কৃষি ও প্রকৃতি

বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব পাটের ভিত গড়েছেন বঙ্গবন্ধু

রত্না খাতুন

Advertisement

পাট একটি বৃষ্টিনির্ভর ফসল, যা বাংলাদেশের বহুলাংশে জন্মে। পাট ‘গোল্ডেন ফাইবার’ নামেও পরিচিত। পাট মানুষ ও প্রকৃতি উভয়ের জন্যই উপকারী। এক সময় পাট ছিল বাংলার প্রধানতম অর্থকরী ফসল। কৃত্রিম আঁশ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববাজারে পাটের ছিল আকাশচুম্বী চাহিদা। বাংলাদেশে উৎপন্ন হতো সবচেয়ে উৎকৃষ্টমানের পাট। সে সময় পাটবস্ত্রকে বলা হতো পট্টবস্ত্র। ১৮৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘রয়্যাল কমিশন অব এগ্রিকালচার’র সুপারিশক্রমে বেঙ্গল ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারে ‘তন্তু শাখা’ চালু করা হয়। ১৯০৪ সালে আর এস ফিনোলের নেতৃত্বে অল্প পরিসরে গবেষণা কাজ শুরু হয়। ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশ ভারতে গঠন করা হয় ‘ইনডিয়ান সেন্ট্রাল জুট কমিটি’। এর আওতায় ঢাকায় ‘জুট এগ্রিকালচারাল রিসার্চ’ ল্যাবরেটরি চালু করা হয়।

১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির পর পাট সংশ্লিষ্ট গবেষণার সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ গবেষক ভারতে চলে যান। ফলস্বরূপ পাট নিয়ে গবেষণা একেবারে স্থবির হয়ে পড়ে। এরপর বিট্রিশদের আদলে ১৯৫১ সালে ‘পাকিস্তান সেন্ট্রাল জুট কমিটি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। অত্যন্ত সীমিত আকারে পাট নিয়ে পুনরায় গবেষণা শুরু হয়। স্বতন্ত্র কোনো পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটও সে সময় এদেশে গড়ে ওঠেনি। সাময়িক ও স্বল্পমেয়াদী ব্যবস্থাপনায় ঢিমেতালে চলে এদেশের পাট তন্তু নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম। এমনকি আমাদের পূর্বপাকিস্তান পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার ন্যায্য অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়।

পাটের গুরুত্ব বিবেচনা করে ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণার ৫(ঘ) ক্রমিকে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় পাটের প্রসঙ্গটি অর্থ-রাজনৈতিক ব্যাখ্যাসহ উল্লেখ করেন। পাট নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের অনিয়ম এবং পাটের গুরুত্ব তুলে ধরতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে বেতার ও টিভিতে প্রদত্ত ভাষণে বলেন, ‘এ যাবৎ বাংলার আঁশ পাটের প্রতি ক্ষমাহীন অবজ্ঞা প্রর্দশন করা হয়েছে। বৈষম্যমূলক বিনিয়োগ হার এবং পরগাছা ফড়িয়া-ব্যাপারীরা পাট চাষিদের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত করেছে। পাটের মান, উৎপাদনের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। পাট ব্যবসা জাতীয়করণ, পাটের গবেষণার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ এবং পাট উৎপাদনের হার বৃদ্ধি করা হলে জাতীয় অর্থনীতিতে পাট সম্পদ সঠিক ভূমিকা পালন করতে পারে।’

Advertisement

আরও পড়ুন: সোনালি আঁশকে ঘিরে স্বপ্ন দেখছেন চাষিরা

বঙ্গবন্ধু, পাট ও বাংলাদেশ একই বৃন্তে তিনটি ফুল। স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু সরকার সুপরিকল্পিত উপায়ে পাট খাতে গতিশীলতা সৃষ্টির জন্য একাধিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু বৃহৎ আঙ্গিকে জাতীয় পর্যায়ে পাট নিয়ে গবেষণা পরিচালনার জন্য স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করেন। পাট উৎপাদন যেন বিঘ্নিত না হয় সেজন্য ‘পাট পরিদপ্তর’ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের সূচনা করেন। ফলশ্রুতিতে বৃহত্তর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও জনবলের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং বেগবান হয় পাট নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম। পাটের নতুন নতুন জাত ও এর উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং পাটের বহুমুখী ব্যবহার করে নানা রকম পাটপণ্য তৈরি করার কর্মকাণ্ডে অভূতপূর্ব সাফল্য আসে। বঙ্গবন্ধু সরকার পাটের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও নীতি নির্ধারণসহ পাট খাতে প্রকৃত গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে আরও প্রতিষ্ঠা করেন ‘পাট মন্ত্রণালয় এবং জুট ডিরেক্টটরেট’। পাট নিয়ে গবেষণার অগ্রাধিকার নির্ধারণ, দেশের পাট গবেষণা কার্যক্রম মূল্যায়ন এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরি করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি পাটের উন্নত জাত ও অন্য টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য বৃহত্তর আঙ্গিকে পরমাণু শক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য আনবিক শক্তি কমিশনে ‘পরমাণু কৃষি গবেষণা কেন্দ্র’ চালু করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের পাট, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

