সাহিত্য

যে আকাশ শুধুই আমার

 

পর্ব তিন.(পূর্বপ্রকাশের পর)

Advertisement

মুটমুঠে অন্ধকার বিদায়ের পালা। আলোর মৃদুমন্দ আভা ছড়িয়ে পড়েছে প্রকৃতিতে। কুদ্দুস আড়মোড়া দিয়ে জাগলো। বিছানা থেকে নেমে গলা খাঁকারি দিতে দিতে কপাট খুললো। মায়ের বিছানার দিকে তাকিয়ে ডাকলো "আম্মা"!

"কিরে বাবা? আম্মায়তো হেই কোন কালেরতোন হজাগ। তুমি আল্লার নাম লইয়া অনে মছজিদো যাও।"

কুদ্দুসের হাতে হারিকেন। বাইরে পাখিদের কিচিরমিচির। ঘুমন্ত পৃথিবী জেগে উঠেছে মাত্র। কুদ্দুসের হারিকেন দিনের কর্মমুখরতার সূচনা করলো।

Advertisement

পুত্রের পেছন পেছন মরিয়মও উঠলো। মা ছেলে একই সময় ঘুম থেকে ওঠে। মরিয়ম তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করে। কুদ্দুস মসজিদের দিকে কদম রাখে।

একটু পরেই কুদ্দুসের কণ্ঠে ফজরের আজান ধ্বনিত হলো। সঙ্গে সঙ্গে পুরান বাড়ির উঠান থেকে ভেসে এলো কুকুরের নৈঃশব্দ ভেদ করা তীক্ষ্ণ চিৎকার। মরিয়ম নামাজের পাটিতে দুপা সামনে ছড়িয়ে এক পায়ের উপর আরেক পা উঠিয়ে লম্বা ঘোমটা টেনে সম্মুখে ঝুঁকে আছে। তাহাজ্জুদ শেষ। এরপর ফজরের নামাজের পালা। তার আগে খানিক বিরতিতে মরিয়ম তসবি জপছে।

চকির উপরে ইমরান ঘুমিয়ে আছে। ইমরানের যাতে ঘুম না ভাঙ্গে সেজন্য দাদির সতর্কতার শেষ নেই। তবুও আজকে তার ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ইমরানের আওয়াজ পেয়ে মরিয়ম হতবাক!

"বিবি...!"

Advertisement

ইমরান দাদিকে বিবি সম্বোধন করে। নামাজে মগ্ন থাকায় নাতির ডাকে সাড়া দিতে পারেনি।নামাজ শেষে মরিয়ম ইমরানের পাশে এসে বসে। ডান হাতে তসবি আর বাম হাতে নাতির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

"বিবি! আযান দিলে কুত্তায় ডাহে কিল¬াই?"

"বোবা জীব ভূত-প্রেত-দেও-দানোরে দেহে। আযান দিলে লোকালয় ছাইড়া দুষ্ট আত্মারা সব হলায়।"

মরিয়ম যা জানে তা দিয়েই নাতিকে কুকুরের চিৎকারের ব্যাখ্যা দেয়।

ইমরান দাদির বুকের কাছে মাথা তুলে দাদির গলা আঁকড়ে ধরে।

পাশের কক্ষ থেকে দরজা খোলার শব্দ হলো। নূরি উঠেছে। শেষরাতে আযানের ধ্বনির সাথে কুকুরের চিৎকার নিয়ে দাদি-নাতির কথোপকথন নূরি ঠিকই শুনছিল।

দরজা খুলতে খুলতে বলে,"আম্মা! এডি কি বুঝ দেন এমরানরে! বুঝি কুত্তার ডাকে দেও-দানোরা হলায়!"

নূরি মরিয়মের বুকে মাথা গুঁজে রাখা ছেলের কাছে যায়। পিঠ মুছে দেয়।

ইমরান তাড়া দেয় মাকে তাড়াতাড়ি কুকুর কেনো চিৎকার করে তা বলার জন্য। নূরি বলে,"রাইতের লম্বা নীরবতার হর আচমকা আযান দিলে মাইনষের আওয়াজ হায় দেইখ্যাকুত্তায় এরুম কুঁই কুঁই করে।"

ইমরান মায়ের কথায় আশ্বস্ত হতে পারলোনা। আবার দাদিকে জিজ্ঞেস করলো,"ও বিবি! আম্মার কতা ঠিকনি?"

