দেশজুড়ে

বাঁধের ভাঙন আর মেরামতের বৃত্তে তাদের জীবন

মুহুরী নদীর বাঁধ ভেঙে ফের দুর্গতিতে পড়েছেন ফেনীর ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার অর্ধলাখের বেশি বাসিন্দা। দীর্ঘ এক যুগ ধরে বাঁধ ভাঙা আর মেরামতের বৃত্তে জীবন কাটছে তাদের।

Advertisement

গত সোমবার মুহুরী নদীর ফুলগাজী উপজেলার দুই স্থানে এবং পরশুরাম উপজেলার একটি স্থানে ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। এখন পানি নামার সঙ্গে জেগে উঠছে বন্যার ক্ষতচিহ্ন।

ফেনী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তথ্য মতে, ফুলগাজী উপজেলার ১ হাজার ১৪৫টি পরিবারের ১৪ হাজার ৫০০ বাসিন্দা ও ১ হাজার ১৪৫টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ উপজেলায় ৫৫০ হেক্টর রোপা আমন, ১৫ হেক্টর সবজি, সাড়ে ৪৪ হেক্টর আয়তনের ৩৫০টি পুকুরের ২৫ মেট্রিক টন মাছ ভেসে গেছে।

আরও পড়ুন: পানি নামার সঙ্গে জেগে উঠছে ক্ষত

Advertisement

এদিকে, পরশুরাম উপজেলার ৫৫০টি পরিবারের ২৬ হাজার বাসিন্দা ও ৫৫০টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসময় ১৬৫ হেক্টর রোপা আমন, ৫ হেক্টর সবজি, ৩০টি পুকুরের প্রায় ২০ টন মাছ ও সাড়ে ৪ টন পোনা ভেসে যায়।

দুর্গতদের সহায়তায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৮ মেট্রিক টন চাল, নগদ ৫ লাখ টাকা, ১ হাজার ৬৫০ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ফুলগাজীর বিভিন্ন গ্রাম থেকে পানি নামতে শুরু করায় ক্ষত চিহ্নগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে। ভাঙনের স্থান দিয়ে অস্থায়ী বাঁশের সাঁকো তৈরি করে স্থানীয়রা কোনোরকমে পার হচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা ও ফসলি জমির ক্ষতও দৃশ্যমান হচ্ছে। মৎস্যচাষিরা তাদের ক্ষতিগ্রস্ত পুকুরগুলোর পাড় মেরামতের কাজ শুরু করেছে।

৬ বছরে ৬৭ স্থানে ভাঙনগত ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত মুহুরী-কহুয়া-সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৬৭ স্থানে ভাঙনের ঘটনা ঘটেছে। এতে গত ছয় বছরে বাঁধ সংস্কারে ১০ কোটি ২৭ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে বলে জানায় পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে স্থানীয়রা বলছেন, জলের টাকা জলেই গেছে। এতে বাঁধের ভাঙন রোধ হয়নি, স্থানীয়দের দুর্দশাও মেটেনি।

Advertisement

ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, গত ২০১৮ সালে বাঁধের সাত স্থানে ভাঙন দেখা দেয়। ওই বছর বাঁধ সংস্কারে প্রায় ২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছিল। এর পরের বছর ২০১৯ সালের বন্যায় ২২ জায়গায় বাঁধ ভেঙে যায়। সেসময় বাঁধ সংস্কারের প্রায় ১ কোটি ৭৯ কোটি টাকা ব্যয় হয়। ২০২০ সালের জুলাই মাসে বাঁধের ১৫টি স্থানে ভেঙে যায়। এতে দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁধের ৭০০ মিটার মেরামত করা হয়। ২০২১ সালের বাঁধের ৯টি স্থানে ভাঙন মেরামতের জন্য ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। ২০২২ সালের ছয় স্থানে ভাঙা বাঁধ মেরামতের জন্য ১ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। চলতি মৌসুমে বাঁধের তিনটি স্থান এখন পর্যন্ত ভেঙেছে।

আরও পড়ুন: ‘পানি না সরলে ধানের চারা পচে সর্বনাশ হয়ে যাবে’

