বিএনপি কখনই বাংলাদেশের ভালো চায় না। আরও একবার সেটা প্রমাণিত হলো। বিএনপি নেতারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিদেশি অনুদান বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে পেশাদার লবিস্ট নিয়োগ করে বিএনপি নেতারা চেষ্টা করেছিলেন বাংলাদেশে বিদেশি অনুদান বন্ধ করতে। তাদের সেই অপকর্মের প্রমাণ গণমাধ্যমের হাতে এসেছে। তার থেকেই বোঝা যায়, বিএনপির ষড়যন্ত্রের জাল কতো ভয়ঙ্কর।
Advertisement
গণমাধ্যমের হাতে আসা বিভিন্ন প্রামাণ্য নথি থেকে জানা যায়, বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান বন্ধ করতে বিএনপি দুই বছর আগে চিঠি দিয়েছিল। সেই চিঠিতে তারা সরাসরি আর্থিক সহায়তা বন্ধ করার অনুরোধ করে। এমনকি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেনের ওয়াশিংটন সফরের সময় বিএনপি একটি পেশাদার লবিস্ট সংস্থাকে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে লবিং করেছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওপর নির্বাচন সংক্রান্ত চাপ সৃষ্টি করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়কে আন্তর্জাতিক ইস্যু বানাতে বিএনপি কোনও কার্পণ্য করেনি। তাদের সেই চক্রান্ত ফাঁস হয়েছে। বিএনপির পাঠানো সেইসব চিঠি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রে তাদের হয়ে লবিং করার জন্য নিয়োগ করেছিল ব্লু-স্টার স্ট্রাটেজিস নামে একটি সংস্থাকে। এই লবিং সংস্থাটিই বিএনপির হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চিঠি চালাচালির পাশাপাশি নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে এবং পরে বিএনপি ও ব্লু-স্টার একাধিক চিঠি প্রেরণ করে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন দপ্তরে। সেইসব চিঠি বিশ্লেষণ করলে বিএনপির ষড়যন্ত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রকে ভুল বোঝানোর জন্যই তারা পেশাদার সংস্থার সাহায্য নিয়েছিল।
বিএনপির লবিস্ট নিয়োগ এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন দফতরে দলটির তদবিরের কিছু নথিপত্র ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমে প্রকাশিত। এসব নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের আগে ও পরে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন দফতরে অর্ধশতাধিক চিঠি পাঠিয়েছে বিএনপি। সেইসব চিঠিতে বাংলাদেশের প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরার বদলে বিকৃত তথ্য পাঠানো হয়েছে মার্কিন মুলুকে। দেশের ভাবমূর্তিকে কলঙ্কিত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে বিএনপি। আর সেই কাজে তাদের সহায়তা করার জন্যই নিয়োগ করা হয়েছিল পেশাদার লবিং সংস্থাকে। তারাই বিএনপির হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে।
Advertisement
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সাড়ে তিন মাস পর, ২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মার্কিন সিনেট কমিটি, সাব কমিটি এবং হাউস কমিটির ৫ চেয়ারম্যান ও সদস্যদের কাছে চিঠি দেন। এই কমিটি গুলোর কাজ হচ্ছে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য ও অনুদানের মূল্যায়ন করা।
তাদের কাছে চিঠি দিয়ে মির্জা ফখরুল অনুদান বন্ধের চেষ্টা করেছিলেন। বিএনপির সেই ব্যর্থ ষড়যন্ত্রের কথা আজ প্রমাণিত।
২০১৯ সালেরই ২৪ এপ্রিল বিএনপি মহাসচিব ফের হাউস এবং সিনেটের পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান ও উপ-কমিটির ৫ চেয়ারম্যান এবং বিভিন্ন কমিটির অন্যান্য ৫ সদস্যকে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলার আবেদন জানিয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিতে নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক তদন্তের আবেদন করা হয়। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন বাতিলের জন্য বিএনপি ও তাদের লবিং সংস্থা ব্লু-স্টার চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি। কিন্তু তাদের শত চেষ্টাতেও কোনও লাভ হয়নি। বরং সেইসব চিঠি হাতে আসায় বিএনপির ষড়যন্ত্রের ছবি আজ প্রকাশ্যে চলে এসেছে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওয়াশিংটন সফরের এক সপ্তাহ আগে থেকে বিএনপির ভাড়া করা লবিস্ট ফার্ম ব্লু-স্টার স্ট্র্যাটেজিস সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। তার সফর বানচালের সবরকম চেষ্টা চলে। বিএনপি ও ব্লু-স্টার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিভাগকে একটি চিঠি দিয়েছিল। সেই চিঠিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে জবাবদিহি করতে বলা হয়। অনুরোধ করা হয়, ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষের কথাও প্রকাশ করতে। কিন্তু সেই চেষ্টাও তাদের ব্যর্থ হয়।
Advertisement
গণমাধ্যমে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রে মির্জা ফখরুলদের ষড়যন্ত্রের সব চিঠিই বিএনপির দলীয় প্যাডে লেখা। ঠিকানা দেওয়া হয়েছে দলের নয়া পল্টন কার্যালয়ের। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের আগে পাঠানো চিঠির প্রেরক হিসেবে ব্লু-স্টার স্ট্রাটেজি ও বিএনপি উভয়ের নামই রয়েছে। দেশের সুনাম নষ্ট করতে ভাড়া করা সংস্থাকে কাজে লাগানোর এমন নজির খুব কম রয়েছে।
