স্বাস্থ্য

বাংলাদেশেই কম খরচে ভারতের চিকিৎসাসেবা দেবে ডিসান

বাংলাদেশে এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চিকিৎসাকেন্দ্র নির্মাণ করবে ভারতের স্বনামধন্য ডিসান হাসপাতাল। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে বিশ্বমানের এ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও সিলেটে জমি দেখছে ডিসান কর্তৃপক্ষ। এ চারটি শহরের মধ্যে একটি জায়গায় হাসপাতাল নির্মাণ করবে তারা। তাদের হাসপাতালে দেশে বসেই কম খরচে বিশ্বমানের সেবা পাবেন বাংলাদেশের রোগীরা। হাসপাতাল নির্মাণের ক্ষেত্রে রোগীদের কম খরচের দিকে বিশেষ নজর রাখছে প্রতিষ্ঠানটি। কলকাতায় ডিসান হাসপাতালে বসানো হয়েছে হেলিপ্যাড। বাংলাদেশ থেকে জরুরি প্রয়োজনে হেলিকপ্টারযোগে সরাসরি সেখানেও রোগী নেওয়া যাবে।

Advertisement

বাংলাদেশে চিকিৎসাখাতে বিনিয়োগসহ সার্বিক বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন ডিসান হাসপাতালের চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর সজল দত্ত। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক ইসমাইল হোসাইন রাসেল।

আরও পড়ুন>> বাংলাদেশে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে হাসপাতাল করবে ভারত

জাগো নিউজ: বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে আপনারা একটি বড় বিনিয়োগ নিয়ে আসছেন। বাংলাদেশে হাসপাতাল করার বিষয়ে আপনাদের পরিকল্পা জানতে চাই।

Advertisement

সজল দত্ত: পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সর্বাধিক বেড আছে ডিসান হাসপাতালে। সেটা হাজারের ওপরে। কলকাতায় ৭৫০টি এবং শিলিগুড়িতে ৩০০ বেড। আমাদের কাছে অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রচুর রোগী আসে চিকিৎসার জন্য। এ ব্যাপারে আমরা যখন খোঁজ-খবর শুরু করি, তখন দেখি বাংলাদেশ থেকে প্রচুর রোগী চিকিৎসার জন্য কলকাতাসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় যান। সুতরাং, একটা চিন্তা শুরু হলো। বাংলাদেশে ইনভেস্টমেন্ট করার অপরচুনিটি কী, সেটা নিয়ে আমাদের রিসার্চ টিম কাজ শুরু করলো। সেই বিবেচনায় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এক হাজার কোটি টাকা আমরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবো হাসপাতালের জন্য। হয়তো এখানকার সব রোগীর জন্য হবে না, তবে কিছুসংখ্যক মানুষের যাতে বাইরে যেতে না হয়, বাংলাদেশেই যাতে তাদের চিকিৎসা হয়।

জাগো নিউজ: আপনাদের হাসপাতালে কোন কোন রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকবে?

সজল দত্ত: আমাদের অভিজ্ঞতা ও রিসার্চ যেটা করেছি সেটা থেকে বলছি, চারটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রোগী আছে, যেটি তাদের ভীষণ দরকার হয়। প্রথম হচ্ছে কার্ডিয়াক, হার্ট নিয়ে চিকিৎসা। তার মধ্যে পেসমেকার, হার্টের এনজিওপ্লাস্টি, বাইপাস আছে। তারপর হচ্ছে ক্যানসার, এটা আমরা চাই না, তারপরও ক্যানসারের রোগী দিন দিন হু হু করে বাড়ছে। তাদের সুচিকিৎসা আমরা করতে চাই, চিকিৎসায় ক্যানসারটাও থাকবে। তারপর নিউরো, ব্রেইন অব স্পাইন ডিজ অর্ডারস থাকবে এবং গ্যাস্ট্রোঅ্যান্টেরোলজি থাকবে। এ চারটি মেজর বিষয়ে আমরা ফোকাস করবো।

আরও পড়ুন>> স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠার ৪৯ বছর পর হলো প্রথম সিজার

Advertisement

জাগো নিউজ: খরচের বিবেচনায় অধিকাংশ বাংলাদেশি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে চিকিৎসা নিতে যান। বাংলাদেশে হাসপাতাল করার ক্ষেত্রে রোগীদের কম খরচের দিকে নজর থাকবে কি না?

