আসাদুল্লাহ আল গালিব ৪১তম বিসিএসে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে (মেধাক্রম-২৩) সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। বাবা একজন কৃষক, মা গৃহিণী। তিনি ১৯৯৮ সালের ১১ মার্চ লালমনিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ২০১৩ সালে দাখিল, ২০১৫ সালে আলিম এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগ থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন।
Advertisement
সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে তার বিসিএস জয়, ক্যারিয়ার পরামর্শ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মমিন উদ্দিন—
জাগো নিউজ: বিসিএসে ক্যাডার পাওয়ার অনুভূতি কেমন?আসাদুল্লাহ আল গালিব: সন্ধ্যাবেলা একটি টিউশনি শেষে বেরিয়ে রাস্তায় ফোন চেক করছিলাম। তখন দেখি ৪১তম বিসিএসের রেজাল্ট বেরিয়েছে। বুকটা ধুকপুক করছিল। রেজাল্ট শিটে নিজের রেজিস্ট্রেশন নাম্বার দিয়ে সার্চ দিলাম। আমার নাম্বারটা শিটে দেখে কী যে খুশি লাগলো, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বারবার চেক করে নিশ্চিত হলাম। আব্বাকে ফোন দিয়ে জানালাম, আমি শিক্ষা ক্যাডার পেয়েছি, চাকরি হয়েছে। আব্বা খুশিতে কান্না করে দিয়েছেন বুঝতে পারছিলাম। মনে হচ্ছিল, জীবনের সেরা সংবাদটা এতদিনে পেলাম।
আরও পড়ুন: বাবার অনুপ্রেরণায় বিসিএস ক্যাডার মানস
Advertisement
জাগো নিউজ: পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল?আসাদুল্লাহ আল গালিব: প্রতিবন্ধকতা ছিল। বাবা কৃষক, তার একার উপার্জনের ওপর নির্ভর করতো আমাদের সবার সবকিছু। যেখানে বাবার উপার্জনে পরিবার চালানোই কঠিন ছিল; সেখানে আবার আমার পড়ালেখার খরচ বহন করা ছিল বিলাসিতা। কিন্তু আমার বাবা এই বিলাসিতা করে যাচ্ছেন আমার জন্মের পর থেকেই। শত কষ্ট সয়ে আমার প্রতিবন্ধকতাগুলো তিনি নিজ হাতে দূর করেছেন।
জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?আসাদুল্লাহ আল গালিব: অনার্সের শেষবর্ষে। ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাবাজি করেই কাটিয়েছি প্রথম কয়েক বছর। আমার একাডেমিক পড়াশোনাও খুব ভালো ছিল না। এটা-সেটা করতে করতে কখন যে পার হয়ে গেল ভার্সিটি লাইফ, বুঝতেই পারিনি। শেষবর্ষে গিয়ে উপলব্ধি হলো, কিছু একটা করা দরকার। তখন আশেপাশের বন্ধুরা, সিনিয়ররা বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমিও ভাবলাম বিসিএস দিতে হবে।
জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই—আসাদুল্লাহ আল গালিব: ৪১তম বিসিএসের সার্কুলার হয় আমার অনার্সের লাস্ট সেমিস্টারের পরীক্ষার ডেট দেওয়ার পর। বন্ধু শিপন, সজীব ও আমি অ্যাপেয়ার্ড হিসেবে আবেদন করে বসি। তখনো বিসিএস নিয়ে অতটা ভাবতাম না, প্রস্তুতির তো প্রশ্নই আসে না। এরপর অনার্সের পরীক্ষা শেষ হলো। আর শুরু হলো সেই কোভিড-১৯। ঢাকার মেস ছেড়ে গ্রামে চলে গেলাম। পরিবারের সঙ্গে প্রথম কয়েক মাস ভালোই কাটলো। খাচ্ছি-দাচ্ছি, বেড়াচ্ছি, নো টেনশন। কিন্তু একটা সময় গিয়ে বোধোদয় হলো। আমার বাবা গরিব কৃষক। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে মাঠে কাজ করেন। ছোটবেলা থেকে তাকে দেখে আসছি, আমার সুখের জন্য ক্লান্তিহীন খাটছেন। এত বড় হয়ে গেছি, অথচ বাবার দুঃখের ভার একটুও কমাতে পারিনি। কোনো ভাবনাও নেই যেন আমার। নিজেকে খুবই অপরাধী মনে হচ্ছিল।