ঘরের স্বল্প আলো সত্তে¡ও মা-দাদির স্মিত হাসি ইমরানের চোখ এড়ালোনা। তার এমন কৌতূহল মাখা প্রশ্নই যে তাদের হাসির উদ্রেক করেছে তা মরানের বুঝতে বাকী রইল না।

মরিয়ম নাতিকে আরো বুকে টেনে নেয়। নূরির সমর্থনে বলে,"হ দাদা! তোমার আম্মায় লেহাপড়া করছে। তোমার আম্মার কতা ঠিক।"

"না আম্মার কতা ঠিক না। আসলে কুত্তায় জ্বীন দেহে। এল্লাইগ্যা কুত্তায় ডাহে। আঁরে মতি ভাইয়ে কইছে। মতি ভাইয়ে বেলে একবার জ্বীন দেখছে।"

"থাক দাদা! জ্বীনের কতা বাদ দাও! অহন উইঠ্যা যাও। নামাজ হইড়া মছজিদো যাওন লাগবো। আইজগা না গেলে তোমার আব্বায় কইলাম চেতাচেতি করবো।"

ইমরান সকালে মসজিদে তার বাবার কাছে গ্রামের অন্য ছেলে মেয়েদের সাথে আরবি পড়ে। সে কায়দা, আলিফলাম শেষ করে কোরান শরিফ পড়া শুরু করেছে।

প্রতিদিন আরামের ঘুম বাদ দিয়ে মসজিদে যেতে ইমরানের মন টানে না। ঘুমের ঘোরে রাজ্যের আয়েশি ভাবনা এসে জড়ো হয় তার।

মরিয়ম নাতিকে আবারো সজাগ করে দেয়,"দাদা তাড়াতাড়ি ওডো। আইজগা আমরা তাল দিয়া মুরি খাইয়াম। তুমি মছজিদতোন আইলে হরে বেকে একলগে নাস্তা কইরাম।"

ইমরান অলস ভঙ্গিতে ওঠে। বারকয়েক কাশি দেয়।

ইমরানকে কাশি দিতে দেখলেই শ্বাশুড়ি-বউয়ের মুখ চিন্তায় টানটান হয়ে ওঠে।

নাতির কপালে হাত দিয়ে উষ্ণতার মাপ নেয়,"কিও দাদা! আবার কাশিডা চেতলোনি!"

ইমরান কথা না বলে ঘাটলার দিকে চলে যায়।

মরিয়ম ঘর থেকে নামে। আর্দ্রতার ছড়াছড়ি চারদিকে। মুখ তুলে আকাশ নীরিক্ষণ করে। আকাশ তার সকল ভার নিয়ে থমকে আছে।

উঠান জুড়ে ছন্নছাড়া খড়-কুটোর ভেজা গন্ধ মরিয়মের নাকে লাগে। মরিয়ম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বানদুয়ারের দিকে এগোয়।

প্রায় পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছরের মরিয়মকে এখনো বয়স কাবু করতে পারেনি। দোহারা গড়েন কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রং। মাথা আর কবরী---আকার আকৃতিতে প্রায় কাছাকাছি।পান খাওয়া ঠোঁটে লাল রং সৌন্দর্যে আলাদা মাত্রা যোগ করেছে।

রান্নাঘরের পাশে মুরগির খোঁয়াড়ের দরজা খুলতে হবে। গরু ঘর পরিষ্কার করতে হবে। এ কাজগুলো প্রতিদিন মরিয়মই সারে। ছেলের বউকে সে এসব কাজ থেকে বিরত রাখে।

কুদ্দুস হাসতে হাসতে একদিন বলেছিল,"আম্মা, আমনে যে নূরিরে এসব কাম করতো দেন না, আমারেও করতো দেন না, আমনে মইরা গেলে তহন কে করবো?"

মরিয়ম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে়,"বাবুরে দুনিয়াতে কোনো কাজ কারো লাইগ্যা আডক থাহেনা। আঁই মইরা গেলে তহন তোমরা সব হাঁডাইয়ো। যতদিন রথে কুলায় ততদিন আঁই কইরাম।"

ছোটকালে কুদ্দুসকে তার মা তুই সম্বোধন করলেও এখন তুমি ছাড়া কথা বলেনা।

বদ্ধ খোঁয়াড়ে হাঁস মুরগি গুলো বিকাশমান দিনের খবর পেয়ে গেছে। খোঁয়াড় ছেড়ে বের হওয়ার জন্য বোবা প্রাণীগুলো ব্যাপক তড়পাচ্ছে। তারা আর খোঁয়াড়ে থাকতে চায়না।

মুরগির খোঁয়াড়ের পাশে রান্নাঘর সংলগ্ন হাঁসের খোঁয়াড়। মরিয়ম হাঁস-মুরগি উভয়ের খোঁয়াড়ের দ্বার খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে গৃহপক্ষীরা তাদের জন্য নির্দিষ্ট পাত্রে রক্ষিত বাসিভাত ও ধানের কুঁড়া মিশ্রিত খাবার খুঁটে খেতে লাগলো।

