জাগো জবস

জাবীরের বিসিএসে পুলিশ ক্যাডার হওয়ার গল্প

জাবীর হুসনাইন সানীব ৪০তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে (মেধাক্রম-১৯) উত্তীর্ণ হয়েছেন। তার জন্ম কিশোরগঞ্জ জেলায় হলেও বেড়ে ওঠা রাজধানী ঢাকায়। তিনি বিজ্ঞান বিভাগে ঢাকার এ কে উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে এসএসসি এবং ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন।

Advertisement

বর্তমানে তিনি ‘সহকারী পুলিশ সুপার’ হিসেবে প্রশিক্ষণরত আছেন। তার ক্যাডার হওয়ার গল্প, বাধা-বিপত্তি ও নতুনদের পরামর্শ নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম-

ক্যাডার পেয়ে অনুভূতিশূন্য হয়ে গিয়েছিলামরেজাল্ট চেক করে প্রথম পছন্দ পুলিশ পেয়ে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বারবার চেক করে দেখছিলাম রোল ঠিক দেখেছি কি না। এত পরিশ্রম, এত স্যাক্রিফাইস, সবার এত দোয়া, বছরের পর বছর রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা কিন্তু বিসিএসে পুলিশ ক্যাডার পেয়ে অনুভূতিশূন্য হয়ে গিয়েছিলাম। আজ পর্যন্ত আমি জানি না সত্যিকার অর্থেই আমার অনুভূতি কী। রেজাল্টের পর পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবার খুশি দেখে অবশ্য ভীষণ ভালো লেগেছিল।

পুলিশ ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখতামছোটবেলা থেকেই আমার দেশের বাইরে চলে যাওয়ার ইচ্ছা ও পরিকল্পনা ছিল। মূলত বাইরে যাওয়ার লোভেই জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য পরিবারের সবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সব ঠিক ছিল কিন্তু থিসিস করতে গিয়ে আমি বুঝতে পারি, এভাবে দিনের পর দিন ল্যাবে দাঁড়িয়ে থেকে রিসার্চ করা আর ল্যাপটপের সামনে বসে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। হলের রিডিং রুমে দেখতাম সিনিয়র ও ব্যাচমেটরা বিসিএসের প্রস্তুতি নিতো। আরও কিছু কারণে আমি ঠান্ডা মাথায় ভেবে বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত মাথা থেকে ঝেরে ফেলি। এরপর পুলিশ ক্যাডার হওয়ার জন্য পড়াশোনা করবো বলে মন থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। বিসিএস বলতে আমি তখন শুধু পুলিশ ক্যাডারই বুঝতাম।

Advertisement

আরও পড়ুন: বিসিএস লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি: ইংরেজি 

যেভাবে বিসিএসের প্রস্তুতি নিয়েছিখাবা (খান বাহাদুর আহসানউল্লা) হলে মসজিদের পাশেই ছিল রিডিং রুম। নামাজ পড়তে এসে সব সময় দেখতাম কিছু সিনিয়র ভাই, বন্ধু বিসিএসের পড়াশোনা করছেন। অনার্স শেষ হওয়ার আগেই দিন-রাত ধৈর্য ধরে এভাবে বন্ধুদের পড়তে দেখে অবাক হয়ে তাদের খোঁচা মারতে রিডিং রুমে যেতাম। বিসিএস সম্পর্কে এভাবেই আমি প্রথমে জানতে পারি। আমার বিসিএস প্রস্তুতি ছিল সাদামাটা, অত্যন্ত সস্তা। আমি প্রিলি, রিটেন, ভাইবার জন্য নির্দিষ্ট একটি সিরিজের এক সেট করে বই কিনে নিয়েছিলাম। তবে আমি নিজের মতো করে ভুলে যাওয়ার মতো পড়াগুলো নোট করতাম, যেন রিভাইস দিতে সহজ হয় আর মনেও থাকে। আমাকে বিসিএসের খুঁটিনাটি জানতে এবং প্রিপারেশন নিতে সাহায্য করেছেন হলের সিনিয়র ভাইয়েরা। ফিজিক্সের নাসরুল্লাহ ভাই আমাকে লিখিত ও ভাইবা পরীক্ষায় কী পড়তে হবে, কীভাবে লিখতে হবে, কীভাবে উত্তর দিতে হবে সার্বিক বিষয়ে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করেছেন। আমি আর ভাই একসঙ্গে ক্যাডার হয়ে বিপিএটিসি ট্রেনিং করেছি।

