‘খামার চালাতে এখন প্রতি বছর একটি করে গাভী বিক্রি করে হালখাতায় দোকানের বাকি শোধ করি। দেড় যুগ আগে খামার শুরু করে এখন তা চালু রাখতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছি।’ কথাগুলো বলছিলেন পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বন্দীরামচরের বাসিন্দা দুগ্ধ খামারি রফিকুল ইসলাম (৫৫)।
Advertisement
তিনি জানান, গো-খাদ্যের দাম যে হারে বেড়েছে সে হারে দুধের দাম না বাড়ায় খামারিরা সংকটে পড়েছেন। এরমধ্যে মিল্কভিটাসহ দুগ্ধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দুধ সংগ্রহ কমিয়ে দেওয়ায় সংকট আরও বেড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বৃহত্তর পাবনা অঞ্চলে প্রতিদিন প্রায় আড়াই লাখ লিটারের বেশি দুধ উৎপাদন হয়। দুগ্ধ উৎপাদনকারীরা পাবনার ভাঙ্গুড়া ক্রয় কেন্দ্র, সিরাজগঞ্জের লাহিড়ী মোহনপুর ও বাঘাবাড়ি মিল্কভিটায় প্রতিদিন প্রায় দেড় লাখ লিটার দুধ সরবরাহ করেন। এ অঞ্চলে প্রায় এক হাজার দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমিতির মাধ্যমে এ দুধ সরবরাহ হয়। সমিতিভুক্ত মোট সদস্যের সংখ্যা ৫০ হাজার। সমিতির বাইরেও কয়েক হাজার খামারি দুধ সরবরাহ করে থাকেন। এছাড়াও ৭৫ থেকে ৮০ হাজার লিটার দুধ বিভিন্ন বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান এবং ২৮ থেকে ২৯ হাজার লিটার দুধ ঘোষরা (দুধ ব্যবসায়ী) কিনে থাকেন।
খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ১০ বছরের মধ্যে গো-খাদ্যের দাম ৫-৬ গুণ বেড়ে যাওয়ায় খামারিরা মহাসংকটে পড়েছেন। ১০ বছর আগে এক কেজি গমের ছাল ছিল ৮-১০ টাকা কেজি। এখন সেই গমের ছাল প্রতি কেজির দাম ৬০-৬২ টাকা। এখন একমণ খেসারি ভূষির দাম ১৪০০ টাকা। যে ভূষি আগে খামারিরা কিনতেনই না। একমণ খড়ের দাম এখন ৫০০ টাকা। সেই খড় আবার ৩০-৩২ কেজিতে মণ ধরা হয়। সে হিসাবে ১ কেজি খড়ের দাম ১৫ টাকা।
খামারিরা জানান, প্রতি শতাংশ জমির জাম্বু ঘাস কিনতে হচ্ছে ৩০০ টাকা দরে, প্রতি শতাংশ জমির নেপিয়ার ঘাস ৪০০ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। গো-খাদ্যের দাম কমানো না হলে কিংবা খামারিদের ভর্তুকি মূল্যে গো-খাদ্য না দিলে তাদের পক্ষে খামার রাখা অসম্ভব হয়ে যাবে।
Advertisement
খামারিরা বলছেন, দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই খামারিদের প্রধান ভরসার জায়গা। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান দুধের সঠিক দাম দিচ্ছে না। দাম কিছুটা বৃদ্ধি করলেও চাহিদা কমে যাওয়ার অজুহাতে এসব প্রতিষ্ঠান খামারিদের কাছ থেকে দুধ কেনাও কমিয়ে দিয়েছে।
খামারিদের দাবি, গোখাদ্যের দাম দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় প্রতি লিটার দুধের উৎপাদন খরচ পড়ে ৭০ টাকার কাছাকাছি। কিন্তু দুধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি লিটার দুধের দাম দিচ্ছে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা।
পাবনার বেড়া পৌরসভার দক্ষিণপাড়ার আদনান ডেইরি ফার্মে ১১টি গরু রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি গাভী। খামারের মালিক আবদুল আউয়াল বলেন, প্রতিটি গাভির খাবারের পেছনে তার প্রতিদিন খরচ হচ্ছে ৫০০ টাকা। প্রতিটি গাভি থেকে গড়ে দৈনিক দুধ পান ছয় থেকে সাত লিটার। প্রতি লিটার দুধ ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি করছেন। এতে তিনি দৈনিক খরচই তুলতে পারছেন না।
