রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকে ব্যাপক ঋণ জালিয়াতি সংঘটিত হয় ২০১০ থেকে। জালিয়াতির খবর প্রথম প্রকাশ পায় ২০১২ সালে। ওই সময় হলমার্কসহ পাঁচ প্রতিষ্ঠান ব্যাংকটির তৎকালীন রূপসী বাংলা (হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল) শাখা থেকে ঋণের নামে হাতিয়ে নেয় তিন হাজার ৬০৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। দেশের বহুল আলোচিত সেই ঋণ কেলেঙ্কারির ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাংকটি। তবে আশার কথা, যে শাখা থেকে ঋণ নিয়েছিল সেটি লাভে ফিরেছে।
Advertisement
ঋণের নামে সেসময় হাজার হাজার কোটি টাকা তছরুপ করায় পরবর্তীসময়ে সংকটে পড়ে ব্যাংকটি। সুদ-আসল মিলে হলমার্কের ঋণ এখনো ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রতিষ্ঠানটির যে অ্যাসেট রয়েছে তা বিক্রি করলে আসতে পারে এর এক-চতুর্থাংশ। তবে সুদ বাদ দিলে হলমার্কের সম্পদ দিয়ে পুরো টাকাই আসবে- এমনটা বলছে সোনালী ব্যাংক। সুদসহ ধরলে সব সম্পদ বিক্রি করেও আদায় হবে না।
ব্যাংকখাত বিশ্লেষকরা বলছেন, যেহেতু সব টাকা আদায় হচ্ছে না সেক্ষেত্রে সুদ মওকুফ করে যদি আসল আদায় হয় তবে তাই করা উচিত। একই সঙ্গে ওই ঋণ থেকে শিক্ষা নিয়ে যাচাই-বাছাই ছাড়া কোনো ঋণ না দেওয়ারও পরামর্শ তাদের।
আরও পড়ুন>> হলমার্ক কেলেঙ্কারি : কেটে নেয়া অর্থ ফেরত পাবে না সোনালী ব্যাংক
Advertisement
সোনালী ব্যাংকের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ব্যাংকটি জানিয়েছিল, এ জালিয়াতি ব্যাংকটির অগ্রগতি থামিয়ে দিতে পারেনি। এটি ব্যাংকের জন্য একটি বড় ধরনের ধাক্কা ও শিক্ষা ছিল, যা পরে সোনালী ব্যাংককে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করে। তবে হলমার্ক কেলেঙ্কারির পর ব্যাংকটির আইনি কাঠামো জোরালো হয়েছে। পরবর্তীসময়ে এমন ঘটনা ব্যাংকটিতে আর ঘটেনি।
সূত্রমতে, আলোচিত হলমার্কের যে পরিমাণ ঋণ সুদ-আসল মিলে দাঁড়িয়েছে তা ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ যা আছে তা দিয়ে পুরো ঋণ পরিশোধ হবে না। বর্তমান ভ্যালু ধরলেও আসল টাকা তুলতেই টানাপোড়েন হবে। এর মধ্যে রয়েছে নানাবিধ চাপ। তবে অজানা চাপ থাকায় ঠিকমতো কাজও করতে পারছে না ব্যাংকটি। যে কারণে এ ঋণ আদায় সম্ভব হচ্ছে না। কাজ করতে গেলেও নানা বাধা আসে, যা শেষমেশ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এতে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে, অর্থ খরচ হচ্ছে কাজের কাজ হচ্ছে না। এ নিয়ে ক্ষোভও রয়েছে ব্যাংকটির একাধিক কর্মকর্তার। যদিও ওই ঋণের পেছনে ব্যাংকটির বেশকিছু কর্মকর্তাও জড়িত ছিলেন।
যখন কোনো ঋণ দেয় তখন সেটা যাচাই-বাছাই করতে হবে ভালো করে। অনেক ক্ষেত্রে দেখে-শুনে ঋণ দেওয়া হয় না। আমি সোনালী ব্যাংকের বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকতে এ ধরনের ঘটনা এসেছিল আমি সেখানে কোনো ঋণ দেইনি। এটা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়, তা সত্ত্বেও আমি ঋণ দিতে সম্মত হইনি।–মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
অনুসন্ধানে জানা যায়, হলমার্কের জমি ছাড়া তেমন কিছুই নেই। কারখানার মেশিনগুলো ছিল, এখন নষ্ট হয়ে গেছে। একটা স্পিনিং মিলের মেশিন আছে যেটা ৭০ কোটি টাকা দাম। তাদের ৩৫টি কারখানা। হলমার্কের এমডি এখনো কারাগারে, এমডির জামিন হলেও কাজ সহজ হয়ে আসতো। তবে জেলা প্রশাসক ও কানুনগো নিয়োগ করে সব সম্পত্তি যাচাই-বাছাই সম্পন্ন করেছে সোনালী ব্যাংক। সম্পত্তিও নিজেদের আয়ত্তে নিয়েছে।
Advertisement
আরও পড়ুন>> হল-মার্কের চেয়ারম্যান জেসমিনের ৩ বছর কারাদণ্ড