নিজ সিদ্ধান্ত থেকেই অনুপ্রেরণা পাইবন্ধু-বান্ধবদের দেখাদেখি বা পরিবারের অনুপ্রেরণায় বিসিএস ক্যাডার হওয়া বর্তমান প্রতিযোগিতায় এখন আর সম্ভব নয় বলে মনে করি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে যার যত চাকরির জন্য ক্ষুধা তথা পরিশ্রম বেশি, তিনি তত দ্রুত সাফল্য পাবেন। পারিবারিক সাপোর্ট বিসিএসে সফল হওয়ার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ক্যাডার হওয়ার জন্য যে পরিমাণ স্যাক্রিফাইস করতে হয়; সেজন্য নিজের মন থেকে না চাওয়ার কারণে মাঝপথেই অনেকে হাল ছেড়ে দেন। অনেকে বছরের পর বছর কষ্ট করে যান কিন্তু আশানুরূপ সাফল্য না পেয়ে হতাশ হয়ে যান। বিসিএসের প্রিপারেশন সঠিকভাবে নিলে যে কোনো চাকরির পরীক্ষায় সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। সার্বিক বিবেচনায় গ্র্যাজুয়েশনের পর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যে করেই হোক প্রশাসনে চাকরি করবো। না হয় দেশের বাইরে চলে যাবো। নিজের মন থেকে নেওয়া এ সিদ্ধান্তকেই আমি আমার জন্য সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা মনে করি।

আরও পড়ুন: বিসিএস লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি: বাংলা 

Advertisement

যত বাধা-বিপত্তির জয়বিসিএসের লম্বা যাত্রাপথ কারো জন্যই মসৃণ হয় না। সব প্রার্থীর মতো বিসিএসের প্রতিটি স্টেপেই আমারও বাধা-বিপত্তি ছিল। প্রিপারেশন নেওয়ার সময় আড্ডা, খেলা, মুভি দেখা অহেতুক সময় নষ্ট করা সব বাদ দিয়ে পড়তে গিয়ে কিছুদিন পরপর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বোধ করতাম, রাগ করে পড়তে চাইতাম না। তখন কয়েকদিন বইয়ের ধারে-কাছে না গিয়ে যা মন চায় করতাম, খেতাম, ঘুরতাম, যত মুভি দেখা যায় দেখতাম। মন শান্ত হলে আবার পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে চিন্তা করে ১-২ দিন পরই পড়তে বসতাম। চাকরির প্রস্তুতির শুরু থেকেই কেবল প্রশাসনে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় অন্য কোনো সরকারি পরীক্ষায় অংশ নিতাম না। হল থেকে সবাই যখন ব্যাংকসহ অন্য পরীক্ষায় গ্রুপ বেধে অংশ নিতে যেতো; তখন আমি রিডিং রুমে বসে ভাবতাম ভুল করছি কি না। কিন্তু বারবার ঢাকা আসা-যাওয়া ও অন্য কারণে আমার বিসিএসের প্রস্তুতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভেবে আমি কেবল বিসিএস ও এনএসআইর সরকারি চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছি। এনএসআইয়ে সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ পেয়ে সীমান্তবর্তী গুরুত্বপূর্ণ একটি উপজেলার ইউনিট ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্বরত থাকাকালীন ৪০তম বিসিএস ভাইবার তারিখ পড়লে জানতে পারি, এনএসআই থাকাকালীন ভাইবা দেওয়া যাবে না। দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সীমান্তের এপার-ওপারে কাজ করার কারণে ছুটি না পাওয়ায় ৪১-৪৩তম বিসিএস বা আর কোনো বিসিএস বা সরকারি চাকরি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারিনি। তাই ৪০তমের ভাইবাই ছিল কার্যত আমার শেষ সুযোগ বিসিএসের। ভাইবা দিলে তৎকালীন চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে হতো। আর গোপনে না বলে দিলে চাকরিতে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ভয় থেকে ভাইবায় অংশগ্রহণ করবো কি করবো না এটাই ছিল সবচেয়ে বড় মানসিক বাধা।

