১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট সকালে আব্বা বাংলাদেশ বেতার অন করার পর ভেসে এল মেজর ডালিম এর কণ্ঠস্বর। তাদের অপকর্মের কথা জোর গলায় ঘোষণা করছেন লোকটা। কণ্ঠে নেই কোনো অনুতাপ, বরং ঝরে পড়ছিল চরম ধৃষ্টতা। আব্বা অবুঝের মতো বারবার বলতে লাগলেন, নাহ এ সত্যি নয়। সত্যিই কি বঙ্গবন্ধু আর বেঁচে নেই?
Advertisement
তাহলে এখন কী হবে? এখন আমরা কী করব? আব্বা একেবারে বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন। আব্বার মধ্যে যে দ্বন্দ্ব চলছিল, তা থেমে যায় কিছুক্ষণের মধ্যে। বুঝতে পারেন সত্যি সত্যি বঙ্গবন্ধু আর নেই। “সব শেষ শেষ হয়ে গেছে” একথা বলেই আব্বা হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলেন। বলেছিলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটা কি আবার পাকিস্তান হয়ে যাবে?
আমিও সেই ছোট বয়সে স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিলাম রেডিওর ঘোষণা: 'শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে।' কী করব কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। আব্বা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এর আগে আমি কখনও আব্বাকে কাঁদতে দেখিনি। আম্মাও কাঁদছেন। ওদের কাঁদতে দেখে আমিও বুঝে, না বুঝে কাঁদতে থাকলাম। আমার তখন রাজনীতি বোঝার বয়স নয়, বুঝতামও না। কিন্তু পারিবারিক কারণে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি অসম্ভব টান বা ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল।
আমার আব্বা শামসউল হুদা সেসময় ছিলেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রিন্সিপাল ইনফরমেশন অফিসার। আব্বা কাঁদছেন এবং তার হাত-পা থরথর করে কাঁপছিল। বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে খবর জানার চেষ্টা করছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ঠিক পাশের বাসায় মাহবুব চাচারা থাকতেন। আব্বা ক্রমাগত সেখানে ফোন করে চলেছেন। অনেক পরে চাচা ফোন ধরে বললেন, “হুদা মনে হচ্ছে বঙ্গবন্ধু নাই। ওনাকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা সবাই খাটের নিচে লুকিয়ে আছি। সেনাবাহিনী পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে।”
Advertisement
এর আগে ভোরবেলাই আমাদের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে। দৌড়ে আব্বা আম্মার ঘরে গেলাম। সবাই হতচকিত, ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। আমাদের আসাদগেট নিউকলোনির বাসাটা ৩২ নম্বরের খুব কাছেই ছিল। ফলে অত ভোরে গুলির শব্দ যেন ঝনঝন করে এসে আমাদের কানে লাগছিল। যদিও তখনো আমরা জানতে পারিনি বঙ্গবন্ধুর বাসায় গুলি চলছে।
খবর জানার জন্য আব্বা হতভম্ব হয়ে চারিদিকে টেলিফোন করার চেষ্টা করছিলেন। শব্দটা এত কাছ থেকে আসছিল যে কান পাতা যাচ্ছিল না। এরমধ্যে আম্মা হঠাৎ বলে উঠলেন “গুলির শব্দ কি বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে আসছে? ওনাকে কি মেরে ফেললো ? তুমি রেডিও ধর”। আম্মার এই কথার পর আব্বা সম্বিত ফিরে পেয়ে রেডিও অন করেছিলেন।
বয়স কম হলেও সেদিনের প্রতিটি ঘটনা এখনো আমার চোখের সামনে ভাসে। কারণ পুরো ব্যাপারটার সাথে আমরাও জড়িয়ে ছিলাম পরোক্ষভাবে। আমার বয়স তখন মাত্র ১০ বছর। ১৯৭৫ সালের ১৭ মার্চ আমি আব্বার হাত ধরে গণভবনে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে। ঐরকম বড়মাপের সুন্দর মানুষ আমি জীবনে প্রথম দেখেছিলাম।
স্পষ্ট মনে আছে “যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা, গৌড়ি যমুনা বহমান” কবিতাটির প্রথম চার লাইন শিখে বঙ্গবন্ধুকে শুনিয়েছিলাম। উনি মাথায় হাত রেখে দোয়া করেছিলেন। আমার ছোট হৃদয়ে সেই যে বঙ্গবন্ধু নামটা গাঁথা হয়ে গেল, আর কোনোদিন তা মুছে গেল না। চোখ বন্ধ করলে সেই ক্যারিসম্যাটিক চেহারাটা ভেসে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর জন্ম উৎসবে যাওয়ার এবং ওনাকে এত কাছ থেকে দেখার কারণে ১৫ আগস্টের ঘটনা হয়তো আমার কাছে এতটাই স্পষ্ট হয়ে আছে।
Advertisement