পাটের জন্য কম পরিমাণে সার ও কীটনাশকের প্রয়োজন। পাট ফসল মাটির উর্বরতা বাড়াতে সাহায্য করে। কারণ এর পাতা ও শিকড়ের অবশিষ্টাংশ সার হিসেবে কাজ করে। পাট উৎপাদনে ব্যবহৃত পদ্ধতি এবং এর উপজাতগুলো খুবই পরিবেশবান্ধব ও সহজলভ্য। কম প্রসারণযোগ্যতা (মাটিতে বায়ু চলাচলে সুবিধা) এবং ভালো শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্ষমতার মতো ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের কারণে পাটের পরিশেগত সুবিধা অনেক। গবেষণা অনুসারে, এক হেক্টর পাট গাছ ১৫ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে। প্রায় ১০০ দিনের একটি মৌসুমে ১১ টন অক্সিজেন নির্গত করে।

নিষিদ্ধ প্ল্যাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার পাটজাত পণ্যের জনপ্রিয়তাকে প্রভাবিত করেছে। পলিথিন বেশি জনপ্রিয় হওয়ার প্রধান কারণ উৎপাদন খরচ কম। পলিথিন পরিবেশের ক্ষতি করে। এটি মাটিতে পচনশীল নয়। ফলে এটি মাটির উর্বরতা নষ্ট করে। পলিথিন উৎপাদনের সময় বায়ুমণ্ডলে বিপুল পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। সিন্থেটিক পণ্য পানির প্রবাহকে বাধা দেয়। ফলে বন্যা ও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এটি প্রচুর পরিমাণে অক্ষয়যোগ্য বর্জ্যও তৈরি করে, যা আমাদের জন্য একটি বিশাল সমস্যা।

Advertisement

আরও পড়ুন: মানব চিকিৎসায় পাটের ব্যবহার

অপরদিকে দ্রুত পচনশীলতা পাটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এটি দূষিত পরিবেশের জন্য একটি আশির্বাদ। পাটজাত দ্রব্য পরিবেশদূষণ কমাতে সাহায্য করে। এর ব্যবহার প্ল্যাস্টিকের ব্যাগের চাহিদা হ্রাস করে। প্ল্যাস্টিকের ব্যাগের তুলনায় পাটের ব্যাগ বেশি উপকারী। কারণ বারবার ব্যবহার করা যায়।

পেট্রোল একটি প্রাকৃতিক সম্পদ, যা প্রকৃতিতে সীমিত। প্ল্যাস্টিক এবং পলিব্যাগ পেট্রোলিয়াম পণ্য থেকে তৈরি করা হয়। ফলে আমাদের সীমিত পেট্রোলিয়াম রিজার্ভের ওপর অনেক চাপ পড়ে। পলিথিনের বিকল্প আমাদের পাটপণ্য ‘সোনালি ব্যাগ’ ব্যবহার এই বোঝা লাঘব করতে পারে।

অন্য ফসলের সঙ্গে শস্য পর্যায়ে পাট চাষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একই জমিতে বারবার ধান ও গমের আবাদ করা হলে পরিবেশগত সমস্যা তৈরি হয়। কারণ ধান ও গমের শিকড় মাটির ৩-৪ ইঞ্চির বেশি গভীরে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে মাটির উপরের স্তরের খাদ্য উপাদান নিঃশেষিত হয়ে যায়। কিন্তু পাটের শিকড় মাটির ১০-১২ ইঞ্চি প্রবেশ করতে পারে, যা মাটির তলার শক্ত আস্তরণ ভেঙে ফেলে এবং নিচের স্তর থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। তাই ধান, গম এবং অন্য ফসলের আবাদ টিকিয়ে রাখতে শস্য পর্যায়ে পাট চাষ করতে হবে। পাটের পাতায় থাকা ভিটামিন এ, বি, ই, সি এবং ধাতব উপাদান ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং মুখের ঘা দূর করতে সাহায্য করে। এছাড়া পাট পাতা থেকে তৈরি পানীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যানসার এবং স্নায়ুরোগের চিকিৎসায় মহৌষধ হিসেবে কাজ করে চুকুর (মেস্তা)। এছাড়া মেস্তার পাতা ও ফুল জ্যাম, জেলি, আচার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়, যা বিভিন্ন দেশে অনেক জনপ্রিয়।

আরও পড়ুন: পরিবেশের ওপর পাটের প্রভাব

পাট কাগজের ব্যাগ, আসবাবপত্র ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। পাটের শুকনো কাণ্ড বিভিন্ন উপায়ে কাঠের বিকল্প হতে পারে। যেমন- জ্বালানি কাগজ ও হার্ডবোর্ডের কাচামাল। লেডিস বটুয়া, ল্যাপটপ ব্যাগ, ফ্লোর ম্যাট, অফিস ব্যাগ, টেবিল রানার, নারীদের ব্যাগ, ফ্রুট বক্স, ওয়াইন ব্যাগ, নার্সারি পট, পাট অর্নামেন্ট, পাট পর্দা, বেড শিট, শো-পিস, শপিং ব্যাগ, ক্যাপ, হ্যান্ডলুম ফেব্রিক্স সুতা বা ইয়ার্ন, জুট-জিও টেক্সটাইল, অফিস ফোল্ডার, সু তৈরিতে পাট ব্যবহার করা হচ্ছে।

পাট গাছ আমাদের পরিবেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাটবান্ধব বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বলীয়ান হয়ে জাতীয় সম্পদ বিকাশের লক্ষে পাট এবং পাটপণ্যের প্রচার ও এর ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা একটি নিখুঁত পরিবেশ ভারসাম্য বজায় রাখতে পারি।

লেখক: বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, সাইটোজেনেটিক্স শাখা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট।

এসইউ/এমএস