আইন-আদালত

‘সাক্ষী হাজির করতে ব্যর্থ হওয়ায় কিছু মামলা নিষ্পত্তি হয়নি’

দেশের ৬৩ জেলায় সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোর নিষ্পত্তির বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এ এম) আমিন উদ্দিন বলেন, জঙ্গিদের বহু মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। আরও কিছু মামলা বিচারাধীন রয়েছে। পুলিশ সাক্ষী হাজির করতে ব্যর্থ হওয়ায় ১৭ থেকে ১৮ বছরেও মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা যায়নি। তবে, দ্রুত সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হবে।

Advertisement

দেড় যুগের বেশি সময় পার হলেও এসব মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জানালেন, সাক্ষী হাজির করতে না পারার কথা।

২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) নামের একটি জঙ্গি সংগঠন পরিকল্পিতভাবে দেশের ৬৩ জেলায় একই সময়ে সিরিজ বোমা হামলা চালায়। এ হামলায় দু’জন নিহত ও অন্তত ১০৪ জন আহত হন। মুন্সিগঞ্জ ছাড়া সব জেলায় প্রায় ৫০০ পয়েন্টে বোমা হামলা চালানো হয়। বৃহস্পতিবার (১৭ আগস্ট) সেই সিরিজ বোমা হামলার ১৮ বছর পূর্ণ হলো।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে চালানো এ বোমা হামলায় প্রাণ হারান ঝালকাঠি আদালতের দুই বিচারক। আহত হন অন্তত শতাধিক মানুষ। ঘটনার ভয়াবহতায় স্তম্ভিত হয় গোটা দেশের মানুষ। শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে এ জঙ্গি হামলার ঘটনায় সারাদেশে ১৫৯টি মামলা হয়। তদন্ত শেষে এ ঘটনায় সবকটি মামলার প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছেন পুলিশ।

Advertisement

জানা গেছে, ২০০৫ সাল থেকে চলতি বছরের ১৭ আগস্ট পর্যন্ত এসব মামলার মধ্যে ১৪২টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেওয়া হয়। বাকি ১৭টি মামলায় ঘটনার সত্যতা থাকলেও আসামি শনাক্ত করতে না পারায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। মামলাগুলোতে ১৩০ জন এজাহারনামীয় আসামি ছিলেন। বিভিন্ন অভিযানের মাধ্যমে মোট ৯৬১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়েছিল এক হাজার ১৩১ জনকে। অভিযোগপত্রের আসামিদের মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছিল এক হাজার ২৩ জনকে। আসামিদের মধ্যে ৩২২ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। ১৫ জনের ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয়। এসব মামলায় খালাস পেয়েছেন ৩৪৯ জন, আর জামিনে আছেন ১৩৩ জন।

সিরিজ বোমা হামলার সময় জেএমবির প্রধান ছিলেন শায়খ আব্দুর রহমান, সামরিক শাখার প্রধান ছিলেন সিদ্দিকুর রহমান বাংলা ভাই। অন্য একটি মামলায় ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

আরও পড়ুন>> দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ভয়াল দিন আজ

মামলার তদন্তে যা উঠে এসেছে:তদন্ত সূত্রে জানা যায়, বোমা হামলার পর পরই জঙ্গিদের ধরতে সারাদেশে জেএমবিবিরোধী অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অভিযানে গ্রেফতার করা হয় জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম (বাংলা ভাই), আতাউর রহমান সানি, খালেদ সাইফুল্লাহসহ সাড়ে ৪শ’ জঙ্গিকে। এরপর ২০০৭ সালে ফাঁসি কার্যকর করা হয় জেএমবির শীর্ষ নেতাদের। তাদের ফাঁসির রায় কার্যকরের পর জেএমবির আমির হন মাওলানা সাঈদুর রহমান। দ্বিতীয় দফা পুনর্গঠিত হতে থাকে জেএমবি। তবে, তিনিও বেশি দিন গ্রেফতার এড়িয়ে থাকতে পারেননি। ২০১০ সালের ২৫ মে ঢাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

Advertisement

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে জানা যায়, সাঈদুর রহমান গ্রেফতারের ৪ বছর পর ২০১৪ সালে আবারও জোরালোভাবে নিজেদের শক্তি জানান দেয় জেএমবি। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশের প্রিজন ভ্যান থেকে জঙ্গি ছিনতাই করে তারা। এ সময় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি (৩৮), রাকিবুল হাসান ওরফে হাফেজ মাহমুদ (৩৫) এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আসামি জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমারু মিজানকে (৩৫) ছিনিয়ে নেওয়া হয়।

এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এএম) আমিন উদ্দিন বলেন, একযোগে দেশের ৬৩ জেলায় জঙ্গি হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোর অধিকাংশই দেশের বিভিন্ন জেলায় হয়েছে। কিছু কিছু আসামি অন্যান্য মামলার সঙ্গে জিড়ত। দেখেন, এখানে অনেকগুলো মামলা। বরিশালে যে জজের বাড়িতে হামলা করেছে। জজের গাড়িতে হামলা করা হয়েছে। সেই হামলার কিন্তু বিচার শেষ হওয়ার পরে ৬ জনের ফাঁসির রায় হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। তারই ছিল কিন্তু মূল পরিকল্পনাকারী। এ জঙ্গি সংগঠনের তারাই ছিল সব কিছু। বিচার শেষে রায় হওয়ার পরে কিন্তু জঙ্গিদের তৎপরতা কমে গেছে।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আর বাকি বিচারাধীন মামলাগুলোর অধিকাংশ কিন্তু নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। কিছু মামলা বাকি রয়েছে। সেগুলোর সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না বা সাক্ষী আসছে না তাই দেরি হচ্ছে। এর ভেতরে জঙ্গি হামলার অনেকগুলো মামলার আসামির অন্যান্য মামলায় দণ্ড কার্যকর হয়ে গেছে। এসব কারণে দেরি হচ্ছে।

