অর্থনীতি

ক্ষতির মুখে পড়ার আশঙ্কায় রপ্তানিখাত

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল। সংবিধান মেনে চলতি বছরের ডিসেম্বর কিংবা আগামী বছরের (২০২৪ সালের) জানুয়ারিতে নির্বাচন করতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অনড় বিএনপি। নিজেদের দাবি আদায়ে সভা-সমাবেশ, বাগযুদ্ধ চললেও সংকট নিরসনে সংলাপ বা রাজনৈতিক সমাধানের পথ আপাতত ক্ষীণ। বর্তমান অবস্থায় ছাড় দিতে নারাজ দুই পক্ষই। এমন পটভূমিতে প্রকট হচ্ছে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা।

Advertisement

করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ধুঁকছে দেশের রপ্তানিখাত। এর সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন রপ্তানিকারকরা, আন্তর্জাতিক বাজার হারাবে অনেক পণ্য। এমনটাই আশঙ্কা ব্যবসায়ীদের।

 

একেতে করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ধুঁকছে রপ্তানিখাত। এর সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন রপ্তানিকারকরা, আন্তর্জাতিক বাজার হারাবে অনেক পণ্য।

 

আরও পড়ুন: বড় অর্থনীতির দেশগুলোতে কমেছে রপ্তানি 

Advertisement

এ থেকে উত্তরণে উভয়পক্ষকে কিছুটা ছাড় দিয়ে সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের পথ বের করার আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, সমাধান না হলে যে কোনো উদ্ভূত পরিস্থিতির দায় নিতে হবে রাজনীতিবিদদের। নির্বাচন কেন্দ্র করে ঘোলাটে রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রভাব এখনো সেভাবে না পড়লেও শিগগির তা পড়তে পারে। এতে পণ্য রপ্তানি, কাঁচামাল আমদানি হবে বাধাগ্রস্ত। ফলে দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পড়বে রপ্তানিখাত।

জানতে চাইলে চারকোল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্যানেসিয়া ভেঞ্চারসের স্বত্বাধিকারী আবুল কালাম জাগো নিউজকে বলেন, গত বছর আমাদের প্রবৃদ্ধি ভালো ছিল। এই খাতের সবাই কম-বেশি ভালো করেছে। তবে জুলাই মাসে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আমাদের প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

আরও পড়ুন: ভারত সরকার বাংলাদেশের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকবে বলেই বিশ্বাস 

তিনি বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে রপ্তানিপণ্য পাঠানো কঠিন হয়ে যাবে। একই সঙ্গে কাঁচামাল আমদানিও যাবে বন্ধ হয়ে। তখন আসলে ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। রাজনৈতিক সংকট বাড়লে তখন দেখা যাবে শিপমেন্টে দেরি হবে। ক্রেতারা অন্য জায়গা থেকে পণ্য কেনা শুরু করবে। এমন হলে আমাদের এই বাজারটা অন্যদিকে চলে যাবে।

Advertisement

আবুল কালাম আরও বলেন, ২০২১-২২ অর্থবছরে আট হাজার মেট্রিক টন চারকোল রপ্তানি হয়। বিগত অর্থবছরে (২০২২-২৩) তা বেড়ে ১৩ থেকে ১৪ হাজার মেট্রিক টন হয়েছে। এবার প্রায় দেড়শ কোটি টাকার চারকোল রপ্তানি হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘমেয়াদি হলে রপ্তানি কমে যাবে।

আরও পড়ুন: ‘হাসিনা সরকারের পতন ঘটলেও বিএনপি ক্ষমতায় আসবে না’ 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট মন্দা ও ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতির কারণে তৈরি পোশাকের অর্ডার অনেক কমেছে বলে জানিয়েছেন ফতুল্লা অ্যাপারেলসের স্বত্বাধিকারী ফজলে শামীম এহসান।

 

নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই ঘোলাটে হচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গন। অর্থনীতিতে এর প্রভাব এখনো না পড়লেও শিগগির তা পড়বে। পণ্য রপ্তানি, কাঁচামাল আমদানি বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পড়বে রপ্তানিখাত।

 

জাগো নিউজকে তিনি বলেন, বর্তমান অবস্থার মধ্যে থাকলে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। এর সঙ্গে যদি দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা যোগ হয় তাহলে উদ্যোক্তারা বড় বিপদে পড়বেন।

তিনি বলেন, বৈশ্বিক অর্থনীতি যদি ভালো হয় তাহলে আমরা টিকে যাবো। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে দেখা যাবে, আমাদের হাতে অর্ডার আছে কিন্তু কাজ করতে পারছি না।

