দেশজুড়ে

পেয়ারার রাজ্যে পর্যটকের ভিড়, দাম পেলেও হতাশ চাষিরা

ঝালকাঠি সদর, বানারীপাড়া ও স্বরূপকাঠি উপজেলার ৫৫ গ্রামে আছে পেয়ারা বাগান। পেয়ারার মৌসুমে নদী-খাল বেষ্টিত এসব বাগানকে ঘিরে গড়ে ওঠে ভাসমান হাট। আর বাগান ও ভাসমান হাট দেখতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন পর্যটকরা। বিদেশি পর্যটকেরও আগমন ঘটে এখানে।

Advertisement

এখন পেয়ারা বিক্রির উপযোগী হয়েছে। তাই কয়েকদিন ধরে চাষি ও ব্যবসায়ীরা বাগান থেকে পেয়ারা সংগ্রহ করে ভাসমান হাটে নিয়ে আসছেন। আর এই হাটকে কেন্দ্র করে দিনদিন পর্যটকদের সমাগম বাড়ছে। তবে পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় বিগত বছরের তুলনায় এবার পেয়ারার দাম বেশি পেলেও প্রচণ্ড দাবদাহ ও অনাবৃষ্টির কারণে ফলন কম হওয়ায় হতাশ কৃষকরা।

প্রতি বছর আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র-এ তিন মাস পেয়ারার মৌসুম হলেও এবছর ফলন দেরিতে হয়েছে। তাই শ্রাবণে পেয়ারা নামতে শুরু করেছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এ অঞ্চলের ‘সবচেয়ে বড়’ ভাসমান পেয়ার হাট বসে ভীমরুলীতে। এছাড়া হাট বসে ঝালকাঠি জেলার শতদশকাঠি, জগদীশপুর ও মাদ্রা, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠির (নেছারাবাদ) কুড়িয়ানা, আটঘর, আতাকাঠি, বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার নোরারকাঠি, জাম্ভুদ্বীপ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সৈয়দকাঠিতে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, পেয়ারা বাগান ও ভাসমান হাটে পর্যটকে মুখরিত হয়ে উঠেছে। দেশ-বিদেশের ভ্রমণ পিপাসুরা হৈ হুল্লোড়ে মেতেছেন। কেউ গাছ থেকে পেয়ারা পাড়ছেন আবার কেউ ভাসমান হাট থেকে স্বজনদের জন্য কিনছেন পেয়ারা। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে গড়ে উঠেছে পার্ক ও খাবার দোকানসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

Advertisement

জানা যায়, এ এলাকার হাজারো মানুষের কাছে ‘পেয়ারা’ অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ও জীবিকার অবলম্বন। আষাঢ়-শ্রাবণের ভরা বর্ষায় এসব এলাকার নদী-খালজুড়ে পেয়ারার সমারোহ।

কাঁচাবালিয়া গ্রামের পেয়ারাচাষি আল আমিন মিয়া জানান, এবার মৌসুমের শুরুতেই ২০ টাকা কেজি দরে প্রতিমণ পেয়ারা ৮০০ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। পর্যটকদের কাছে খুচরা বিক্রি করলে প্রতিমণ ১ হাজার টাকারও বেশি দাম পাওয়া যায়।

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া থেকে সপরিবারে ভ্রমণে এসেছেন শান্তি রঞ্জন বালা। তিনি বলেন, পেয়ারার ভাসমান হাটের কথা এত বছর ধরে শুনেছি কিন্তু দেখতে পারিনি। এবছর সময় সুযোগ করে সপরিবারে ঘুরতে এলাম। অনেক ভালো লেগেছে। নৌকা ভাড়া করে বাগানে গিয়ে পেয়ারা গাছে উঠে নিজ হাতে পেয়ারা নিয়ে খেতে পেরেছি। এতেই আমাদের ভ্রমণ সফল হয়েছে।