আমাদের বাসায় তখন একটা ‘ লাল ফোন’ ছিল, যেটা দিয়ে শুধু দেশের হাই প্রোফাইল ব্যক্তিদের সাথে কথা বলা যেতো। সেটার নাম্বার ছিল তিন ডিজিটের। সেই ফোনটা সকাল ১১ টার দিকে বেজে উঠলো। ঐ পাশ থেকে একজন আব্বাকে বললো রেডি হয়ে নিতে, কারণ আব্বাকে নেয়ার জন্য গাড়ি পাঠানো হয়েছে।
এই কথা শুনে আম্মার অবস্থা হল শোচনীয়। ততক্ষণে আমরা জেনে গেছি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর আশেপাশে যারা ছিল তাঁদেরও এক এক করে হত্যা করা হয়েছে। আম্মা চিৎকার করে আব্বাকে বলতে থাকলো, “ ওরা তোমাকেও মেরে ফেলবে ওরা জানে তুমি বঙ্গবন্ধুর লোক। তুমি যেও না রঞ্জনার আব্বা”।
সেদিন বঙ্গভবনে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে দেখা গিয়েছিল, যারা এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতো। ছিল খন্দকার মুশতাক ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারী সেনাবাহিনীর কিছু পথভ্রষ্ট কর্মকর্তাও সেখানে ছিল। কিন্তু হত্যা করার পর তারা অনেকেই ছিল বিভ্রান্ত ও খানিকটা ভীত। আব্বার ইচ্ছা ছিল একটা বই লিখবেন ইতিহাসের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে। কিন্তু সেই অবসর পায়নি মানুষটা। তবে এটা ঠিক ১৬ আগস্ট থেকে সবকিছু চালিত হয়েছে বঙ্গভবন থেকে।
যেখান থেকে ফোন এসেছে, সেখানে না গিয়েতো কোনো উপায় নেই। আব্বা রেডি হয়ে নিলেন। বেলা ১২ টার দিকে সেনাবাহিনীর একটি জিপ এসে আব্বাকে নিয়ে গেল। সারা কলোনির মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ল সেই দৃশ্য দেখার জন্য। চরম একটা অনিশ্চিত ও ভীতিজনক অবস্থা।
এরপর প্রায় দেড়দিন চলে গেল, আব্বার কোনো খবর পেলাম না। আম্মা কাঁদতে কাঁদতে পাগল হওয়ার অবস্থা। ছোটভাইয়ের বয়স ১ বছর, ওর দিকেও আম্মার চোখ নেই, বাসায় রান্নাবান্না বন্ধ। ভয়ে অনেক আত্মীয় স্বজন খোঁজ খবরও নিচ্ছেন না। আমরা ধরেই নিলাম ওরা হয়তো আব্বাকে মেরেই ফেলবে।
ঠিক এরকম একটি অবস্থায় প্রথম দিনটি চলে গেল। ১৬ আগস্ট সকালবেলায় দেখলাম কতিপয় প্রতিবেশির উত্তেজনা। আমাদের বিল্ডিং এর নিচতলায় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের একজন নেতা থাকতেন, উনি মিষ্টি বিতরণ করছেন। অনেকেই হাসিহাসি মুখে সেই মিষ্টি খাচ্ছেন। সেসময় জাসদের পত্রিকা ’গণকণ্ঠ ‘এর একজন সাংবাদিক থাকতেন কলোনিতে। উনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে মুজিবকে বংশশুদ্ধ হত্যা করার কাজটি কত ভাল হয়েছে, সে বিষয়ে উঁচু গলায় বক্তৃতা দিচ্ছে। আর অন্যরা এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানারকম টিপ্পনী কাটছে। ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভঙ্গিতে বলতে থাকেন ''মুজিবের বংশ শেষ। সেখানে সবাই মারা গেছে। ৩২ নং এর ভেতরে কেউ আর জীবিত নেই।”
বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর পর আব্বা বলেছিলেন, জানিস অনেকে কিছু একটা করার জন্য ছটফট করেছেন। সবাই হয়তো মনে মনে জানতে চেয়েছেন তারা কী করবেন, কোথায় যাবেন, সে কথা। কিন্তু কে তাদের কিছু জানাবে? সবাই তো ঘটনার আকস্মিকতায় বিস্ময়-বিমূঢ়। বঙ্গবন্ধুকে কেউ মেরে ফেলতে পারে সেটা যেমন ছিল অকল্পনীয়, তেমনি তাকে হত্যা করার পর কে কী করবে এটাও বুঝতে পারছিলেন না কেউ। সারা রাস্তায় ট্যাংক ও সামরিক বাহিনীর টহল দেখে সবাই ভয় পেয়েছিল।
আমি ছোট মানুষ হলেও আগ্রহ ছিল মনে। একা একাই কলোনিতে ঘুরে বেড়াতাম। যেহেতু আমাদের বাসাটা ছিল মিরপুর রোডের পাশে, তাই ফায়ার ব্রিগেডের কোনায় এসে দাঁড়ালেই অনেককিছু দেখা যেতো। কয়েকটা জায়গায় ব্যারিকেড দিয়ে মানুষের চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল কালো পোশাক পরা সামরিক লোকজন। তবে আব্বা যে বলেছিল দেখিস অসংখ্য মানুষ রাস্তায় নেমে আসবেন, কিন্তু তেমন কিছু না দেখে খুবই হতাশ হয়েছিলাম।
সকালে আব্বা যে প্রতিবাদ মিছিলের কথা বলেছিলেন, কই সেরকমতো কিছু দেখলাম না। কিছু মানুষ ছাড়া অন্য লোকগুলো মনে হলো মৃত মানুষের মতো হাঁটছিল। আমি ছোট মানুষ কিন্তু বারবার মনে হয়েছিল বঙ্গবন্ধু এত বড় নেতা, আমাদের জাতির পিতা কিন্তু তাকে নৃশংসভাবে হত্যার পর মানুষ এত চুপ কেন? আর এই লোকগুলোইবা এত খুশি কেন?