জঙ্গি তৎপরতা কমানোর বিষয়ে তিনি বলেন, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত যতগুলো মামলা হয়েছে, সবাইকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়েছে। যার ফলে কিন্তু জঙ্গি তৎপরতা কমে গেছে। এটার জন্য আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিশেষ ধন্যবাদ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গিদের নির্মূলের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। সব নির্মূল না হলেও মোটামোটি নির্মূল করে ফেলেছে। জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারছে না।

প্রসঙ্গতদেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ১৮ বছর পূর্তি আজ। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জেএমবি নামের একটি জঙ্গি সংগঠন পরিকল্পিতভাবে দেশের ৬৩ জেলায় একই সময়ে সিরিজ বোমা হামলা চালায়। এ হামলায় দু’জন নিহত ও অন্তত ১০৪ জন আহত হন। মুন্সিগঞ্জ ছাড়া সব জেলায় প্রায় ৫০০ পয়েন্টে বোমা হামলা চালানো হয়।

পুলিশ সদর দপ্তর ও র্যাবের তথ্যানুযায়ী, ঘটনার পরপরই সারাদেশে ১৫৯টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে ডিএমপিতে ১৮টি, সিএমপিতে ৮টি, আরএমপিতে ৪টি, কেএমপিতে ৩টি, বিএমপিতে ১২টি, এসএমপিতে ১০টি, ঢাকা রেঞ্জে ২৩টি, চট্টগ্রাম রেঞ্জে ১১টি, রাজশাহী রেঞ্জে ৭টি, খুলনা রেঞ্জে ২৩টি, বরিশাল রেঞ্জে ৭টি, সিলেট রেঞ্জে ১৬টি, রংপুর রেঞ্জে ৮টি, ময়মনসিংহ রেঞ্জে ৬টি ও রেলওয়ে রেঞ্জে ৩টি মামলা হয়েছে।

এগুলোর মধ্যে ১৪২টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। বাকি ১৭টি মামলায় ঘটনার সত্যতা থাকলেও আসামি শনাক্ত করতে না পারায় চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়া হয়। এসব মামলায় গ্রেফতার করা হয় ৯৬১ জনকে। এক হাজার ৭২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।

জেএমবির আদ্যপান্ত১৯৮৮ সালে শায়খ আবদুর রহমান জেএমবি প্রতিষ্ঠা করলেও প্রতিষ্ঠার ১০ বছর পর ১৯৯৮ সালে সংগঠনটি দেশব্যাপী তাদের কার্যক্রম শুরু করে। তবে দলটির প্রকাশ্য তৎপরতা শুরু হয় ২০০৩ সালের প্রথমদিকে। পরে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় সিরিজ বোমা হামলা ও ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠিতে বিচারককে হত্যার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে এ জঙ্গি সংগঠনটি।

এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতারের পর জেএমবির শুরা কমিটির প্রধান সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আধ্যাত্মিক নেতা শায়খ আবদুর রহমান, অপারেশন কমান্ডার আতাউর রহমান সানি, খালেদ সাইফুল্লাহসহ শীর্ষ ছয় জনের ফাঁসি ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ কার্যকর হওয়ার পর আত্মগোপনে যায় সংগঠনের অন্য নেতা-কর্মীরা। মতাদর্শগত পার্থক্য ও নেতৃত্ব সংকটের কারণে ২০১৫ সালে জেএমবি থেকে একটি বড় অংশ বেরিয়ে গিয়ে নব্য জেএমবি নামে নতুন সংগঠন তৈরি করে। জেএমবি সংগঠনটি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পুরাতন জেএমবি ও নব্য জেএমবি। পুরাতন জেএমবি ছোটখাট নাশকতা করে সংগঠনটি সচল রাখতে চাইলেও নব্য জেএমবি চুপচাপ তাদের সাংগঠনিক ও আর্থিক শক্তি বাড়ানোর কাজ করতে থাকে। যার প্রতিফলন ঘটে ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার মধ্যদিয়ে।

হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা করে দেশি-বিদেশি ২০ জনকে হত্যা করা হয়। এর ঠিক সপ্তাহখানেক পর ৭ জুলাই শোলাকিয়ার ঈদগাহে আরও একটি হামলা চালায় নব্য জেএমবি। এসব হামলার দায় আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) স্বীকার করলেও একে ‘নব্য জেএমবি’ বা জেএমবির বিদ্রোহীর অংশগ্রহণ বলে বলছেন বাংলাদেশি গোয়েন্দারা।

এ দু’জঙ্গি হামলার পর অনেকটা গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা জঙ্গি আস্তানার সন্ধান করতে থাকে এবং নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতাদের খোঁজে অভিযান পরিচালনা করতে থাকে পুলিশের কাউন্টার টোরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।

এরপর রাজধানীসহ সারাদেশে বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় জেএমবির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের ধরতে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের তৎপরতার মুখে নব্য জেএমবি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। শীর্ষ জঙ্গিদের অনেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হয়েছেন। অনেকে আবার ধরা পড়েছেন।

এফএইচ/এমএএইচ/জিকেএস