কক্সবাজারের চকরিয়ার কাকারায় থাকেন আব্দুল হামিদ। পানিতে ঘর ডুবে যাওয়ায় গবাদিপশু ও পরিবারের ছয় সদস্য নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন মহাসড়কে। গত দুদিনে কোনো ধরনের সহায়তা পাননি বলে অভিযোগ তার। বলেন, ঘরের ছাউনি পর্যন্ত পানি ওঠায় ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে বাঁধে ঠাঁই নিয়েছি। সন্তানদের খাবার দিতে পারছি না, সঙ্গে গবাদিপশুও অভুক্ত।
Advertisement
শুধু আব্দুল হামিদ নন, বানের পানিতে খাদ্য সংকটে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন চকরিয়া-পেকুয়ার মানুষ। এছাড়া দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকট।
গত কয়েকদিনে টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকা ডুবে যায়। এরমধ্যে পানি কিছুটা নেমেছে। তবে দুর্ভোগ কমেনি জেলার ৬০ ইউনিয়নের কয়েক লাখ বানভাসি মানুষের। বানের জলে সবকিছু ডুবে থাকায় এসব অঞ্চলের মানুষ চরম দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনায় রয়েছে চকরিয়া-পেকুয়ার ২৫টি ইউনিয়নের পানিবন্দি লাখো মানুষ। তারা গবাদিপশু ও আসবাবপত্র নিয়ে মহাসড়ক, বাঁধ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছেন।
এদিকে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ ও সাতকানিয়ায় মহাসড়কের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া বানের পানি বুধবার সকালে কিছুটা কমলেও শুরু হয়নি কক্সবাজার-চট্টগ্রাম সড়কে যান চলাচল। তবে আনোয়ারা-বাঁশখালী-পেকুয়া আঞ্চলিক মহাসড়ক দিয়ে ছোট ও মাঝারি ধরনের যানবাহনে অনেকে যাতায়াত করছেন বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারস্থ সৌদিয়া পরিবহনের ব্যবস্থাপক নিরু পাল।
Advertisement
আরও পড়ুন: পানিবন্দি ৭ লাখ মানুষ, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক যোগাযোগ প্রায় বন্ধ
এদিকে পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়ার পানি না কমলেও মহাসড়কের অন্য স্থানের পানি পুরোপুরি নেমে গেছে বলে জানিয়েছেন চিরিংঙ্গা হাইওয়ে থানার ইনচার্জ (ভারপ্রাপ্ত) এসআই খোকন রুদ্র। তবে এখনো চট্টগ্রামের মতো বান্দরবানের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) রাতে বৃষ্টি কম হওয়ায় কিছু কিছু এলাকায় বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। তবে ভাটির দিকে নতুন নতুন এলাকায় পানি ঢুকছে। নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে ঢলের পানি ঢুকে পড়ছে এসব গ্রামে।
ত্রাণের বিষয়ে চকরিয়ার ইউএনও জেপি দেওয়ান বলেন, মঙ্গলবার বিকেলে জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরান বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন ও ত্রাণ বিতরণ করেছেন। এখানে ২০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত চকরিয়ায় পাহাড়ধসে দুজন ও পানিতে ডুবে দুজনের মৃত্যু হয়েছে।
Advertisement
অন্যদিকে, পেকুয়ার ১০-১২টি গ্রাম থেকে পানি কমছে। তবে আরও ডজনখানিক গ্রামে পানি বাড়ছে। যেসব বসতঘরে হাঁটু সমান পানি ছিল, সেসব বসতঘরে বুকসমান পানি হচ্ছে। বিশেষ করে পেকুয়া সদরের গোঁয়াখালী, বকসু চৌকিদারপাড়া, ছিরাদিয়া, বিলহাচুরা, শেখেরকিল্লাহ ঘোনা, সিকদারপাড়া, বাইম্যাখালী, জালিয়াখালী, নন্দীরপাড়া, বাঘগুজারা এলাকায় পানি বাড়ছে।
আরও পড়ুন: এক যুগ ধরে সড়কের বেহাল দশা, বৃষ্টি হলে তলিয়ে যায়
স্থানীয়রা বলছেন, উঁচু স্থান থেকে পানি নিচু স্থানে নেমে আসছে। এজন্য বাড়ছে পানি। তবে ছিরাছিয়া ও গোঁয়াখালী এলাকায় বেড়িবাঁধ কেটে দেওয়ায় পানি কাটাফাঁড়ি খালে বের হচ্ছে। খালে লোকালয়ের চেয়ে পাঁচ থেকে ছয় ফুট পানি কম আছে। এজন্য লোকালয় থেকে পানি দ্রুত বের হচ্ছে। বৃষ্টি না হলে বুধবার রাতের মধ্যে পানি তিন থেকে চার ফুট কমে যাবে।