আমার আব্বা সেইসময় তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা ছিলেন। তাই সব পত্রিকা আমাদের বাসায় আসতো। যে পত্রিকাগুলোতে সবসময় বঙ্গবন্ধুর কথা থাকতো, আওয়ামী লীগের কথা লিখতো, সেই পত্রিকাগুলো খুব অপরিচিত হয়ে গেছিল। ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি কেউ লিখেনি। তখনও ভেবেছি, এখনও ভাবি, যে মানুষটি এই দেশকে স্বাধীন করলেন, তাঁকে এইভাবে কেন মারা হল?
তারপর এই হত্যাকাণ্ড উপলক্ষে মিষ্টিও খেয়েছে মানুষ? এরকম একটি নির্মম হত্যাযজ্ঞকে কেন এবং কারা সমর্থন করছে? কেন ওনাকে নির্বংশ করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, কারা করেছিল- সেই ইতিহাস আমি এখন জানি। কিন্তু এরপরও যতবার ১৫ আগস্ট আসে, ততবার সবকিছু ছাপিয়ে শুধু ঐ মিষ্টি খাওয়ার দৃশ্যটিই আমার চোখে ভেসে ওঠে ।
১৭ আগস্ট দুপুরে সেই লাল টেলিফোন আবার বেজে উঠলো । ঐ পাশে ভেসে এল আব্বার কণ্ঠস্বর। সবাই আশ্বস্ত হলাম যে যাক ওরা আব্বাকে মেরে ফেলেনি। আম্মার যে চোখের পানি শুকিয়ে গিয়েছিল, তা আবার ধারার মত নামতে শুরু করলো। আম্মা শুধু বলতে থাকলেন,“তুমি কি খাইছো ? ওরা তোমাকে মারে নাইতো ? তুমি কখন আসবা?” আব্বা জানালেন যে উনি বঙ্গভবনে আছেন এবং ভাত খেয়েছেন।
আব্বা আমাদের চিন্তা করতে মানা করলেন। বললেন, কাজ শেষ হলে ওরাই বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাবে। ঐদিন রাত ১১ টা/ ১২ টার দিকে আব্বা বাসায় ফিরে এলেন। কিন্ত আব্বার সেই বিধ্বস্ত, ক্লান্ত, অসহায় আর বিষণ্ণ চেহারাটা আমি কোনোদিন ভুলবোনা। মনে হলো তাকে কেউ প্রচণ্ডরকম অত্যাচার বা নিপীড়ন করেছে। হ্যাঁ আসলেই নিপীড়ন করেছিল, সেটা ছিল মানসিক নিপীড়ন।
আব্বা পরে বলেছিলেন সেদিন বঙ্গভবনে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকে দেখা গিয়েছিল, যারা এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতো। ছিল খন্দকার মুশতাক ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকারী সেনাবাহিনীর কিছু পথভ্রষ্ট কর্মকর্তাও সেখানে ছিল। কিন্তু হত্যা করার পর তারা অনেকেই ছিল বিভ্রান্ত ও খানিকটা ভীত। আব্বার ইচ্ছা ছিল একটা বই লিখবেন ইতিহাসের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হিসেবে। কিন্তু সেই অবসর পায়নি মানুষটা। তবে এটা ঠিক ১৬ আগস্ট থেকে সবকিছু চালিত হয়েছে বঙ্গভবন থেকে।
ইতিহাসে কালো অধ্যায় একবার যোগ হলে, তা বারবার ফিরে আসে। সেদিন সামরিক বাহিনীর সেই কুৎসিত কাজকে যারা সমর্থন করেছিল, তারা নিজেরাই একদিন সেই কুৎসিত কাজের বলি হয়েছিল। বারবার সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে দেশ ও দেশের মানুষ।
লেখক: যোগাযোগকর্মী।
এইচআর/জেআইএম