মতামত

শেখ হাসিনার উন্নয়নের দর্শন, সর্বজনীন পেনশন

সর্বজনীন পেনশন দেশের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা সার্বজনীন পেনশন চালু করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। হয়তো কাজটা শুরু হতে একটু দেরি হয়েছে। এর যথাযথ কারণও ছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের সময় মানুষের জীবনযাত্রা এতোটা সুখকর ছিল না। বর্তমান সরকারের টানা চৌদ্দ বছরে দেশের জনগণের জীবন মানের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে।মানুষ স্বাবলম্বী হয়েছে,অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে।সেকারণেই এখন সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করা হয়েছে।

Advertisement

গত ১৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বজনীন পেনশন স্কিম কার্যক্রমের শুভ উদ্বোধন করেছেন ।দেশে-বিদেশে অবস্থানরত ১০ কোটি জনগণের জন্য পেনশন স্কিম চালু হয়েছে।১৮ বছরের বেশি যেকোনো বাংলাদেশীকে পেনশনের আওতায় আসার সুযোগ দেয়া হয়েছে।সমাজের সব শ্রেণির মানুষের কথা বিবেচনা করে ৪ ধরনের স্কিম চালু করা হয়েছে।(১)প্রগতি স্কিম,এটি বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নির্ধারিত।(২) প্রবাসী স্কিম,যারা প্রবাসি হিসেবে বিদেশে কর্মরত আছেন।

(৩) সুরক্ষা স্কিম,স্বকর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য নির্ধারিত।(৪)সমতা স্কিম, এ সুবিধা স্বল্প আয়ের নাগরিকরা পাবেন। পেনশন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে,চাঁদা দাতা ৬০ বছর বয়স থেকে পেনশন পাওয়া শুরু করবেন। ৭৫ বছরের পূর্বে মারা গেলে তাঁর নমিনি বাকি সময় মাসিক কিস্তি একই ভাবে পাবেন। ১০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই গ্রাহক মারা গেলে নমিনি জমাকৃত অর্থ সুদসহ ফেরত পাবেন।

চাঁদাদাতা মোট অর্থের ৫০ শতাংশ ঋণ নিতে পারবেন,যা পরবর্তী ২৪ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে।সর্বজনীন পেনশনে চাঁদার হার ধরা হয়েছে প্রবাসী স্কিমে ৭ হাজার,সাড়ে ৭ হাজার ও ১০ হাজার টাকা;প্রগতি স্কিমে ২ হাজার,৩ হাজার ও ৫ হাজার টাকা;সুরক্ষা স্কিমে ১ হাজার,২ হাজার,৩ হাজার,৫ হাজার টাকা;সমতা স্কিমে ১ হাজার টাকা।এরমধ্যে গ্রাহক দিবে ৫০০ টাকা ও সরকার দিবে ৫০০ টাকা।পেনশনের অর্থ বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে এবং মাসিক পেনশনের অর্থ সম্পূর্ণ আয়করমুক্ত থাকবে।অনলাইনে ফরম পূরণ বা সারাদেশের সোনালী ব্যাংকের ১ হাজার ২২৯ টি শাখাই নিবন্ধন ও চাঁদা জমা দেওয়া যাবে।

Advertisement

বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি।এদের গড় আয়ু ৭২ বছর ৩ মাস।যতই দিন যাচ্ছে গড় আয়ু ততোই বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে টেকসই ও নির্ভরযোগ্য সামাজিক নিরাপত্তা দেওয়া খুবেই প্রয়োজন ছিল।বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৬২ শতাংশ কর্মক্ষম। ২০২০ সালে জনশুমারির তথ্য মতে, ষাটোর্ধ্ব জনসংখ্যা ছিল ১ কোটি ২০ লাখ,২০৪১ সালে হবে ৩ কোটি ১০ লাখ এবং ২০৬১ সালে ৫ কোটি ৫৭ লাখে দাঁড়াবে।বর্তমানে গড় আয়ু ৭৩ বছর ৩ মাস,যা ২০৫০ সালে ৭৯ বছর ৯ মাস এবং ২০৭৫ সালে ৮৪ বছর ৩ মাস হবে।এভাবে গড় আয়ু বৃদ্ধি হলে ভবিষ্যতে নির্ভরশীলতা আরো বাড়বে তখন বয়স্ক মানুষদেরকে সুরক্ষা দিতে সর্বজনীন পেনশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

বিসিএসের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশে শ্রমশক্তি প্রায় ৬ কোটি।এর মধ্যে সরকারি চাকরি করে ৫ শতাংশ, বেসরকারি চাকরি করে ১০ শতাংশ এই ১৫ শতাংশ হলো প্রাতিষ্ঠানিক খাত। বাকি ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত,যাদের কোনো নিয়োগপত্র নেই। সরকারের প্রাথমিক টার্গেট এই ৮৫ শতাংশ মানুষ।যাদেরকে পেনশনের আওতায় আনা হবে।

সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় পাঁচ বছর ঐচ্ছিক রাখা হয়েছে।পরবর্তীতে এটি বাধ্যতামূলক করা হবে।বর্তমানে সরকার ৬৫ বছরের উর্ধ্বে দরিদ্র বয়স্ক ব্যক্তিদের সামাজিক কর্মসূচির আওতায় ৫০০ টাকা করে বয়স্ক ভাতা দেন।কিন্তু বয়স্ক আরো অনেক লোক কোনো ধরনের ভাতা কিংবা পেনশনের বাহিরে রয়েছে। সর্বজনীন পেনশন সব ধরনের বয়স্ককেই সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। তখন তাদের সকলের মধ্যে এক ধরনের সামাজিক নিরাপত্তাবোধের জন্ম নিবে। বয়স্ক লোকেরা আর পরিবারের উপর মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে থাকতে হবে না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অঙ্গীকার করেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় গেলে দেশের বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর মাধ্যমে বৃদ্ধকালীন সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে তিনি তাঁর অঙ্গীকার রক্ষা করলেন। শেখ হাসিনার উন্নয়নের দর্শন,সর্বজনীন পেনশন। এটি নিঃসন্দেহে একটি কল্যাণমূলক উদ্যোগ।

Advertisement

বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও জীবনমানের উন্নয়নের কারণে মানুষের গড় আয়ু বেড়েই চলছে। পাল্লা দিয়ে বাড়বে প্রবীণদের সংখ্যা। সঙ্গতকারণেই প্রবীণদের আনুষ্ঠানিক সেবার প্রয়োজনীয়তাও আরো বেড়ে যাবে। তখন কর্মক্ষম মানুষদের উপর প্রবীণ জনগোষ্ঠীর যে চাপ বাড়বে,তা অনেকের পক্ষেই সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে।অবস্থা এমন হতে পারে একজন কর্মক্ষম মানুষের উপর তিন প্রজন্মের দায়িত্ব পড়তে পারে (তার নিজের,বা-মা,দাদা-দাদি)।দেশ যতই উন্নত হোক সবার পক্ষে তিন প্রজন্মের দায়িত্ব নেয়া সম্ভব হবে না।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের পেনশন ব্যবস্থা চালু আছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ২০০৯ সালে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করেছে।সেখানেও ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত সব নাগরিকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।চীনে সরকারি চাকরিজীবী ও সাধারণ নাগরিকদের আলাদা দুই ধরনের পেনশন চালু আছে। যুক্তরাজ্যে চার ধরনের পেনশন ব্যবস্থা চালু আছে।যুক্তরাষ্ট্রে গ্রাহকের কর ও ট্রাস্টের জমার বিনিয়োগকৃত অর্থ থেকেই পেনশন দেয়া হয়।অস্ট্রেলিয়া,নিউজিল্যান্ডের মতো উন্নত দেশ অথচ লোকসংখ্যা কম এমন দেশগুলো বাজেট থেকেই সকল জনগণকে পেনশন দিয়ে থাকে।

সর্বজনীন পেনশন স্কিম উদ্বোধন করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন,‘মানুষ যখন বৃদ্ধ হয়,পরিণত বয়স হয়,আয়-রোজগারের সামর্থ্য থাকেনা,অথবা অসুস্থ হয়ে কর্মহীন হয়ে পড়েন বা কাজ করতে পারেন না,পরিবারের কাছে বোঝা হয়ে যায়,এমনকি ছেলেমেয়েরাও দেখতে চায় না।এই অবস্থায় অসহায় হয়ে যান বৃদ্ধরা। তাদের কারও কাছে হাত পেতে খেতে হবেনা।এই পেনশন স্কিম সেই সময় সুরক্ষা ব্যবস্থা দিবে।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন,এখনই পারিবারিক বন্ধন অনেকটা শিথিল হয়ে যাচ্ছে,যার কারণে অনেক প্রবীণদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে,ভবিষ্যতে আরো বাড়বে।তখন সেসকল ব্যক্তিদের সামাজিক নিরাপত্তাকল্পে সর্বজনীন পেনশন খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন তিনি জনগণকে যে ওয়াদা করেন, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। অঙ্গীকার করেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় গেলে দেশের বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর মাধ্যমে বৃদ্ধকালীন সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন,সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে তিনি তাঁর অঙ্গীকার রক্ষা করলেন। শেখ হাসিনার উন্নয়নের দর্শন,সর্বজনীন পেনশন। এটি নিঃসন্দেহে একটি কল্যাণমূলক উদ্যোগ। একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্রগঠনে অন্যন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে। এই পেনশন স্কিম ভবিষ্যতে জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা দিবে এবং জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।haldertapas80@gmail

এইচআর/জেআইএম