প্রস্তুতিতে সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার সোশ্যাল মিডিয়ায় এখনো যে পরিমাণ সময় নষ্ট করি, তা তখন করলে আর ক্যাডার হওয়া লাগতো না। হলে বিসিএস প্রিপারেশন নেওয়া প্রার্থীরা নিজেদের ফোকাসড রাখার জন্য অলিখিত নিয়ম হিসেবে রিডিং রুমে বাটন ফোন ব্যবহার করতো। শুধু রুমে এলে অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহার করতাম। বিভিন্ন বিসিএস গ্রুপে আপডেট দেওয়া পড়ার বিষয়গুলো নিয়মিত দেখতাম। লিখিত পরীক্ষার জন্য কোচিং না করায় লিখিত প্রস্তুতি নিতে আমি অনলাইন বিসিএসের বিভিন্ন স্ট্যাডি গ্রুপের প্রতি নির্ভরশীল ছিলাম। তাদের প্রতি আন্তরিকভাবে অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা এখনো প্রকাশ করি। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে অনেক অনেক স্ক্রিনশট ও টপিক ডাউনলোড করে প্রিন্ট করে নিয়ে পড়েছি।

আরও পড়ুন: যেভাবে শিক্ষা ক্যাডার হলেন হামিদুল্লাহ 

নতুনদের উদ্দেশ্যে পরামর্শ নতুনরা প্রথম বিসিএস দেখবেন, পরেরটা ভালোভাবে দেবেন। অন্য চাকরি করার সঙ্গে বয়স ৩০ হওয়া পর্যন্ত বিসিএস দেবেন এমন চিন্তা পরিহার করুন। একজন চাকরিপ্রত্যাশী তার জীবন ও যৌবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় চাকরি পাওয়ার জন্য ব্যয় করে। তাই চাকরির জন্য প্রস্তুতির সময়টুকু অযথা দীর্ঘায়িত না করে স্বল্প সময়ে আপনার সর্বোচ্চ পরিশ্রম করে পরবর্তী জীবন উপভোগ করুন। ৩০ বছর নিজে ও পরিবারের সবাইকে ভালো রাখার জন্য দেড়-দুই বছর কষ্ট করে পড়াশোনা করাই যায়।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাআমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা একটাই, মানুষের দোয়া ও সম্মান অর্জন করা। মানুষ খুব বিপদে না পড়লে ডাক্তার ও পুলিশের কাছে যায় না। মানুষের বিপদগ্রস্ত অবস্থায় তাদের যতটা সম্ভব সহায়তা করা যায়, তাই করতে সচেষ্ট থাকবো। নিয়ম-নীতির বেড়াজাল দেখিয়ে সাহায্য প্রত্যাশিত মানুষকে অযথা হয়রানি করতে কাউকে দেবো না। আইনশৃঙ্খলা জনিত ব্যত্যয়ের অভিযোগ পেয়ে তারপর ব্যবস্থা গ্রহণের চেয়ে ব্যত্যয় খুঁজে নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করাই আমার লক্ষ্য থাকবে।

এসইউ/জিকেএস