মতামত

এক মানবিক মায়ের কথা

গোয়েন্দা প্রতিবেদনের একটি তথ্য, ১৯৫৮ সালে বঙ্গবন্ধুর সাথে প্রথমবারের মতো কারাগারে দেখা হয় শিশু রেহানার। যখন তার বয়স দুই বছর। শেখ হাসিনার বয়স লেখা ১০ বছর ১১ মাস (আনুমানিক)। পরের সাক্ষাৎ ছিল ২৮ নভেম্বর। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, বেগম মুজিব তার স্বামীকে সাক্ষাতের সময় বলেন, সিদ্ধেশ্বরী এলাকার কোয়ার্টারে সন্তানদের নিয়ে বসবাস করা সম্ভব নয়। এলাকাটি ঝোপ-জঙ্গলে ভরা। পানির কষ্ট। তিনি দালালদের মাধ্যমে নতুন একটি বাড়ি ভাড়া নিতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু সবাই বলছে- শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারকে বাড়ি ভাড়া দিলে বিপদ হবে। শেখ মুজিব স্ত্রীকে বলেন, উপযুক্ত বাড়ি না পেলে ছেলেমেয়েদের ফাইনাল পরীক্ষার পর যেন টুঙ্গিপাড়ায় গ্রামের বাড়ি চলে যায়।

Advertisement

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ মাতৃকার জন্য লড়াই করছেন। অপরদিকে পরিবার ও সন্তান-সন্ততি লালন-পালনসহ কঠিন সংগ্রাম চলতে থাকে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের। ইতিহাসের নানা পরিক্রমায় তাঁর অবদান সুপ্ত অবস্থায় রয়ে গেছে। স্বামীকে তিনি বাধা না দিয়ে বরং দিয়েছেন অনুপ্রেরণা। রাজনীতির অন্তরালে যোদ্ধার মতো কাজ করেছেন স্বামীর সহযাত্রী হিসেবে। একই সঙ্গে ছেলেমেয়েদের দিয়েছেন নৈতিক ও মূল্যবোধের শিক্ষা।

তেমনি কারাগারের রোজনামচায় আরেকটি চিত্র ফুটে ওঠে- জেল গেটে যখন উপস্থিত হলাম ছোট ছেলেটা আজ আর বাইরে এসে দাঁড়াইয়া নাই দেখে একটু আশ্চর্যই হলাম। আমি যখন রুমের ভেতর যেয়ে ওকে কোলে করলাম আমার গলা ধরে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কয়েকবার ডাক দিয়ে ওর মার কোলে যেয়ে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে ডাকতে শুরু করল। ওর মাকে ‘আব্বা’ বলে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ব্যাপার কি?’ ওর মা বলল, বাড়িতে ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ করে কাঁদে তাই ওকে বলেছি আমাকে ‘আব্বা’ বলে ডাকতে। রাসেল ‘আব্বা আব্বা’ বলে ডাকতে লাগল। যেই আমি জবাব দেই সেই ওর মার গলা ধরে বলে, ‘তুমি আমার আব্বা। আমার ওপর অভিমান করেছে বলে মনে হয়। এখন আর বিদায়ের সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায় না।

বঙ্গবন্ধুর লেখায়- বঙ্গমাতার দৃঢ় সংকল্প ও দায়িত্ববোধ পরিলক্ষিত হয়। সন্তান যখন তার পিতাকে পায় না, তখন নিজেই পিতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। সন্তানরা পিতার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হলেও তাদের কষ্ট–বেদনা লাঘবের জন্য চেষ্টা করেছেন সর্বোচ্চ। এখানে বঙ্গমাতা পরিবার ও স্বামী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের চালিকাশক্তি হিসেবে সর্বদা কাজ করেছেন সেটা প্রকাশ পেয়েছে।

Advertisement

একইভাবে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে ফুটে ওঠে স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা ও অনুপ্রেরণা-রেণু আমাকে যখন একাকি পেল, বলল, জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছেন, আমার কেউই নাই। তোমার কিছু হলে বাঁচব কি করে? কেঁদেই ফেলল। আমি রেণুকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তাতে ফল হলো উল্টা। আরও কাঁদতে শুরু করল, হাচু ও কামাল ওদের মা’র কাঁদা দেখে ছুটে গিয়ে গলা ধরে আদর করতে লাগল। আমি বললাম, খোদা যা করে তাই হবে, চিন্তা করে লাভ কি? পরের দিন ওদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। মাকে বোঝাতে অনেক কষ্ট হলো।

 

শেখ ফজিলাতুন নেছা এদেশের মানুষের কাছে বঙ্গমাতা হিসেবে পরিচিত। শেখ ফজিলাতুন নেছা মনেপ্রাণে একজন আদর্শ বাঙালি নারী ছিলেন। স্বামীর রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। তিনি ছিলেন দানশীল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ মানুষকে মুক্তহস্তে দান করতেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, কারাগারে আটক নেতাকর্মীদের খোঁজ-খবর নেওয়া ও পরিবার-পরিজনের যে কোনো সংকটে পাশে দাঁড়াতেন।