আরও পড়ুন: জাবীরের বিসিএসে পুলিশ ক্যাডার হওয়ার গল্প
Advertisement
ভাবলাম, অনার্স তো শেষ, এবার কিছু তো করতে হয়। করোনার জন্য সব সার্কুলার, নিয়োগ বন্ধ। ভার্সিটি বন্ধ। তাহলে বাড়িতে বসে না থেকে জবের প্রস্তুতিই নিতে থাকি এ কয়দিন। ৪১তম বিসিএসে আবেদন করা আছে, যে কোনো সময় পরীক্ষা হয়ে যেতে পারে ভেবে কোমর বেঁধে নেমে পড়লাম। রাত-দিন এক করে পড়তে শুরু করলাম। গণিতে দুর্বল ছিলাম। প্রতিদিন গণিতের জন্যই প্রায় তিন ঘণ্টা বরাদ্দ করলাম। ইংরেজির জন্য আরও দুই ঘণ্টা। প্রতিটি সাবজেক্টের জন্য আলাদা নোটখাতায় গুরুত্বপূর্ণ ও যে বিষয়গুলো কম মনে থাকছে; সেগুলো নোট করে পড়ছিলাম। পরীক্ষার আগের কয়েকমাস বাড়িতেই প্রস্তুতি নিতে থাকলাম।
এরপর করোনার মধ্যেই হুট করে ৪১তমের প্রিলিমিনারি হয়ে গেল। পাস করে গেলাম। এবার রিটেন পরীক্ষার ১১০০ মার্কের বিশাল সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার পালা। সময় পেলাম খুব কম। মাত্র চার মাসের মতো। এ অল্প সময়েই সব ছেড়ে শুধু প্রস্তুতিতে সময় দিতে থাকি। রিটেনের সময় মাস্টার্সের পরীক্ষারও ডেট হয়, আমি মাস্টার্স করলাম না। এসময় মাস্টার্স করলে রিটেনে বাজেভাবে হেরে যেতে পারি ভেবেই মাস্টার্স বাদ দিলাম। সেজন্য অনেকের অনেক কথাই শুনতে হয়েছে। কিন্তু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম। মাস্টার্স পরেও করতে পারবো। এ সুযোগ আবার পাবো কি না কে জানে?
রিটেন দিলাম ভালোভাবেই। পাস করে গেলাম বোথ ক্যাডারে। এবার ভাইভা। ভাইভার জন্য পেলাম চার মাসের মতো। ইংরেজি স্পিকিংয়ে দুর্বল আমি। এ সময়ে কিছুটা ঝালিয়ে নিলাম। ভাইভা দিলাম প্রফেসর ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক স্যারের বোর্ডে। ভাইভাও ভালো হলো। আশা করছিলাম ভালো কিছুর জন্যই।
আরও পড়ুন: বাবার স্বপ্ন পূরণ করতেই বিসিএস ক্যাডার মুন্নী
জাগো নিউজ: কারো কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কি?আসাদুল্লাহ আল গালিব: আমার অনুপ্রেরণা আমার বাবা। আমার মা। বাবা-মা চিরকাল যে কষ্ট করে আসছেন, সেই কষ্টের ভার দূর করাই ছিল একমাত্র স্বপ্ন। ভাবতাম, পড়াশোনা শেষ করেই দ্রুত একটি চাকরি পেতেই হবে। মা-বাবার মুখে হাসি ফেরাতে হবে। এ ভাবনাই আমার অনুপ্রেরণা।
জাগো নিউজ: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?আসাদুল্লাহ আল গালিব: একটি সুন্দর, সুখী পরিবার নিয়ে জীবন কাটানো। কষ্ট স্পর্শ না-করা একটা জীবন যেন আমি আমার প্রিয়জনদের দিতে পারি, এটি নিয়েই ভাবি। তাছাড়া আরও কিছু পরিকল্পনা আছে। এর জন্য আপনাদের কাছে দোয়াপ্রার্থী।
এসইউ/জেআইএম