ শিকার করে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন ওই এলাকার কয়েক শ’ পরিবার। বছরের এই সময় বিল ভরা শাপলা থাকায় সাতলার জনপদজুড়ে আসে আনন্দ।

আরও পড়ুন: পাহাড়ি ঝরনায় গিয়ে কেন পথ হারাচ্ছেন পর্যটকরা?

শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়, এখানকার দরিদ্র মানুষগুলো শাপলানির্ভর কর্মযজ্ঞ করে আর্থিকভাবে টিকে থাকে। এ সময়টায় কৃষি কাজের চাপ না থাকায় কৃষিজীবী পরিবারগুলোর কাছে শাপলা যেন আশীর্বাদ হয়ে ধরা দেয়। গৃহকর্তারা বিলের পানিতে বৈঠা চালান, নৌকায় বসে পুত্র বা কন্যাটি টেনে টেনে নৌকায় তোলে শাপলা।

পরিবারের গিন্নি শাপলাগুলো গুছিয়ে আটি বাঁধেন হাটে পাঠানোর তাগিদে। সকালের আলো বাড়তেই শাপলাগুলো নিয়ে হাটে যেতে হয়। তাই খুব সকাল থেকে শুরু হয় পারিবারিক কর্মযজ্ঞ। স্থানীয় বাজারে প্রতিটি শাপলার আটি বিক্রি হয় ৮-১০ টাকা।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বছরের এই সময় জল্লা ইউনিয়নের হারতা, বাগদা, কারফা, সাতলা, পশ্চিম কালবিলাসহ ৭-৮টি গ্রামের কিছু পরিবারের জীবিকা চলে শাপলা সংগ্রহ ও বিক্রির মাধ্যমে। এ অঞ্চলে বড়-ছোট প্রায় ২০টি বিল আছে, ডিসেম্বর মাসে শুরুর দিকে শীতের মৌসুমে যখন পানি কমে যায় তখন সব শাপলা মরে যায়।

ওই সময় কৃষকরা এখানে ধান চাষ করেন। তবে একই সঙ্গে ধান ও শাপলার এই সহাবস্থান আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। স্থানীয় কৃষিসংশ্লিষ্টরা জানালেন, প্রতিবছর জৈষ্ঠ্য থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত মোট ছয় মাস এই সাতলা বিলে পানি জমে থাকে।

আরও পড়ুন: বর্ষায় ঘুরে আসুন বান্দরবানের ৪ জলপ্রপাতে

বছরের ছয় মাস বিলে পানি জমে থাকার কারণে বিলটি এক ফসলা জমিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর ধানের মৌসুমে জমিতে চাষ দেয়া হলেও মাটির সঙ্গে মিশে থাকছে শাপলা-শালুকের বীজগুলো। ফলে পরের বছরে বিলে পানি আগমনের সঙ্গে সঙ্গে এই বীজ থেকেই আবার শাপলার জন্ম হচ্ছে।

কীভাবে যাবেন শাপলা গ্রাম?

সাতলার শাপলা গ্রামে যেতে চাইলে প্রথমেই দেশের সব প্রান্ত থেকেই বরিশাল যেতে হবে। ঢাকা থেকে বরিশালে সড়কপথে কিংবা নৌপথে যেতে হবে। ঢাকার গাবতলীতে ভোর ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত নিয়মিত বরিশাল যাওয়ার বাস পাওয়া যায়। বাসগুলো মাওয়া ও পাটুরিয়া দিয়ে বরিশাল যায়।

ঢাকা থেকে আগত বাসগুলো বরিশালের নতুল্লাবাদ বাস স্ট্যান্ডে এসে থামে। হানিফ পরিবহণ, ঈগল পরিবহন, শাকুরা পরিবহন বরিশাল যাওয়ার জন্য অন্যতম। এক্ষেত্রে এসি বাসগুলোতে ৭০০-৮০০ এবং নন-এসি বাসগুলোতে ৫০০ টাকা করে ভাড়া লাগবে। ঢাকা থেকে নৌপথে বরিশাল যেতে চাইলে প্রথমেই ঢাকার সদরঘাট যেতে হবে।

আরও পড়ুন: বর্ষায় মিরসরাইয়ের ৮ ঝরনায় ঢল নেমেছে পর্যটকদের

ঢাকার সদরঘাট রাত ৮-৯ টার মধ্যে অনেকগুলো লঞ্চ বরিশালের জন্য ছেড়ে যায়। সুরভী ৮, পারাবত ১১, সুন্দরবন ৭/৮, কীর্তিনকোলা ১/২ লঞ্চগুলো বরিশালের দিকে ছেড়ে যায়। রাতের লঞ্চগুলো ভোর ৫টায়+ বরিশাল পৌঁছায়। আপনি চাইলে সকালেও যেতে পারেন।

বরিশালের উদ্দেশ্যে সকালে গ্রিনলাইন লঞ্চ ছেড়ে যায়। এক্ষেত্রে ডেকের ভাড়া হবে ১৫০ টাকা, ডাবল কেবিনের ভাড়া ১৬০০ টাকা এবং ভিআইপি কেবিন ভাড়া ৪৫০০ টাকা। লঞ্চ কিংবা বাস থেকে নামার পর বরিশাল থেকে আবার বাসে করে শিকারপুর আসতে হবে।

শিকারপুর থেকে অটো ভাড়া করে উত্তর সাতলা যেতে হবে। বরিশালের নথুল্লাবাদ বাসস্ট্যান্ড) থেকে সাতলা ও বাগধা গ্রামে যাওয়ার সরাসরি বাস দিয়ে পৌঁছে যেতে পারবেন আপনার গন্তব্যে। এক্ষেত্রে সময় লাগবে ২ ঘণ্টা। তাছাড়া বরিশাল থেকে মহেন্দ্র গাড়িতে করে ঘুরে আসতে পারবেন শাপলা গ্রাম।

আরও পড়ুন: ২১ বছরেই ১৯৬ দেশ ভ্রমণ তরুণীর, জানালেন অভিজ্ঞতা

খাবারের ব্যবস্থা

শাপলা গ্রামে তেমন খাবারের ব্যবস্থা নেই। তবে সেখানকার স্থানীয়রা অতিথি আপ্যায়ন করতে খুব পছন্দ করেন। এছাড়া গ্রামে লোকাল কিছু খাবারের হোটেল আছে আপনি চাইলে সেখানেও খেতে পারেন। সবচেয়ে ভালো হয় বরিশাল শহরে গিয়েই একেবারে খেতে পারলে। শহরে বেশকিছু রেস্টুরেন্ট আছে।

থাকার ব্যবস্থা

এই গ্রামে থাকারও কোনো ব্যবস্থা নেই। রাতে থাকতে চাইলে স্থানীয়দের কারো বাড়িতে কিংবা স্কুলঘরে থাকতে হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয়দের সঙ্গে আগে থেকেই কথা বলে নিতে হবে। তাছাড়া আপনি চাইলে বরিশাল ফিরে যেতে পারেন। বরিশালে থাকার জন্য কিছু ভালো মানের আবাসিক হোটেল আছে।

জেএমএস/এমএস