সজল দত্ত: নিশ্চয়ই নজর থাকবে। কারণ এখানে চিকিৎসা নিলে আপনি যাতায়াতের খরচ, থাকার খরচ থেকে মুক্ত হবেন। মোট খরচ হিসাব করলে একজন বাংলাদেশি রোগী কলকাতায় গিয়ে থাকা, খাওয়া আর বারবার যাওয়া আসার খরচ থাকে। কোনো রোগীই কিন্তু একবার গিয়ে সম্পূর্ণ চিকিৎসা পাবেন, আর কোনো দরকার লাগবে না সেটি বলা যায় না। সুতরাং, সামগ্রিক খরচ যদি দেখি তাহলে বাংলাদেশে যে হাসপাতাল হবে সেখানে খরচ কম হবে।

এটা আমার দেশ, আমার সাত পুরুষের দেশ। কলকাতায় জন্মেছি, আমি ভারতের নাগরিক। পশ্চিমবঙ্গে থাকি, কিন্তু এ আত্মিক জোরটাই আমাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

জাগো নিউজ: ভারতে ডিসান হাসপাতাল কতটা বিস্তৃতভাবে রোগীদের সেবা দিতে পারছে?

সজল দত্ত: ভারতে আমাদের চারটি শাখা। এখন দুটির কার্যক্রম চলছে। কলকাতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কার্ডিয়াক, নিউরো, ক্যানসার, গ্যাস্ট্রো এবং তার সঙ্গে আছে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট। এছাড়া নেফ্রোলজির পুরোটা, তার সঙ্গে অ্যাডভান্স করছি বোনমেরু ট্রান্সপ্ল্যান্ট। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, পূর্ব ভারতে প্রথম হাসপাতাল যার ছাদে হেলিপ্যাড আছে। সেই হেলিপ্যাডের পারমিশনটা আমরা শিগগির পেয়ে যাবো। হেলিপ্যাডটা তৈরি হয়ে গেছে। এতে অনেক সুবিধা রয়েছে। আজ যশোর থেকে যদি কেউ মনে করে আমার একটা ক্রিটিক্যাল রোগী আছে সিসিইউ বা আইসিইউতে আমি শিফট করবো, সেক্ষেত্রে যশোর হেলিপ্যাড থেকে সোজা কলকাতা আমাদের হাসপাতালে নামতে পারবে। সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে সামনের বছর। এ সুবিধা একমাত্র ডিসানেরই আছে। আরেকটি বিষয়, আমাদের শিলিগুড়ির হাসপাতালে রংপুর থেকে বেশি রোগী আসে, কারণ রংপুর বর্ডারের সঙ্গে শিলিগুড়ি।

আরও পড়ুন>> জরায়ুমুখ ক্যানসার প্রতিরোধে সেপ্টেম্বরে টিকাদান শুরু

বাংলাদেশকে আমরা (ভারত) ইন্টারন্যাশনাল ভাবি, যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে ভাবি না, আমি মনে করি আমরা একই বন্ধনে আছি। ভারতে কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল রোগীদের ভারতের রোগীদের তুলনায় রেট ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি হয়। আমরা প্রথম থেকেই ঠিক করেছি বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে যাবেন, সেসব রোগীর যে রেট হবে তা একই হবে (ভারতের রোগীদের সমান)। এটা আমাদের একটি বৈশিষ্ট্য। তাতে সার্বিক খরচটা কিন্তু কম পড়ে। সেজন্য অনেক মানুষ আমাদের হাসপাতালে আসেন। একই রেট রাখায় একটা স্বচ্ছতা থাকে। আমি বনগাঁও থেকে এলাম আমার একটা রেট, আবার আমি ২৫ কিলোমিটার দূরে যশোর থেকে এলাম আমার ৩০ শতাংশ বেশি হবে- আমি এতে বিশ্বাস করি না।

ভারতে কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল রোগীদের ভারতের রোগীদের তুলনায় রেট ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেশি হয়। আমরা প্রথম থেকেই ঠিক করেছি বাংলাদেশ থেকে যারা ভারত যাবেন, সেসব রোগীর যে রেট হবে তা একই হবে (ভারতের রোগীদের সমান)।

জাগো নিউজ: বাংলাদেশের চিকিৎসাক্ষেত্রে আরও বিনিয়োগ আসা উচিত বলে মনে করেন?

সজল দত্ত: আরও বিনিয়োগ আসবে। প্রথম হলো- কে প্রথমে সুষ্ঠুভাবে এখানে হাসপাতাল করতে পারে। এটার দিকে শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের সব হাসপাতাল তাকিয়ে থাকবে। কারণ, সবাই জানবে এখানে একটি বিনিয়োগের সুযোগ আছে। কিন্তু প্রথমে কেউ হয়তো এগিয়ে আসে না। প্রথমে হয়তো ভাবে আরে দেখি না কী হয়। আমার যেহেতু একটি আত্মিক যোগ আছে বাংলাদেশের সঙ্গে, আমি বলছি একজনের তো প্রথমে এগিয়ে যাওয়া উচিত। তাই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা সফল হলেই দেখবেন প্রচুর আসবে। এটি শুধু হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ নয়, এটি কিন্তু আরও বেশি বিনিয়োগের সুযোগ করে দেবে, ভারতের হাসপাতালগুলো দেখবে এখানে একটি প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে চলছে। ডিসান একটি হাজার বেডের হাসপাতাল করলো, তাতে বাংলাদেশের সব রোগী ভারতে যাওয়া বন্ধ হবে তা নয়। অল্প সংখ্যক রোগীর চিকিৎসার জন্য আমাদের এখানে জায়গা হবে, তার বেশি জায়গা হবে না, এত বেশি রোগী যান ভারতে। সবাই জানেন, আমাদের মতো হয়তো আরও ৫০টি হাসপাতাল হতে পারে বাংলাদেশে, কিন্তু ওরা প্রথম ধাপটা দেখবে। কারণ এটা একটা ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট। সেজন্য সবাই দেখছে এটা কী হয়, তারপরই ফলো করবে।

জাগো নিউজ: হাসপাতাল তৈরির জন্য কোন এলাকা আপনারা নির্ধারণ করেছেন? কোনো জটিলতায় পড়তে হচ্ছে কি?

সজল দত্ত: আমরা চারটি জায়গা প্রাথমিকভাবে ধরে রেখেছি, যেখানে আমাদের আরও রিসার্চ করতে হবে, কোথায় হাসপাতাল করায় সুবিধা আছে। প্রথম হচ্ছে ঢাকা, তারপর চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনা। এর মধ্যে একটি জায়গা আমরা বেছে নেবো। এরপর সেখানে কাজ শুরু করবো। আমাদের এক হাজার কোটি টাকায় একটাই বড় হাসপাতাল হবে।

আরও পড়ুন>> দেশে গবেষণা বাড়াতে গবেষকদের ঝোঁক থাকতে হবে

জাগো নিউজ: বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসাসেবা নেওয়ার বিষয়ে কোনো পরামর্শ আছে কি?

কোনো রোগীই কিন্তু একবার গিয়ে সম্পূর্ণ চিকিৎসা পাবেন, আর কোনো দরকার লাগবে না সেটি বলা যায় না। সুতরাং, সামগ্রিক খরচ যদি দেখি তাহলে বাংলাদেশে যে হাসপাতাল হবে সেখানে খরচ কম হবে।

সজল দত্ত: ডিসান চিরকালই এটাকে ব্যবসার চোখে দেখে না। ডিসান দেখে এটা একটা মানবসেবার জায়গা। আমাদের তো খরচা হয়ই, সেই খরচটা যেন উঠে আসে সেটিই আমরা দেখি। সেজন্যই অনেকে বাংলাদেশি রোগীদের কাছ থেকে ৩০ শতাংশ রেট বেশি নেয়, কিন্তু আমরা নেই না। ডিসানে আসুন, ডিসান থেকে কোনো সমস্যা হলে ওটা সঙ্গে সঙ্গে ডেকে নেওয়া হয়। আমরা আরও এগিয়ে যাবো, ডিসানের সঙ্গে যেন টোটাল যোগাযোগ হয়। একটা সার্জারি হলেই তার চিকিৎসা শেষ হয় না, তাকে বারবার আসতে হয়। সেজন্য আমরা টেলিমেডিসিন সেবার কথা এখানে বলছি, এই সেবাটি ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট- এই চারটি জায়গায় থাকবে। যারা চিকিৎসা করে আসবে তাদের কোনো আসুবিধা হলে আবার যেন কলকাতা আসতে না হয়। এখান থেকে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে যতটা সম্ভব আমাদের সব ডিজিটাল ফাইল করা থাকবে, আমরা দেখে নেবো। ভারতের চিকিৎসকরাও এখানে থাকবেন। এখানকার চিকিৎসকদের সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগ থাকবে, তারা বলে দেবেন।

আরও পড়ুন>> ভারতে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছেন সম্রাট

জাগো নিউজ: বাংলাদেশের সঙ্গে আপনার আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে বলছিলেন, সে বিষয়ে একটু শুনতে চাই-

সজল দত্ত: আমার সাতপুরুষ খুলনার। বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে কলকাতা চলে যান। সেখানেই আমার জন্ম। সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যাই, পরে তো ব্যবসা করি। আমার সাত পুরুষের জায়গা, তাই আমি খুলনায় ঢুকলাম। একটা কিছু করার দরকার আছে এদেশের জন্য। এটা আমার দেশ, আমার সাতপুরুষের দেশ। কলকাতায় জন্মেছি, আমি ভারতের নাগরিক। পশ্চিমবঙ্গে থাকি, কিন্তু এ আত্মিক জোরটাই আমাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

আইএইচআর/ইএ/এএসএ/জেআইএম