রাজধানীর ওয়ারী এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা তুলসি আক্তার। ঝালকাঠির ভীমরুলীতে পেয়ারার ভাসমান হাট দেখতে এসেছেন তিনিও। তুলসি আক্তার বলেন, এমন একটি ভাসমান বাজার আমাদের দেশে আর নেই। এখানে এসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পেরে খুবই ভালো লাগছে। কতটা যে ভালো লাগছে তা বলে শেষ করতে পারবো না।

Advertisement

বরগুনা থেকে চারটি মোটরসাইকেলে আটজন যুবক আসেন এ ভাসমান পেয়ারার হাট দেখতে। এদের মধ্যে টিম পরিচালনাকারী আফজাল তালুকদার বলেন, এশিয়া মহাদেশে থাইল্যান্ডের পর বাংলাদেশের একমাত্র ভাসমান পেয়ারা বাজার ভীমরুলীতে। এখান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার টন পেয়ারা দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। বাজারটা অনেক সুন্দর।

তিনি আরও বলেন, এখানে আবাসনের কোনো ব্যবস্থা নেই। নেই গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা। ভ্রমণের জন্য ডিঙি নৌকার সংকট আছে। সরকার বা জনপ্রতিনিধি যদি এসবের ব্যবস্থা করেন তাহলে এখান থেকেও প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় হতে পারে।

এখানে শিক্ষাসফরে এসেছেন বরিশাল মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীরা। কলেজের সহকারী অধ্যাপক মাসুম বিল্লাহ এখানকার আবাসন ও শৌচাগারের ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

তিনি বলেন, ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী পেয়ারার বড় মোকাম ভীমরুলীতে কোনো আবাসন ও ভালো শৌচাগারের ব্যবস্থা নেই। এখানে দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটক আসেন। তারা আমাদের ওপর একটা বিরূপ ধারণা নিয়ে যান। দক্ষিণাঞ্চলের এ এলাকায় আরও উন্নয়ন দরকার। এজন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসা উচিত।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক ফারাহ গুল নিঝুম জাগো নিউজকে বলেন, ঝালকাঠির ব্র্যান্ড পেয়ারা ও শীতলপাটি চাষিদের এতদিনের স্বপ্ন পূরণের দ্বার উন্মোচন হয়েছে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে। কারণ বিশ্বের পর্যটকরা এখন সরাসরি ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে ঝালকাঠি এসে পেয়ারা রাজ্যের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারছেন।

তিনি আরও বলেন, পেয়ারা বাগানে এসে উচ্চমাত্রার সাউন্ড বক্স বাজিয়ে পরিবেশ দূষণরোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একাধিক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। প্রথম দিকে কয়েকটি বাক্স জব্দ ও জরিমানা করায় এখন পরিবেশ শান্ত হয়েছে এবং সুষ্ঠুভাবে ভ্রমণের পরিবেশ তৈরি হয়েছে।

পদ্মা সেতুর কারণে পেয়ারা বাজার ভালো হলেও এবার বৃষ্টি না হওয়ায় এবং দাবদাহে পেয়ারার ফলন কম হয়েছে। এতে কৃষক তুলতে পারবেন না বলে হতাশা প্রকাশ করেছেন।

চাষিরা জানান, আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবে অর্ধেকেরও কম ফলন হয়েছে। পেয়ারা গাছে যে পরিমাণ ফুল এসেছিল এবছর বৃষ্টিপাত না হওয়ায় তা অনেকটাই ঝরে গেছে। গাছ পুড়ে গেছে এমন মনে হয়। পেয়ারা বাজার ভালো হলেও লাভবান হতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন চাষিরা।