চুলার দুয়ারে নূরি। দু-চোখের মাটির চুলায় রান্না চড়িয়েছে। বর্ষাকালে গোবর লাঠির আগুনেই বেশির ভাগ রান্না সারতে হয়।

নূরির পাশে গোবর লাঠির স্তুপ। পাটখড়ির লাঠিতে গোবর মিশিয়ে, বাড়ির পাশে নিচু ভূমি যেখানে অনেক বেলা পর্যন্ত রোদ থাকে, সেখানে মরিয়ম এগুলো শুকায়। এই গোবর লাঠি দারুণ জ্বালানি। সঙ্গে অল্প তুষ দিলে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে।

এক চুলায় ভাত, আরেক চুলায় তাল। এক ফাঁকে নূরি বড় ঘরে এসে জ্বাল দিয়ে রাখা বাইলা মাছ ও পুঁটি মাছ নিয়ে গেল। গতকাল হলুদ-লবণ ও রসুন দিয়ে মাছগুলো জ্বাল দিয়ে রেখেছিল।

প্রতিদিন ইমরান মসজিদে আরবি পড়া শেষ করে হগারবাড়ি যায় তার হাকিম চাচার কাছে। কুদ্দুস ইমামতি করে বটে কিন্তু জাল পাতা, আন্তা পাতা, বারা পাতার কাজ হাকিম করে দেয়।

কুদ্দুসের বর্গা জমি চাষের পাশাপাশি কুদ্দুসের পরিবারের অনেক কাজও হাকিম করে। কিছু মাছ হাকিম রাখে। বাকিগুলো কুদ্দুসের পরিবারকে দেয়। ইমরান গিয়ে মাছগুলো নিয়ে আসে।

রান্নাঘরের পাশে লাগানো ঝিঙের মুড়া পুরো চাল জুড়ে আছে। বাড়ির আনাচে-কানাচে যেখানেই রোদের স্পর্শ এসে লাগে সেখানে মরিয়ম তরকারির মুড়া লাগায়। সেগুলো ঘরের চাল জুড়ে় থাকে অথবা শুকনো ডাল আর চিকন বাঁশের মাচায় জড়িয়ে বেড়ে ওঠে। উঠানের পাশে লাউ, কুমড়া ও শসার আরোহি লতায় স্পষ্ট মরিয়মের মায়াময় যতেœর ছাপ।

আজ মরিয়ম ঝিঙ্গে এনে দিল নূরির কাছে। নূরি একবার চুলায় জ্বাল দিচ্ছে আরেকবার ঝিঙ্গে কুটছে।

"আম্মা, দেহেন কি আনছি" বলতে বলতে মাছের ডুলাটা ইমরান নূরির দিকে এগিয়ে দিলো। ইমরান রীতিমতো হাঁফাচ্ছে। চেহারায় উপচে পড়া আনন্দ।

ডুলার ভেতর বড় একটা বাইলা মাছের সাথে দুইটা বড় চিংড়ি। তাজা মাছের গায়ের ঝিলিক এবার ইমরানের মায়ের চোখে।

কুদ্দুস মসজিদে আরবি পড়ানোর কাজ সেরে মাত্র বানদুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে। মাথা নুয়ে ডুলার মাছ নেড়েচেড়ে দেখছে। নূরিকে উদ্দেশ্য করে বলে, "নাইরকোল দিয়া মাছডি রান্না করবা।"

আগে নূরির নাম ছিল নূরজাহান। বিয়ের পর নামের দৈর্ঘ্য কমে যায়। সৌন্দর্যের দিক থেকে নূরিকে বলা চলে এ বাড়ির আলো।

ছেলে নারিকেল দিয়ে বাইলা মাছ রান্নার কথা বলতেই মরিয়মের দূর অতীতে ফেলে আসা স্বামীর স্মৃতি মনে পড়লো। লতিফ মিজি সব তরকারির সঙ্গে নারকেলবাটা দিতে বলতো। নারকেল বাটা দিলে তরকারির স্বাদ নাকি অন্যরকম হয়ে যায়।

দীর্ঘশ্বাস চেপে মরিয়ম বড় ঘরে ঢুকলো। নাস্তা খাওয়ার জন্য ছোট-ছোট মোস্তাগের বিছানা পাতলো। মুড়ির ঢোক থেকে মুড়ি নিলো টুকরিতে।

সবার জন্য থালায় তাল পরিবেশন করলো। নিজেদের গাছের তাল, ঘরে দোয়ানো গরুর দুধ ও বেশি করে নারকেল দিয়ে রান্না করা ঘন তাল মুড়ির সঙ্গে মিশিয়ে আজ এ বাড়ির নাশতা হবে।

পুরো বাড়ি এখন নারকেল-দুধ-তালের মিষ্টি গন্ধে কেবল মৌ মৌ করছে। (চলবে)

এইচআর/এমএস