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ঘুরেফিরে বাঁধ সংস্কারের কাজ পেয়েছে নির্দিষ্ট কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তাদের মধ্যে রয়েছে মেসার্স ফেনী ইউনাইটেড কনস্ট্রাকশন, মেসার্স কাশেম ট্রেডার্স, মেসার্স ইমেজ ইন্টারপ্রাইজ, মেসার্স শাহ সুফি এন্টারপ্রাইজ নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো।

তবে স্থানীয়রা বলছেন, বন্যা থেকে রক্ষা পেতে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করলেও তা বাসিন্দাদের কোনো কাজে আসছে না। ভাঙন কবলিত স্থানসহ নতুন নতুন জায়গায় প্রতিবছরই বাঁধ ভাঙে। প্রতিবছর এসব ভাঙন মেরামতের জন্য কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। বছর ঘুরে সে টাকা পানিতে ভেসে যায়। স্থায়ী সমাধান না করে প্রতিবছর নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় মানুষের।

ফুলগাজী উপজেলার বাসিন্দা সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলেন, একই জায়গা বারবার ভাঙে। একই জায়গার জন্য বরাদ্দও দেওয়া হয়। আবার একই ঠিকাদার কাজ পায়। বন্যা হলে কিছু অসাধু কর্মকর্তার কপাল খুলে যায়। পাউবো কর্মকর্তাদের উদাসীনতায় ঠিকাদাররা যেনতেনভাবে মেরামতের কাজ করছেন। যে কারণে একই জায়গা বারবার ভাঙছে। আর মানুষরা বারবার ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম বলেন, বেড়িবাঁধ নির্মাণের পর থেকে আশীর্বাদ নয়, প্রতি বছরই একাধিকার এই বাঁধের একাধিক স্থানে ভেঙে অভিশাপই বয়ে আনছে স্থানীয়দের জন্য। এর একটি স্থায়ী সমাধান করা হোক। ভাঙার কারণ হিসেবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদাসীনতাকে দায়ী করেন তিনি।

মুহুরী নদীতে স্থায়ী ও টেকসই বাঁধ নির্মাণ না করা পর্যন্ত এ জনপদ ক্ষতি কমার সম্ভাবনা নেই বলে মন্তব্য করেছেন ফেনী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা একরাম উদ্দিন। তিনি জানান, প্রতি বছরের বন্যার পানিতে এলাকার কয়েকশ কৃষক ক্ষতির শিকার হন। তবে এ হিসাব পরিপূর্ণ নয়। ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। তাই সঠিক ক্ষতির হিসাব রাখাটাও বেশ কষ্টসাধ্য। মুহুরী নদীর বাঁধ নিয়ে স্থানীয়দের অভিযোগের শেষ নেই।

স্থানীয়রা জানান, মুহুরী নদী শাসন, অপরিকল্পিত ও অবৈধভাবে বালি উত্তোলনের মাধ্যমে নদীর গতিপথ পরিবর্তন বন্ধসহ সিলোনিয়া, কহুয়া ও গথিয়া নদী ও খালের প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে পুনঃখনন করা সময়ের দাবি।

আরও পড়ুন: মুহুরী নদীর বাঁধ ভেঙে ২০ গ্রাম প্লাবিত, পানিবন্দি অর্ধলাখ মানুষ

স্থানীয় ইউপি সদস্য খোকন বলেন, শুধু ফসলের ক্ষতিই নয়, নদী ভাঙনের কারণে ঋণের ভারেও জর্জরিত হচ্ছেন কৃষকরা।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. রাফিউস সাজ্জাদ বলেন, নদীর নাব্যতা ও সরু হয়ে যাওয়ায় নদীতে পানির ধারণক্ষমতা কমে গেছে। ১২২ কিলোমিটার নদী খননসহ দুইপাশে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে ৭৩১ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।

বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে মুহুরী ও কহুয়া নদী রক্ষা বাঁধ ভাঙনে নিঃস্ব হচ্ছেন নদী পাড়ের বাসিন্দারা। টেকসই বাঁধ নির্মাণ তাদের দীর্ঘদিনের দাবি।

আবদুল্লাহ আল-মামুন/এমআরআর/জেআইএম