ব্যাংকটির একাধিক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘হলমার্কের ঋণ ২০১২ সালের সৃষ্টি। সেই সময়ের দাম ধরলে তো আর আসল উঠবে না। সেই ভ্যালু ধরলে কাভার করবে না। তবে আজকের ভ্যালু, আজকের বাজার ধরলে এটা দিয়ে শুধু আসল টাকা উঠে আসবে। সাভারের মতো জায়গায় যেসব জমি আছে সেটা ২০১২ সালে খুব বেশি দাম ছিল না। আজ সেসব জমির মূল্য অনেক। আমরা কোর্টে মামলা করেছি, সেখানে তো সুদ আরোপের কথা বলেই দিয়েছে। মামলায় রায় দিয়েই ১২ শতাংশ সুদ আরোপের কথা বলা আছে। এটা আদায় পর্যন্ত, অর্থাৎ যেদিন আদায় হবে সেদিনও ১২ শতাংশ সুদ দিতে হবে। যদি সুদ ও আসল ধরা যায় তাহলে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদে কাভার করবে না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, হলমার্কের কাছে সোনালী ব্যাংকের বর্তমানে আসল পাওনা দুই হাজার ৫১৩ কোটি টাকা। ঋণ ২০১২ সালে সৃষ্টি, এখন ২০২৩ সাল চলে। সে হিসাবে ১০ বছরে দুবার দ্বিগুণ হবে। সুদ ও আসল মিলে ১০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি হবে পাওনা। কিন্তু সেটি নন ফান্ডেড দায়, সেক্ষেত্রে সুদ আরোপের সুযোগ নেই। ব্যাংকটির রিকভারি বিভাগের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের অ্যাকাউন্ট ডেবিট করে হলমার্কের এলসি বিভিন্ন ব্যাংকে পেমেন্ট দিয়েছে, যেটা ৮শ কোটি টাকার মতো। সে টাকা আদায়ে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধেও মামলা করেছি ব্যাংকের পক্ষ থেকে। অন্য ব্যাংক, যা থেকে পেমেন্ট দিয়েছে সেই পার্টি, হলমার্ক এবং যারা এলসি করেছিল তাদের সবার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কেন পেমেন্ট দিলো এজন্য তাদেরও বিবাদী করা হয়েছে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সব পেমেন্ট দেয়নি।’
আরও পড়ুন>> কেলেঙ্কারির ভারে ডুবছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক
লোন বিভাগের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের টোটাল ১৮০৩টি পেমেন্ট বিল দেওয়ার কথা ছিল। যার মধ্যে ১৪২৩টি বিলের পেমেন্ট দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেক্ষেত্রে সব পেমেন্টে বিল হবে এক হাজার ৫২ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক ৮শ কোটি টাকা পেমেন্ট দিলেও ২৫০ কোটি টাকার পেমেন্ট দিতে পারেনি মামলার কারণে। ওইটাতো ফান্ডেড দেয়নি, সেটার সুদ আরোপ করা যাবে না।’
এ নিয়ে কথা হয় ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিমের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা হলমার্ক নিয়ে কাজ করছি। চেষ্টা করছি ভালো কিছুর। আশা করছি সামনে ভালো একটা রেজাল্ট আসবে। তাছাড়া ওই শাখাটি ভালো অবস্থানে এসেছে।’
‘আমরা হলমার্ক নিয়ে কাজ করছি। চেষ্টা করছি ভালো কিছুর। আশা করছি সামনে ভালো একটা রেজাল্ট আসবে। তাছাড়া ওই শাখাটি ভালো অবস্থানে এসেছে।-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সোনালী ব্যাংক
দীর্ঘদিন ধরে লোকসানি শাখা হিসেবে ছিল রূপসী বাংলা (হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল) শাখাটি। তবে আশার দিক হলো আলোচিত সেই শাখা যেখানে হলমার্কসহ পাঁচ প্রতিষ্ঠানের ঋণে অনিয়ম হয় সেটি এখন লাভের মুখ দেখছে। শাখায় নতুন করে আনিসুজ্জামান আনিস নামে একজন ডিজিএমকে বসানো হয়েছে। দায়িত্ব পাওয়ার পরই তিনি শাখাকটি নার্সিং করছেন লোকসান থেকে ফিরিয়ে আনতে। সবশেষ গত জুলাই শেষে ৪১ কোটি টাকা লাভ করেছে এ শাখা। ডিজিএম আনিসুজ্জামান এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
হলমার্কের ঋণ নিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং সোনালী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন দেখতে হবে ব্যাংকঋণ আইনে কী প্রভিশন আছে। এখানে তাদের কোনো সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার মতো কিছু আছে কি না সেটা দেখতে হবে। সম্ভব হলে তাই করতে হবে। এসবেও যদি না আসে তাহলে শেষ অপশন হলো সুদ মওকুফ করে দেওয়া। কোনো ঋণ ঝুলিয়ে রেখে লাভ নেই।’
তিনি বলেন, ‘যখন কোনো ঋণ দেয় তখন সেটাকে যাচাই-বাছাই করতে হবে ভালো করে। অনেক ক্ষেত্রে দেখে-শুনে ঋণ দেওয়া হয় না। আমি সোনালী ব্যাংকের বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকতে এ ধরনের ঘটনা এসেছিল আমি সেখানে কোনো ঋণ দেইনি। এটা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়, তা সত্ত্বেও আমি ঋণ দিতে সম্মত হইনি।’
ইএআর/এএসএ/জিকেএস