আরও পড়ুন: মার্কিন ভিসানীতি পোশাক রপ্তানিতে প্রভাব ফেলবে না 

দেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই আসে তৈরি পোশাক খাতের হাত ধরে। এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েক বছর ধরে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকার সুবাদেই রপ্তানি ও অর্থনীতি বিকশিত হচ্ছে।

তবে, সব জাতীয় নির্বাচনের সময় পোশাক রপ্তানিকারকদের কার্যাদেশ কমে যায় বলে জানিয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। তারা বলেন, গোলযোগের আশঙ্কা থেকে অনেক বায়ার নিজেদের সরবরাহ চক্র সুরক্ষিত রাখতে ভিন্ন দেশমুখী (বাংলাদেশ ছাড়া অন্য দেশ) হচ্ছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৈরি পোশাকখাতের এক ব্যবসায়ী জানান, বর্তমানে অধিকাংশ কারখানা অর্ধেক সক্ষমতায় পরিচালিত হচ্ছে। গ্যাস-বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন পরিষেবার মূল্যবৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। পাশাপাশি আমলানির্ভরতা বাড়ায় ব্যবসায়ীদের হয়রানি এখন চরমে।

আরও পড়ুন: ‘সরকারের পতনের কোনো সম্ভাবনা নেই’ 

এ ব্যবসায়ীর মতে, রাজনৈতিক সংকট শুধু ক্ষতিই করে না, কখনো কখনো তা শাপেবর হয়েও আসে। তিনি বলেন, ‘পলিটিক্যাল আনরেস্ট (রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা) অনেক সময় বিজনেস বুমের (ব্যবসার প্রসার) দিকে যায়। যখন এরশাদবিরোধী আন্দোলন হয়েছে, তখন সাময়িক ৩০ থেকে ৩৫ দিন ব্যবসার ক্ষতি হয়েছে। তার পরে ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় প্রসার হয়েছে। সেটা ১৯৯০ সালের পরে দেখা যায়। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পরে গণতান্ত্রিক সরকার এলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা উঠে (কমে) যায়। এখন ওভার পাওয়ারড (অতিরিক্ত ক্ষমতাশালী) আমলাতন্ত্রের জন্য ব্যবসা করতে পারছি না। কাস্টমস হয়রানি চরমে। নির্বাচনের পর গণতান্ত্রিকভাবে নতুন সরকার এলে তা ব্যবসাবান্ধব হয়। এতে লাভবান হন ব্যবসায়ীরাই।’

পণ্য ও সেবা মিলিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ৫৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও গত অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানির আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নির্ধারণ করেছ সরকার। এর মধ্যে পণ্য খাতে ৬২ বিলিয়ন এবং সেবা খাতে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, রাজনৈতিক সংকট থাকলে চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন দূরে থাক, প্রবৃদ্ধি করাও দুষ্কর হয়ে পড়বে।

আরও পড়ুন: যুক্তরাজ্য-কানাডায় পোশাক রপ্তানি বেড়েছে, কমেছে যুক্তরাষ্ট্রে 

এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান সভাপতি এবং বেঙ্গল গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, রপ্তানিখাত কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত করা উচিত হবে না। দল-মত নির্বিশেষে সবার জন্য সবকিছুর বাইরে রাখতে হবে শিল্পকে।

 

বর্তমানে অধিকাংশ কারখানা অর্ধেক সক্ষমতায় পরিচালিত হচ্ছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সহ বিভিন্ন পরিষেবার মূল্যবৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। পাশাপাশি আমলানির্ভরতা বাড়ায় ব্যবসায়ীদের হয়রানি এখন চরমে।

 

তিনি বলেন, বৈশ্বিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের এলসি লিমিটেশন (ঋণপত্রে সীমাবদ্ধতা) আছে, পণ্যের দাম বেশি, মূল্যস্ফীতি আছে। এছাড়া খাত সংশ্লিষ্ট চ্যালেঞ্জ, ব্যবসায়িক চ্যালেঞ্জ, প্রতিযোগী দেশের চ্যালেঞ্জ আছে। এসবের মধ্যে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশের স্বার্থে শিল্পকে প্রাধান্য দিতে হবে।

বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ইএবি) সভাপতি এবং এনভয় গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালাম মুর্শেদী জাগো নিউজকে বলেন, রাজনীতি ও রপ্তানি এক নয়। রাজনীতির সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ক নেই। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ যাই হোক, এতে যেন রপ্তানিখাত বাধাগ্রস্ত না হয়।

এসএম/কেএসআর/এএসএ/জিকেএস