মতামত

কথাগুলো সব ভুতুড়ে!

কার বা কাদের কথা বলছি ভুতুড়ে? ব্যক্তি আর রাজনৈতিক দল ভিন্ন হলেও বক্তব্য কিন্তু একটিই। তাহলো- বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল বেশ কয়েক দিন ধরে জনদুর্ভোগ সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। এই কর্মসূচিতে আমাদের কোনো বাধা নেই। কিন্তু যখনই তারা কর্মসূচির নামে জনগণের দুর্ভোগ করবে, জানমালের ক্ষতি করবে, আহত করবে, হত্যার চেষ্টা করবে, গাড়ি ভাঙচুর করবে-সেটি পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী প্রতিহত করবে।

Advertisement

শনিবার (২৯ জুলাই) বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে আহত পুলিশ সদস্যদের দেখতে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে এসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান এসব কথা বলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথাগুলোর মানে যদি করি তাহলেই বেরিয়ে আসবে তার রাজনৈতিক চেতনার রূপ। তিনি বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচিকে বলছেন ‘জনদুর্ভোগ সৃষ্টি’। ওই কর্মসূচিতে আমাদের কোনো বাধা নেই। কিন্তু যখনই তারা কর্মসূচির নামে জনগণের দুর্ভোগ করবে, জানমালের ক্ষতি করবে, আহত করবে, হত্যার চেষ্টা করবে, গাড়ি ভাঙচুর করবে- সেটি পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী প্রতিহত করবে।

যে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে। সেই কর্মসূচি রাজনৈতিক সরকারের হোক বা সামরিক সরকারের হোক কিংবা টাইরান্ট সরকারের হোক, আর সরকারের বিরোধী রাজনীতিকদের (বিএনপি এবং সমমনা বিরোধী দল) কর্মসূচি হোক- জনদুর্ভোগ অনিবার্য। কীভাবে সেই জনদুর্ভোগ হয় তা আমরা প্রতিদিনই দেখছি। ধরুন, কোনো রাজনৈতিক দলের মিছিল ও মিটিংয়ের কর্মসূচি পালন করতে হলে তারা রাস্তায় নামবে।

রাস্তার চৌমাথা দখল করে কার্মসূচি পালন করবে। (শাহবাগ তার উদাহরণ) আর রাস্তায় নামা মানে হচ্ছে সড়কের যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটানো। সাধারণের যাতায়াতে বাধা সৃষ্টি করা। এটা আমরা বহুকাল ধরেই দেখে আসছি। সেই পাকিস্তানি আমল থেকেই। বাংলাদেশ আমলেও সেই মিটিং মিছিলের অব্যাহত গতি দেখেছি। মিটিং-মিছিল আর পুলিশি অ্যাকশন এটা যেন চিরকালীন দৃশ্য আমাদের কাছে, আমাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার রোজকার ছবি। এই জনদুর্ভোগের কারণ রাজনৈতিক কর্মসূচি। তাই সেখানে কিছু দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কাই থাকে।

Advertisement

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল যখন বলেন যে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আমাদের কোনো বাধা নেই- তখন হাসি চেপে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ কর্মসূচির মধ্যে মিটিং-মিছিল হবে। কিন্তু ভাঙচুর হবে না। জনগণের সম্পদ বিনষ্ট হবে না। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে রাজনৈতিক কর্মসূচি ‘দাঁতনখহীন’ কোনো সাপের মতো হবে। যে সাপের চোখ নেই নখ নেই— সেই রকম মিছিল-মিটিং হতে হবে। তারা যদি ভাঙচুর করে তাহলে খবর আছে। পুলিশ ও নিরাপত্তাবাহিনী তা রুখে দেবেই।

প্রতিবাদী, প্রতিরোধী কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি কি দাঁত, নখহীন শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট প্রাণী হতে পারে? দ্বিতীয়ত সরকারি দল যখন শান্তি ও উন্নয়নের নামে মহানগরজুড়ে মিছিল ও মিটিং করে, তখন কি তা জনদুর্ভোগ হয় না? ঘণ্টার পর ঘণ্টা যখন তারা জনপথ দখল করে রেখে বিএনপিসহ অপরাপর বিরোধী দলকে জ্ঞান দিতে থাকেন তখন মনে হয় সরকারি দলটি বিরোধীদের রাজনৈতিক কর্মসূচির ৫০ শতাংশ সম্পন্ন করে দিচ্ছে। গিবত যে কতোটা হতে পারে, সরকারি দলের রাজনীতিকদের বক্তব্যই তার প্রমাণ।

এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতার দণ্ডধারী রাজশক্তি, অতএব তাদের একথা মনে হবে যে তারা কোনো রকম জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছেন না। জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে কেবল বিরোধী দল। কারণ তারা কেবল মিছিলই করে না, গাড়ি ভাঙ্চুর করে।, অগ্নিসন্ত্রাস করে, পুলিশকে আহত করে (পুলিশ নিহত করার কোনো খবর নেই) জানমালের (কার জান আর কার মাল?) ক্ষতিসাধন করে ইত্যাদি ইত্যাদি…।

প্রথমত, তিনি যখন বিরোধী দলে ছিলেন তখন কি করেছেন মিছিলে যোগ দিয়ে? তার কর্মীবাহিনী কি করেছে সেই দিনগুলো স্মৃতিরোমন্থন করার তাগিদ দিচ্ছি। কারণ, আজ তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে পুলিশের পক্ষে যে সাফাই গাইছেন, কালকে সেই পুলিশই তার ওপর চড়াও হবে না তা কি আমরা বলতে পারি? অর্থাৎ পুলিশের রাজনৈতিক চরিত্র আর পুলিশি প্রশাসনিক চরিত্র যে দমন ও নৃশংসতায় সাজানো হয়েছে, যে শিক্ষা ও কারিকুলামে তারা প্রশিক্ষিত, সেই প্রজ্ঞায় তারা পরিচালিত হয় না।

Advertisement

মানুষের সেবা আর সহযোগিতাই যেখানে এই আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর মৌলিক দায়িত্ব, সেখানে তারা আজ সরকারি রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনে পরিণত হয়েছে। দায়িত্ব পালনরত একজন পুলিশ অফিসার যেভাবে ও যে ভাষায় তার কর্তব্য ব্যক্ত করলেন দেখলাম টিভিতে, তাতে তাকে কোনোভাবেই পুলিশ মনে হয়নি। মনে হলো রাজনৈতিক কর্মী সরকারি দলের। আমরা তো জানি গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার হাজার হাজার পুলিশ নিয়োগ করেছে, যারা রাজনৈতিক পরিচয়ে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের কর্মী ছিলেন।

এরাই এখন সরকারের ঢাল হিসেবে পুলিশি অ্যাকশনে আছে। ওই সব পুলিশের হিংস্রতা কেমন হতে পারে, তা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে মাটিতে ফেলে পিটিয়ে তার প্রমাণ দিয়েছে। বিএনপি সরকারের আমলে মতিয়া চৌধুরী ও মোহম্মদ নাসিমকে যেমন পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে, তেমনি বিএনপির সংসদীয় দলের চিফ হুইপ জয়নাল আবেদীন ফারুক ও সাদেক হোসেন খোকাকেও মেরে রক্তাক্ত করেছিল ওই পুলিশই।

সেদিন গয়েশ্বর রায় তো মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে হাঁটছিলেন। তিনি কি কোনো গাড়ি ভাঙ্চুর করেছিলেন? নাকি ওই যে ময়লার গাড়ি ভাঙার কথা বলে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছিলেন প্রজ্ঞাবান আওয়ামী পুলিশ, সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর ইচ্ছা ছিল নাকি / আছে? কিংবা গয়েশ্বরবাবুর মতো বড় নেতাকে পুলিশের ঘা খেতে হয় না, এরকম মানসিক রোগের অপশমের জন্য দু’ঘা বসিয়ে দিয়ে হাতের ও মনের জ্বালা মেটালেন পুলিশ কর্মকর্তা?

এটাই হলো আমাদের রাজনৈতিক সরকারের ততোধিক রাজনৈতিক ‘পুলিশের মনোভাব’। সরকার পরিবর্তন হয়, কিন্তু পুলিশের চরিত্রের কোনো রকম হেরফের হয় না। বিরোধীদের পিটিয়ে, গুলি করে হত্যা করতে উৎসাহী তারা, তবে ক্ষমতাসীনদের কিউ পেলেই সেটা ঘটে। এটা তাদের মানসিক রোগ নাকি ব্রিটিশ লিগেসি, সেটা বোঝার জন্য গবেষণার দরকার নেই।

পুলিশ বাহিনী সৃষ্টি করা হয়েছিল ব্রিটিশ রাজকর্মচারী কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার জন্য। শাসকরা কখনোই অপরাধী নয়, এই দৃষ্টিভঙ্গি ও মনন থেকেই তারা জনগণকে প্রতিপক্ষ বিবেচনা করে। অপরাধ যা করার তা করে জনগণ। তাদের শায়েস্তা করাই পুলিশের কাজ। আর মনিব সরকারকে রক্ষা করাও।

রাজনৈতিক সরকার যেমন মনে করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের শত্রু পক্ষ তেমনি বিরোধীরাও মনে করেন ক্ষমতাসীনরা শত্রু পক্ষ। এই রাজনৈতিক মনোভঙ্গিই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। রাজনৈতিক সংস্কৃতির এই বহুল প্রচলিত ও ব্যবহৃত পথ পরিবর্তনের সময় হয়েছে অনেক আগেই কিন্তু আজো তার পরিবর্তন হয়নি।

নতুন প্রজন্মের রাজনীতিকদের এটা ভাবতে হবে যে তারা জনগণের সেবা করতে এসেছেন, প্রভুত্ব করতে নয়। তাদের চিন্তাধারায় সেই প্রবাহ বাড়াতে হবে এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতি নতুন করে তুলতে হবে। তখন আর নির্বাচনে ভোট ডাকাতির চিন্তা বা দিনের ভোট আগের রাতে সম্পন্ন করার মতো অপরাধ করার চিন্তা আসবে না। বেহায়ার মতো আচরণ করবে না।

যে জাতির মনে-মানসিকতায় হায়ার অভাব, তাদের জীবনের নেমে আসে ভোট নিয়ে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রগুলোর তৎপরতা। আমরা একবারও ভাবি না নিজেদের ব্যক্তিগত, দলগত সমস্যা কি এবং তা কোথায় লুকিয়ে আছে। এবং সামষ্টিক সাংস্কৃতিতে সেই সংকট কোথায়, কোন স্তরে লুকিয়ে আছে।

নিজেদের আচরণ ও কথাবার্তার সৌন্দর্য কেন হানি হচ্ছে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত, প্রতিপক্ষের দোষ আমরা দেখতে পাই, নিজেদের ত্রুটি নিয়ে কেন ভাবি না, কেন উদগ্রভাবে কেবল ক্ষমতার লোভই উৎকটভাবে উঠে আসছে মনে, তার কারণ নিয়ে আমরা ভাবিত নই। এটাই আমাদের প্রধান সংকট ও সমস্যা।আমরা যা করে চলেছি বিশ্বের দানবাদী গণতন্ত্র তা ধারণ করে না।

০১-০৮-২০২৩লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এএসএম