মতামত

অধ্যাপক তাহের হত্যায় ফাঁসি কার্যকর: ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত

২০০৬ সালের একটি মর্মান্তিক এবং ভয়ঙ্কর ঘটনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনি বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমদকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। সেই ঘটনায় একাডেমিক সম্প্রদায়ের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। অধ্যাপক পদে পদোন্নতিকে কেন্দ্র করে এই অপরাধের পরিসমাপ্তি ঘটেছে সম্প্রতি রাজশাহী কারাগারে ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও তার সহযোগী মো. জাহাঙ্গীর আলমের ফাঁসির মধ্য দিয়ে। অন্য দুই আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে যা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সহিংসতার মুখে দ্রুত বিচারের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি তুলে ধরেছে।

Advertisement

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলমান দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া বিচার প্রার্থী পরিবারের সম্মুখীন হওয়া বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জকে উন্মোচিত করেছে। অধ্যাপক তাহেরের ছোট্ট মেয়ে যে তার শৈশবে পিতার হত্যা প্রত্যক্ষ করেছিল, সে পিতা হত্যার বিচার নিশ্চিত করবার জন্য কঠিন যাত্রা পার করেছে।

প্রথমে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছে এবং নিজেকে আইন পেশায় নিয়োজিত করে আদালতের সামনে পিতার হত্যাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে নিজে আইনি প্রক্রিয়ায় লড়াই করেছে দীর্ঘ সময় ধরে। পরিশেষে সে সফল হয়েছে তার পিতার হত্যার সাথে জড়িতদের বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শাস্তি দিতে। এই বিষয়টি অধ্যাপক তাহের হত্যাকাণ্ডকে বিশেষ মাত্রা প্রদান করেছে। ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করার জন্য তার যে অটল সংকল্প এই ধরনের অপরাধের বিচার প্রার্থীদের সাহস এবং শক্তি প্রদর্শন করবে।

২০০৬ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া ট্র্যাজেডি এবং ভয়াবহতার পটভূমির মধ্যে রয়েছে গল্পের আবেগময় দিক। দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ড. মহিউদ্দিন ছিলেন অধ্যাপক তাহেরের সরাসরি ছাত্র। পদোন্নতির মতো একটি তুচ্ছ ইস্যুতে একজন সাবেক শিক্ষার্থী এবং সেই সময়ের সহকর্মী কিভাবে তার নিজের শিক্ষকেকে হত্যার মতো একটি জঘন্যতম কাজ করতে পারে তা বিশ্বাস করা অনেক কঠিন।

Advertisement

একজন শিক্ষক এবং তাঁর ছাত্রের মধ্যে জ্ঞানচর্চার যে বন্ধনটি ছিল তা অপূরণীয়ভাবে ভেঙে গেছে সেই ঘটনা এটিই প্রমাণ করে। এই ঘটনাটি মানব সম্পর্কের ভঙ্গুরতা এবং অন্ধকারের একটি প্রখর অনুস্মারক হিসাবে কাজ করবে যা প্রমাণ করে যে হিংসা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং সহিংসতার দ্বারা চালিত মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পবিত্র সম্পর্ককেও গ্রাস করতে পারে।

দুঃখজনকভাবে, অধ্যাপক তাহেরের হত্যাকাণ্ডটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। চরমপন্থীদের হাতে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস এবং অধ্যাপক একেএম শফিউল ইসলাম (লিলন) এর নৃশংস হত্যাকাণ্ড এখনও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারকে তাড়িত করে। একই সাথে হত্যার শিকার শিক্ষকদের প্রিয়জনরা ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে। দীর্ঘায়িত এবং প্রায়শই হতাশাজনক আইনি প্রক্রিয়াগুলি হত্যার শিকার পরিবারের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা তাদের ন্যায়বিচার পাবার লড়াই চালিয়ে যাওয়া কঠিন করে তুলে।

একটি বিশ্ববিদ্যালয় মূলত পরিচিত জ্ঞান এবং একাডেমিক উৎকর্ষ সাধন করার স্থান হিসেবে। সেই ক্যাম্পাসে এই ধরনের জঘন্য অপরাধের ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সকলকে ভাবিয়ে তুলছে। একই সাথে দীর্ঘস্থায়ী বিচার প্রক্রিয়াকে কিভাবে দ্রুত করা যায় সেই বিষয়টি ভেবে দেখার সময় এসেছে। ন্যায়বিচার প্রদানে বিলম্ব শুধুমাত্র ভুক্তভোগীদের পরিবারের জন্য অপরিসীম দুর্ভোগের কারণ নয় বরং দোষী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতা এড়াতে সহায়তা করে এবং দায়মুক্তি পেতে সহায়তা করতে পারে।