সাঁথিয়া উপজেলার আমাইকোলা গ্রামের ছানার কারখানা সরকার ট্রেডার্সে গিয়ে দেখা যায় খামারিরা সেখানে দুধ নিয়ে ভিড় করেছেন। দুধের দাম দেওয়া হচ্ছে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা লিটার। তাও সব খামারির দুধ নেওয়া হচ্ছে না।
Advertisement
কারখানাটির ব্যবস্থাপক মো. রাশেদুল জানান, ছানা তৈরির জন্য আগে আরও বেশি দুধ সংগ্রহ করা হতো। কিন্তু চাহিদা কমায় এখন প্রতিদিন ৩০ মণ দুধ সংগ্রহ করা হচ্ছে। অনেক খামারি দুধ দিতে চাইলেও সবার দুধ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানগুলো এখন নিজেদের নির্দিষ্ট কিছু খামারি ছাড়া আর কারো কাছ থেকে দুধ কিনছে না। এমনকি সেই খামারির পুরো দুধও তারা নিচ্ছে না। বাধ্য হয়ে খামারিরা উদ্বৃত্ত দুধ খোলা বাজারে, ছানার কারখানায় কমদামে বিক্রি করছেন। এতে তাদের ব্যাপক লোকসান হচ্ছে।
ফরিদপুর উপজেলার রতনপুর গ্রামের দুগ্ধ খামারি, দুধের ব্যাপারি এবং একইসঙ্গে গো-খাদ্য বিক্রেতা হযরত আলী জানান, আগে তিনি প্রতিদিন ১২০ লিটার দুধ মিল্কভিটায় দিতেন। এখন দিতে পারছেন মাত্র ২০ লিটার। এতে দাম পাচ্ছেন প্রতি লিটারে ৫০ টাকার কাছাকাছি (ফ্যাট ভেদে দাম কম-বেশি হয়)।
তিনি জানান, মিল্কভিটার দেওয়া দামেও তারা খুশি হতে পারছেন না। কারণ তারা দুধই বিক্রি করতে পারছেন না। দাম বেশি হলে লাভ কী? মিল্কভিটায় দুধ সরবরাহ করতে না পারায় তিনি স্থানীয় বাজারে বা ছানা ব্যবসায়ীদের কাছে দুধ বিক্রি করছেন। এতে খামারিরা ও ব্যাপারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে তিনি জানান।
বেড়া উপজেলা ডেইরি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজা খানম বলেন, গত রমজান মাসে খামারিরা কিছুটা লাভের মুখ দেখেছিলেন। কিন্তু এর আগে ও পরে বিশেষ করে এখন ব্যাপক লোকসান দিতে হচ্ছে। তারা হিসাব করে দেখেছেন গো-খাদ্যের বেশি দামের কারণে প্রতি লিটার দুধের উৎপাদন খরচ ৭০ টাকার ওপরে দাঁড়িয়েছে। অথচ দাম পাওয়া যাচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা।
সরকারি দুগ্ধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান বাঘাবাড়ী মিল্কভিটার আওতাধীন সাঁথিয়া উপজেলার বোয়ালমারী প্রাথমিক দুগ্ধ সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি বেলায়েত হোসেন জানান, তার সমিতিতে খামারি রয়েছেন ১২৪ জন। প্রতিদিন তাদের সমিতিতে ১ হাজার ২০০ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। অথচ মিল্কভিটা কোটা বেঁধে দিয়ে তাদের কাছ থেকে মাত্র ২৫০ লিটার দুধ কিনছে। বাকি দুধ খোলা বাজারে বা ছানা কারখানায় বিক্রি করছেন তারা।
গরুর ওষুধ বিক্রির প্রতিষ্ঠানের মালিক সাঁথিয়ার ওয়াদুদ হোসেন ঠান্টু জানান, গত ৩-৪ বছর ধরে ওষুধের দাম খুব বেড়ে গেছে। এতে খামারিদের সঙ্গে তার প্রায়ই বচসা লাগে। খামরিরা দাম বৃদ্ধির কারণে ওষুধ কিনতে পারছেন না। এতে তার বেচাকেনা কমে গেছে।
মিল্কভিটার জিএম (প্রশাসন, অর্থ ও নিরীক্ষা) মাহফুজুল হক জানান, এখন দুধের চাহিদা কম। এজন্য কিছুটা কম দুধ সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে খামারিদের দুধের দাম বাড়ানো হয়েছে বলে তিনি জানান।
পাবনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আল মামুন হোসেন মন্ডল জানান, পাবনায় কাঁচা ঘাসের প্রাচুর্য রয়েছে। জেলায় প্রায় ৮ হাজার হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ঘাস চাষ করা হয়। তবে দানাদার খাদ্যের দাম কিছুটা বেশি। সেটাতে ভর্তুকি দেওয়ার ব্যাপারে তার স্থানীয়ভাবে কিছু করার নেই। এটা নীতিনির্ধারকদের বিবেচনার বিষয়। তবে চাষিরা এখন দুধের ভালো দাম পাচ্ছেন এবং লাভবান হচ্ছেন বলে দাবি করেন তিনি। এফএ/এএসএম