 

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছার স্বামীর প্রতি ভালোবাসা প্রস্ফুটিত হয়েছে। একইসাথে পারিবারিক বন্ধন ও অনিশ্চয়তার মধ্যেও স্বামীকে দেশের জন্য লড়াই করতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। যার ত্যাগের বিনিময়ে ও অনুপ্রেরণায় খোকা থেকে শেখ মুজিব, শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হওয়ার পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করা মহীয়সী নারী হলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব।

আজ ৮ আগস্ট, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জন্মদিন। ১৯৩০ সালের এইদিনে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ডাক নাম রেণু। পিতা শেখ জহুরুল হক চাকরিসূত্রে যশোর থাকায় দাদা শেখ কাশেমের ছোট সংসারে মা ও বড় বোনের স্নেহছায়ায় তাঁর বেড়ে ওঠা। মাত্র তিন বছর বয়সে তিনি বাবা ও পাঁচ বছর বয়সে মাকে হারান। দাদা শেখ কাশেম শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কিশোরী বয়সেই শেখ ফজিলাতুন নেছার বিবাহ দেন। তখন থেকে বেগম ফজিলাতুন নেছাকে শাশুড়ি (বঙ্গবন্ধুর মা) নিজের সন্তানদের সঙ্গে মাতৃস্নেহে লালন-পালন করেন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে তিনি প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ করেন।

Advertisement

এই বদ্বীপের রাজনীতিতে নেপথ্যচারিণী ও প্রেরণাদায়িনী মহীয়সী নারী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। তাই শেখ ফজিলাতুন নেছা এদেশের মানুষের কাছে বঙ্গমাতা হিসেবে পরিচিত। শেখ ফজিলাতুন নেছা মনেপ্রাণে একজন আদর্শ বাঙালি নারী ছিলেন। স্বামীর রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। তিনি ছিলেন দানশীল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ মানুষকে মুক্তহস্তে দান করতেন। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, কারাগারে আটক নেতাকর্মীদের খোঁজ-খবর নেওয়া ও পরিবার-পরিজনের যে কোনো সংকটে পাশে দাঁড়াতেন।

বঙ্গবন্ধু জেলে থাকার সময় আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতিটি ঘটনা জেলখানায় সাক্ষাতে বঙ্গবন্ধুকে জানাতেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশ নিয়ে আসতেন বঙ্গমাতা। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে সে নির্দেশ জানাতেন, নেপথ্যে থেকে তিনি ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণের পূর্বে বাড়িতে বঙ্গমাতার দেওয়া পরামর্শ বঙ্গবন্ধুর ভাবাবেগকে তাড়িত করেছিল।

শেখ ফজিলাতুন নেছা কেবল একজন রাষ্ট্রনায়কের সহধর্মিণীই ছিলেন না, ছিলেন বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম অনুপ্রেরণাদাত্রী। এই মহীয়সী নারী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে দেশ ও জাতির সেবা করে গেছেন। শান্ত স্বভাবের শেখ ফজিলাতুন নেছা স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার কারণে এবং খুব অল্প বয়স থেকে রাজনীতির সঙ্গে স্বামীর গভীর সাহচর্যে হয়ে উঠেছিলেন রাজনৈতিক সচেতন আদর্শ বাঙালি নারী। যার চিরায়ত রূপ ধরা পড়ে তাঁর চরিত্রে। তাই অসীম ধৈর্য ও সাহস নিয়ে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতেন। এমনকি ছাত্ররাজনীতি করতে গিয়ে যখনই বঙ্গবন্ধুর অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজন হতো তখনও পিতার সম্পত্তি থেকে অর্জিত অর্থ বিনা দ্বিধায় প্রেরণ করতেন।

বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ এবং সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ শীর্ষক বইয়ে সংসার ও রাজনৈতিক জীবনের বর্ণনায় বার বার পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন নেছার নাম উঠে এসেছে। এ দুইজন তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে শুধু সমর্থনই করতেন না, বরং কষ্ট করে টাকা জমিয়ে রাজনীতি করার জন্য অর্থ সাহায্য করতেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে স্বামী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ ও আত্মীয়স্বজনসহ ষড়যন্ত্রকারীদের গুলিতে শাহাদতবরণ করেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা । জীবনযুদ্ধে ঘাত-প্রতিঘাতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক মানবিক মায়ের জীবনের উপাখ্যান ইতিহাসের পাতায় থাকবে অম্লান। তাঁর জন্মদিনে জানাই অতল শ্রদ্ধা।

লেখক: প্রতিবেদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস