অর্থনীতি

পর্ষদের পদ নিয়ে দ্বন্দ্ব, কাটছে না ডেল্টা লাইফের জটিলতা

জটিল পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না বেসরকারি খাতের সব থেকে বড় জীবন বিমা কোম্পানি ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স। নতুন পর্ষদের পদ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেওয়ায় বোর্ড সভা করতে পারছে না পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত এ কোম্পানিটি। ডেল্টা লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুর রহমান এবং সরকারের একজন মন্ত্রীর অনুসারীদের মধ্যে এ দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে।

Advertisement

ডেল্টা লাইফের পর্ষদের দখল নেওয়া নিয়ে দুই গ্রুপের দ্বন্দ্ব বহু পুরোনো। প্রথম দিকে উদ্যোক্তা পরিচালকদের দুই গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিলেও এখন সেই দ্বন্দ্বে সরকারের একজন মন্ত্রীও জড়িয়েছেন। এ মন্ত্রীর অনুসারীরা ডেল্টা লাইফের পর্ষদের তিনটি পদ দখল নিতে চাচ্ছেন। অন্যদিকে সাবেক চেয়ারম্যান মঞ্জুর রহমানের অনুসারীরা পর্ষদের দুটি পদ ছাড়তে চাচ্ছেন। এ নিয়েই মূলত দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে।

এ দ্বন্দ্বের জেরে বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) লভ্যাংশ সংক্রান্ত বোর্ড সভার তারিখ নির্ধারণ করেও তা বাতিল করতে যাচ্ছে ডেল্টা লাইফ কর্তৃপক্ষ। ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২১ সালের সমাপ্ত বছরের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনার জন্য এ বোর্ড সভার তারিখ নির্ধারণ করা হয়।

এর আগেও এক দফা লভ্যাংশ সংক্রান্ত বোর্ড সভার তারিখ নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি দেশের বৃহৎ এ জীবন বিমা কোম্পানিটির পর্ষদ। গত ১১ এপ্রিল এ বোর্ড সভার তারিখ নির্ধারণ করা হয়। তবে পরিচালনা পর্ষদ থেকে একজন পদত্যাগ করায় বোর্ড সভা করা নিয়ে জটিলত দেখা দেয় এবং ৪ এপ্রিল বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) থেকে নতুন পরিচালক নিয়োগের জন্য আপিল বিভাগের অনুমোদন নিতে বলা হয়। এর প্রেক্ষিতে বোর্ড সভার তারিখ নির্ধারণ করেও তা বাতিল করা হয়।

Advertisement

প্রথমদিকে ডেল্টা লাইফের দখল নেওয়ার লক্ষ্যে কোম্পানিটির উদ্যোক্তা পরিচালকদের মধ্যে বড় ধরনের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। দখল, পাল্টা দখলের চেষ্টার পাশাপাশি হয় একাধিক মামলা। পরিচালকদের একটি পক্ষের নেতৃত্ব দেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন। আর একটি পক্ষের নেতৃত্ব দেন ডেল্টা লাইফের বর্তমান পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদ সদস্য জেয়াদ রহমান ও আদিবা রহমানের বাবা মঞ্জুর রহমান।

২০১১ সালের ২২ নভেম্বর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালকদের এককভাবে ২ শতাংশ এবং সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ শেয়ার ধারণ করতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ (বিএসইসি) নির্দেশনা জারি করলে তা আর্শিদবাদ হয়ে আসে মঞ্জুর রহমান গ্রুপের জন্য। ডেল্টা লাইফের ১১ জন পরিচালককে বিদায় করে কোম্পানিটির দখল নেয় মঞ্জুর হরমান।

দখল নেওয়ার পর মঞ্জুর রহমান কোম্পানিটির চেয়ারম্যান হন। মেয়ে আদিবা রহমানকে করা হয় মূখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। সেই সঙ্গে পরিবারের একাধিক সদস্যকে পরিচালনা পর্ষদে যুক্ত করা হয়। ডেল্টা লাইফে মঞ্জুর রহমানদের রাজত্ব চলার মধ্যেই ২০২০ সালে আইডিআরএ সাবেক চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে কোম্পানিটির কর্তৃপক্ষ।

যার প্রেক্ষিত্রে অনিয়মের অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ডেল্টা লাইফের পরিচালনা পর্ষদ সাসপেন্ড করে আইডিআরএ। সেই সঙ্গে আইডিআরএ’র সাবেক সদস্য সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লাকে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে দেড় বছরে ৩ দফায় প্রশাসক পরিবর্তন করা হয়।

Advertisement

অবশ্য প্রশাসক নিয়োগের আগেই আইডিআরএ’র সাবেক চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে ঘুস দাবি করার অভিযোগ তোলে ডেল্টা লাইফ কর্তৃপক্ষ। ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর ডেল্টা লাইফের পক্ষ থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ করা হয় আইডিআরএ চেয়ারম্যান এম মোশাররফ হোসেন ৫০ লাখ টাকা ঘুস দাবি করেছে।

দুদকে অভিযোগ করার পর ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করেও একই অভিযোগ করা হয়। এ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ডেল্টা লাইফের সাবেক সিইও আদিবা রহমান। ডেল্টা লাইফ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে এমন অভিযোগ করার এক সপ্তাহের মাথায় ১১ ফেব্রুয়ারি কোম্পানিটিতে প্রশাসক নিয়োগ দেয় আইডিআরএ।

ডেল্টা লাইফে প্রথম প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সুলতান-উল-আবেদীন মোল্লা পরবর্তীতে মাস্ক কেলেঙ্কারিতে জড়ান। ডেল্টা লাইফে প্রশাসক থাকা অবস্থায় কোনো দরপত্র আহ্বান ছাড়া নিয়মবর্হিভূতভাবে মাস্ক কেনার অভিযোগে তাকে কারাগারেও যেতে হয়।

আর ডেল্টা লাইফের নিয়ে জড়ানো বিতর্কের জেরে আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে হয় এম মোশাররফ হোসেনকে। ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল আইডিআরএ সদস্য (লাইফ) হিসেবে নিয়োগ পাওয়া মোশাররফকে ২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ৩ বছরের জন্য সংস্থাটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।

সে হিসাবে মোশাররফের মেয়াদ ২০২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর শেষ হওয়ার কথা। মেয়াদ শেষ হওয়ার এক বছর আগেই ২০২২ সালের ১৫ জুন তিনি পদত্যাগ করেন। ওই দিনই আইডিআরএ’র নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়।

এরপর গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর দুটি পৃথক আদেশে ডেল্টা লাইফ থেকে প্রশাসক প্রত্যাহার এবং কোম্পানিটি পরিচালনায় নতুন পর্ষদের দায়িত্ব দেয় আইডিআরএ। সুপ্রিম কোটের আপিল বিভাগের নির্দেশে এ পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়। পর দিন ২০ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন পর্ষদ দায়িত্ব নেয় জীবন বিমা কোম্পানিটির।

ডেল্টা লাইফের নতুন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে হাফিজ আহমেদ মজুমদার এবং ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে অধ্যাপক মো. জুনায়েদ শফিককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এছাড়া পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় ডেল্টা লাইফের সাবেক সিইও আদিবা রহমান, ডেল্টা লাইফের সাসপেন্ডেড পরিচালনা পর্ষদে থাকা সুরাইয়া রহমান ও জেয়াদ রহমানকে।

তাদের পাশাপাশি সাকিব আজিজ চৌধুরী, চাকলাদার রেজানুল আলম এবং সাকিব আজাদ কোম্পানিটির নতুন পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্ব পান।

২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বার্ষিক সাধারণ সভা আয়োজন করা, দ্রুততম সময়ের মধ্যে যোগ্য সিইও নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করাসহ বেশ কিছু শর্ত দেওয়া হয় এ পরিচালনা পর্ষদকে। তবে প্রভাব বিস্তার করা নিয়ে অল্প দিনের মধ্যে পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের এ দ্বন্দ্বের মধ্যেই পদত্যাগ করে বসেন সাকিব আজিজ চৌধুরী।

তার পদত্যাগের কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ে। সাকিব আজিজ চৌধুরীর জায়গায় খন্দকার সাব্বির মোহাম্মদ কবিরকে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ডেল্টা লাইফের পরিচালনা পর্ষদ। তার নিয়োগ অনুমোদন চেয়ে গত ১৯ মার্চ ডেল্টা লাইফের চেয়ারম্যান হাফিজ আহমেদ মজুমদার অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে চিঠি দেয়। এরপর ২৭ মার্চ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে আইডিআরএ-কে চিঠি দেয়া হয়।

তার প্রেক্ষিতে ৪ এপ্রিল আডিআরএ থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের নির্দেশ অনুযায়ী ডেল্টা লাইফের পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হয়। তাই ডেল্টা লাইফের পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে একজন অর্থাৎ খন্দকার সাব্বির মোহাম্মদ কবিরকে নিয়োগ অনুমোদন দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সম্মতি প্রয়োজন। এর ফলে গত ১১ এপ্রিল লভ্যাংশ সংক্রান্ত বোর্ড সভার তারিখ নির্ধারণ করেও তা বাতিল করতে হয়।

তবে সম্প্রতি সাকিব আজিজ চৌধুরীর জায়গায় খন্দকার সাব্বির মোহাম্মদ কবিরকে নিয়োগ দেওয়ার অনুমোদন দেয় আদালত। এতে জটিল পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার পথ সৃষ্টি হয়। তার প্রেক্ষিতেই ৩ আগস্ট লভ্যাংশ সংক্রান্ত বোর্ড সভার তারিখ নির্ধারণ করে কোম্পানিটির বর্তমান পর্ষদ। কিন্তু নতুন পর্ষদে কারা দায়িত্ব নেনিবেন তা নিয়ে নতুন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। পর্ষদের পদ নিয়ে দর কষাকষির সমাধান না হওয়ায় এবারও বোর্ড সভা করতে পারছে না এ জীবন বিমা কোম্পানিটি।

এ বিষয়ে ডেল্টা লাইফের চেয়ারম্যান হাফিস আহমেদ মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, আমরা আদালতের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে বোর্ড সভা এবং এজিএম করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বৃহস্পতিবার আমাদের যে বোর্ড সভা হওয়ার কথা ছিল সেটা হচ্ছে না। পরিচালনা পর্ষদে নতুন যে সদস্যরা এসেছেন তাদের মধ্যে কিছুটা মতবিরোধ রয়েছে। বৃহস্পতিবারের বোর্ড সভায় নতুন পরিচালক নির্ধারণ করার কথা ছিল। কিন্তু আমরা সেটা করতে পারছি না। তবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে আমরা শিগগির নতুন বোর্ড সভার তারিখ নির্ধারণ করবো।

ডেল্টা লাইফের পর্ষদের একজন সদস্য বলেন, মন্ত্রীর গ্রুপ পর্ষদের ৩টি পদ চায়। কিন্তু বিপরীত পক্ষ দুটি পদ দিতে চায়। এ নিয়েই মূলত দুই গ্রুপের মধ্যে কিছুটা দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। যার প্রেক্ষিতে এবারও লভ্যাংশ সংক্রান্ত বোর্ড সভা করা সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি বলেন, ডেল্টা লাইফের উল্লেখযোগ্য শেয়ার মঞ্জুর রহমানের অনুসারীদের দখলে রয়েছে। বিপরীতে মন্ত্রীর গ্রুপে আছে কোম্পানিটির ৪ শতাংশের মতো শেয়ার। এ কারণে মঞ্জুর রহমানের গ্রুপ পর্ষদে মন্ত্রীর গ্রুপকে দুটি পদ দিতে চাচ্ছেন। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান না হলে সামনে আরও জটিল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

এদিকে কোম্পানিটির সিইও নিয়োগ নিয়েও সম্প্রতি জটিলতা সৃষ্টি হয়। পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদ এমন একজনকে সিইও নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় যার শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদের বৈধতা নেই। যে কারণে আইডিআরএ থেকে তার নিয়োগ অনুমোদন না দিয়ে নতুন সিইও নিয়োগের নির্দেশ দেয়। তবে কোম্পানিটির কর্তৃপক্ষ এখনো নতুন সিইও নিয়োগ দিতে পারেনি। ফলে সিইও ছাড়াই চলতে হচ্ছে এ বিমা কোম্পানিটিকে।

এমএএস/এমআইএইচএস