আইন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং মানবাধিকার কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে দ্রুত বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা আহ্বান জানিয়ে আসছেন। এমনকি মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবার জন্য বিভিন্ন ধরনের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

Advertisement

আমাদের মনে রাখতে হবে যে বিলম্বিত বিচার শুধু ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবারের জন্য নিরাময় প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে না বরং আইনের শাসনের প্রতি জনগণের আস্থাকেও ক্ষুন্ন করতে পারে। সত্যিকার অর্থে ন্যায়বিচারকে সমুন্নত রাখার জন্য, এই পদ্ধতিগত ত্রুটিগুলিকে মোকাবিলা করা এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়ন করা অপরিহার্য যা যথাযথ প্রক্রিয়ার সাথে আপস না করে দ্রুত বিচারকে অগ্রাধিকার প্রদান করবে।

তাছাড়া, এই ধরনের জঘন্য কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের জড়িত থাকার বিষয়টি একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে জ্ঞান, উন্মুক্ত বিতর্ক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ঘাটি হিসেবে কাজ করা উচিত এবং একই সাথে সম্মান, সহনশীলতা এবং অন্তর্ভুক্তির পরিবেশ গড়ে তোলা উচিত। একাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলির উচিত তাদের প্রাঙ্গনে ঘটে যে কোনো ধরনের সহিংসতা, চরমপন্থা বা অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া এবং মানব জীবনের পবিত্রতা এবং জ্ঞানের সাধনাকে সমুন্নত রাখে এমন মূল্যবোধের প্রচার করা।

অধ্যাপক তাহের হত্যাকাণ্ডে জড়িত দোষী ব্যক্তিদের সাম্প্রতিক ফাঁসি একটি শক্তিশালী বার্তা প্রদান করবে এই মর্মে যে সহিংস কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করলে তার শাস্তি পেতেই হবে। যাই হোক, প্রতিটি মামলায় সত্যিকারের ন্যায়বিচারের নিশ্চিত করতে হবে, এবং সমস্ত ভুক্তভোগী এবং তাদের পরিবারের জন্য দ্রুত এবং ন্যায্য বিচার নিশ্চিত করবার জন্য আইনি ব্যবস্থার সংস্কার ঘটাতে হবে। এইসব কাণ্ডজ্ঞানহীন অপকর্মের মাধ্যমে যারা হারিয়ে গেছেন তাদের স্মৃতিকে সংরক্ষণ করতে হবে।

এই মর্মান্তিক ঘটনাগুলি এবং আইনি ব্যবস্থার মাধ্যমে ভিকটিমদের পরিবারের যন্ত্রণার কথা বিবেচনা করে সম্মিলিতভাবে বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা কমিয়ে আনতে হবে এবং বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দোষীদের শাস্তি দিতে হবে যাতে যারা এই ধরনের গুরুতর অপরাধ করবে তারা তাদের কর্মের পরিণতির সম্মুখীন হয়।

অধ্যাপক তাহেরের হত্যাকারীদের দোষী সাব্যস্ত করে বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে প্রায় ১৭ বছর সময় লাগলেও, এই বিচারিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী প্রতিরোধ হিসাবে কাজ করবে এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের জঘন্য অপরাধের সম্ভাব্য অপরাধীদের জন্য একটি দৃঢ় বার্তা প্রদান করবে। যদিও দীর্ঘায়িত আইনি প্রক্রিয়া ভুক্তভোগীদের পরিবারের ধৈর্য এবং সহনশীলতার পরীক্ষা নেয়। তবে, চূড়ান্ত ফলাফল তাদের কষ্টকে কমাতে পারে এই জন্য যে তারা ন্যায় বিচার পেলে তারা বিশ্বাস করবে যে বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হলেও শেষ পর্যন্ত জয়ী হওয়া যায়।

আধ্যাপক তাহেরের হত্যাকারীদের ফাঁসির রায় কার্যকর হবার মাধ্যমে একটি বার্তা প্রদান করা সম্ভব হয়েছে যে যারা এই ধরনের সহিংস কাজ করার সাহস করে এবং জবাবদিহিতা থেকে বাঁচতে চায়, তারা এক সময় ন্যায়বিচারের নাগাল থেকে রেহাই পাবে না।

মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া তাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা যারা ভবিষ্যতে এই ধরণের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবে। ন্যায়বিচারের অন্বেষণে এই মাইলফলক মুহূর্তটি আশা করি সম্ভাব্য অপরাধীদের অপরাধ প্রবণতা কমাবে এবং ভয় ও জবাবদিহিতার অনুভূতি জাগিয়ে তুলবে যা শেষ পর্যন্ত একটি নিরাপদ এবং আরও ন্যায়সঙ্গত সমাজ প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখবে।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।

এইচআর/এএসএম