কৃষক পঙ্কজ বড়াল বলেন, মাঘ-ফাল্গুন মাসে পেয়ারা গাছের গোঁড়া পরিষ্কারের পর সার প্রয়োগ করতে হয়েছে। কাদামাটি দিয়ে গোঁড়া ঢেকে দিয়েছি। তাতে প্রতিটা গাছের গোঁড়ায় গড়ে ৩০০ টাকারও বেশি ব্যয় হয়েছে। পেয়ারা গাছে যে পরিমাণ ফুল এসেছিল এবছর বৃষ্টিপাত না হওয়ায় তা অনেকটাই ঝরে গেছে। লাভ তো দূরের কথা, আসল খরচের টাকাই ওঠে কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।

কৃষক দেবব্রত হালদার বিটু বলেন, পেয়ারা আমাদের মৌসুমি আয়ের একমাত্র অবলম্বন। পেয়ারার ফলন ভালো হলে আমাদের সচ্ছলতা আসে। ভাসমান হাটে বছরে কোটি টাকার লেনদেন হয়। অস্থায়ী কিছু দোকান পাট বসে পাইকার, পর্যটক/দর্শনার্থীদের আপ্যায়নের বা ক্ষুধা নিবারণের মাধ্যমে ব্যবসার করে আর্থিকভাবে লাভবান হন বিক্রেতারা। কিন্তু পেয়ারার ফলন কম হওয়ায় পাইকার আগমনসহ সবকিছুতেই এর একটা খারাপ প্রভাব পড়ছে। যা নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।

তিনি আরও বলেন, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসেই পেয়ারা গাছে ফুল আসতে শুরু করে। তবে বৃষ্টি শুরু না হলে পেয়ারা পরিপক্ব হয় না। জমি ভালো হলে হেক্টর প্রতি ১২-১৪ টন পেয়ারার উৎপাদন হয়। কিন্তু এবছর জ্যৈষ্ঠ মাসে অনাবৃষ্টির কারণে ফুল ঝরে যাওয়ায় পেয়ারার ফলন অনেক কম হয়েছে।

পর্যটক ব্যবসায়ী নিশিথ হালদার বলেন, পেয়ারা মৌসুমকে ঘিরে দেশি-বিদেশি হাজার হাজার পর্যটক আসেন। আগে শুধুমাত্র নৌপথে আসতেন। এখন পদ্মা সেতুর সুবাদে সড়ক পথেও আসছেন। পর্যটকদের সংখ্যাও গতবছর থেকে বেড়েছে। পেয়ারা চাষিদের বাগানে ঢুকে ক্ষতি সাধন হওয়ায় আমরা পেয়ারা বাগানে নান্দনিক ভ্রমণের সুযোগ করেছি। কিন্তু এবছর যেভাবে পেয়ারার ফলন তাতে তেমন পর্যটক বা দর্শনার্থীরা আসবেন বলে মনে হয় না। কারণ পর্যটক বা দর্শনার্থীরা ফেরার সময় কিছু পরিমাণ পেয়ারা কিনে নিয়ে যান। পেয়ারার ফলন কম হওয়ায় সবদিক থেকেই লোকসানের মুখে পড়ছে এখানকার লোকজন।

পেয়ারা চাষি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ভবেন হালদার জাগো নিউজকে বলেন, কৃষির ফলনে সবচেয়ে সুবিধাজনক হলো স্বাভাবিক মাত্রায় বৃষ্টি। কিন্তু এবছর পেয়ারা গাছের পরিচর্যা সঠিকভাবে করা হলেও বৃষ্টি না থাকায় যে পরিমাণে ফুল এসেছিল তার বেশিরভাগই ঝরে গেছে। এখন পেয়ারা গাছে যে পরিমাণ ফল আছে তাতে খরচ পোষানোই দুঃসাধ্য ব্যাপার।

ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. মনিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, দাবদাহ ও অনাবৃষ্টির কারণে পেয়ারার ফলন কম হলেও পদ্মা সেতুর কারণে দাম অনেক বেশি পাচ্ছেন। এতে ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবেন। এ বছর হেক্টর প্রতি সাড়ে ১১ থেকে ১২ টন পেয়ারার ফলন হয়েছে।

এসজে/এমএস