এদিকে পেকুয়ার ইউএনও পূর্বিতা চাকমাকে নৌকা নিয়ে প্লাবিত এলাকায় গিয়ে শুকনো খাবার, চাল-ডাল ও রান্না করা খাবার বিতরণ করেছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া মঙ্গলবার বিকেলে স্থানীয় সংসদ সদস্য জাফর আলম, জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান, পেকুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম দুর্গত এলাকা পরিদর্শন ও ত্রাণ দিয়েছেন।
ইউএনও বলেন, জেলা প্রশাসন থেকে বরাদ্দ পাওয়া ১৫ টন চাল আশ্রয়কেন্দ্র ও পানিবন্দি লোকজনের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত পেকুয়ায় সাপের কামড়ে এক ব্যবসায়ী ছাড়া আর কোনো মৃত্যু নেই।
রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ির ইউনিয়নের পশ্চিম উমখালী গ্রামের শাহাদত হোসাইন বলেন, গেলো দুদিন ধরে ঘরের ভেতর প্রায় কোমরসমান পানি, তাই চুলা জলেনি। খাটের ওপর কোনো রকমে বসবাস করছি। বাইরে থেকে শুকনো খাবার কিনে খাচ্ছি। এছাড়া খাবার পানির সংকটও রয়েছে।
আরও পড়ুন: ফেনী-পরশুরাম সড়কে যানচলাচল বন্ধ, পানিবন্দি ৫০ হাজার মানুষ
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, পাহাড়ি ঢলের তোড়ে মাতামুহুরি নদীর কমপক্ষে ১৫টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এসব ভাঙন দিয়ে লোকালয়ে ঢলের পানি ঢুকে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। মাতামুহুরি নদীর অববাহিকার বাসিন্দারা চরম ভোগান্তিতে রয়েছেন। গত আট দিনে পাহাড়ধসে, পানিতে ভেসে ও সাপের কামড়ে চকরিয়া, পেকুয়া, রামু ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আটজন মারা গেছেন।
এদিকে চকরিয়া-পেকুয়াসহ বন্যাকবলিত এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনেক মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন। পানি কমলেও এখনো তারা বাড়ি ফিরতে পারছেন না।
চকরিয়া পৌরসভার কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেত্রী ফরহানা ইয়াসছিন তার ভেরিফাইড ফেসবুকে মানুষের দুর্ভোগের কয়েকটি ছবি পোস্ট করে যথাযথ বরাদ্দ না থাকায় তাদের পাশে দাঁড়াতে পারছেন না বলে অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন।
কক্সবাজার সদরের ঝিলংজার পূর্ব মুক্তারকুলের জাহেদা বেগম বলেন, নলকূপগুলো বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছি না। কলাগাছের ভেলায় চড়ে চলাফেরা করছি।
আরও পড়ুন: পাহাড়ি ঢলে সাজেকে আটকা ৩ শতাধিক পর্যটক
ঝিলংজার চান্দের পাড়ার পানিবন্দি কৃষক নবী হোসেন বলেন, বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। একদিকে পাহাড়ি ঢলের পানি, অন্যদিকে বৃষ্টি। এ অবস্থায় বাড়িঘর ছেড়ে মহাসড়কে আশ্রয় নিলেও খাবার এবং বিশুদ্ধ পানির সংকটে ভুগছি।
রামুর কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের দোছড়ি এলাকার আবছার উদ্দিন বলেন, বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও দুর্ভোগ কমেনি। সরকারিভাবে যেটুকু সহযোগিতা করা হচ্ছে, তা অপর্যাপ্ত।
ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান টিপু সুলতান জানান, বানভাসি মানুষের বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসন জরুরি হয়ে পড়েছে। ঘরবাড়ি মেরামতসহ আর্থিক সহায়তা দরকার।
জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, বন্যায় চকরিয়া-পেকুয়ার সব ইউনিয়ন কমবেশি প্লাবিত হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় ৫৮ টন চাল এবং সাত লাখ নগদ টাকা সাহায্য দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দুর্গতদের জন্য বিতরণ হচ্ছে শুকনো খাবার। বন্যাকবলিত এলাকায় উদ্ধার অভিযান ও খাদ্য সহায়তা দিচ্ছেন নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
সায়ীদ আলমগীর/জেডএইচ/