বিএনপি নেতারা ষড়যন্ত্র করেও অবশ্য বাংলাদেশের কোনও ক্ষতি করতে পারেনি। হাতে গোনা ৬-৭ জন কংগ্রেসম্যান বিএনপি ও তার লবিস্টদের দেয়া তথ্যে সায় জানালেও মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি তেমন কোনো ব্যবস্থাপনা। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর থেকে একাধিক ব্রিফিংয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া তাদের আর কোনো চাওয়া নেই।
অবশ্য বিএনপি-জামায়াত সম্মিলিত শক্তির জন্য লবিস্ট নিয়োগ করে দেশের ক্ষতি করার বিষয়টি নতুন নয়। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এআইচআরডব্লিউ) এর মত প্রতিষ্ঠানকেও লবিং এর মাধ্যমে মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে সাজা পাওয়া আসামির পক্ষে সাফাই গাইতে দেখা গেছে ২০১৩-১৪ সালে।
জানা যায়, যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী এবং অপর যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে রক্ষা করতেই উঠে পড়ে লাগে লবিস্টরা। উঠে আসে যুক্তরাজ্যের লবিস্ট টবি ক্যাডম্যানের নাম। সম্প্রতি সময়েও বিএনপি-জামায়াতের লবিস্ট হিসেবে কাজ করার নিদর্শন রয়েছে এই টবি ক্যাডম্যানের।
শুধু লবিস্ট নিয়োগ দিয়েই খ্যান্ত হয়নি বিএনপি। বিদেশে বাংলাদেশের সুনাম অক্ষুন্ন রাখা শান্তিরক্ষা বাহিনী নিয়েও অপপ্রচার চালিয়েছে তারা। শান্তিরক্ষা বাহিনীকে 'খুনি' বলে অ্যাখ্যায়িত করে নিজেদের ভেরিফাইড পেজ থেকে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সেনা ও পুলিশ না নেবার আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি।
এমন আহ্বান জানাবার সময় তারা এটাও ভাবেনি, যে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ অংশ না নিতে পারলে বা সেটি বন্ধ হয়ে গেলে তারা ক্ষমতায় গেলেও বিষয়টির তড়িৎ কোন সমাধান হবার সম্ভাবনা থাকবে না। সেই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে কেন্দ্র করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশ সেনাবাহিনী নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুর্নাম রটিয়ে দিন শেষে নিজেরাই হাসির পাত্রে পরিণত হচ্ছে বিএনপি নেতারা।
সম্প্রতি সময়ে মার্কিন ভিসা নীতি আরোপের পর বিষয়টিকে প্রাথমিকভাবে স্বাগত জানালেও সম্প্রতি সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের সহযোগী মনে করছে না বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিগত দুই বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে যেই বক্তব্য দিয়েছে তার থেকে অনেকটা দূরে সুরে গেল সপ্তাহে বলে বসেন, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কি চাচ্ছে তাতে আমাদের কিছু যায় আসেনা।
ফখরুলের এই বক্তব্য বেশ স্পষ্টভাবে ছিল বিরক্তির ভাব। ধারণা করা হচ্ছে এত অর্থ খরচ ও লবিং করেও দিন শেষে তাদের মূল দাবি 'তত্ত্বাবধায়ক সরকার' প্রতিষ্ঠায় কোন কথাই বলছে না যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলো। এমনকি প্রতিবেশী ভারতসহ কোন দেশ থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে মত দিচ্ছে না। উল্টো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বদলে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত দেশগুলো। ফলে বাংলাদেশের ক্ষতি করে তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নও ম্লান হয়ে যাচ্ছে।
বিএনপি খুব সম্ভব একটি বিষয় ভুলে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি ব্রিফিংয়ে এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বক্তব্যে বারবার উঠে এসেছে একটি কথা, 'আমরা কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নেই'। ফলে সংবিধানের মধ্যে থেকে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হলে সেখান কোন দলটি অংশগ্রহণ করছে এবং কোন দল অংশগ্রহণ করছে না, এতে তাদের খুব একটা মাথা ব্যথা নেই। তাদের সম্পর্ক বাংলাদেশের সঙ্গে। আর বাংলাদেশের সঙ্গে সেই সম্পর্ক বলবৎ রাখা ও উন্নত করার জন্য তাদের অপরাপর সব সিদ্ধান্ত।
নিজেদের জন্মলগ্ন থেকেই বিএনপি বাংলাদেশের সর্বনাশ চেয়ে এসেছে। জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী দলটির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভূমিকা নিয়েও এখন নানা প্রশ্ন উঠছে। জিয়ার পথ ধরেই খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান বাংলাদেশকে ব্যর্থ দেশে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা, দেশনেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সমস্ত ষড়যন্ত্রকে পরাস্ত করে বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় উন্নিত করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ আজ সবদিক থেকেই উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত। তাই বিএনপি নেতারা হতাশার থেকে ষড়যন্ত্রের জাল আরও বিস্তৃত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জনগণের থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এখন বিদেশের মাটিতে কান্নাকাটি করে চলেছেন বিএনপির নেতা-নেত্রী এবং তাদের ভাড়াটে সংস্থা।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস