‘অংপুরে (রংপুরে) শেখের বেটি হাসিনা আসবে। তার কাছোত হামার দাবি (তার কাছে আমার দাবি) একটাই, তিস্তা নদীর বান্দোন (বাঁধ) চাই। এই বান্দোন হইলে জমি ফিরি পামো (পাবো)। ঘরবাড়ি কইরা থাকমু। আংগোর (আমাদের) খুব উপকার হইবো। আগের মতো সুখোত (সুখে) থাকমো (থাকবো)।’
Advertisement
এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন তিস্তাপাড়ের বাসিন্দা জোহরা (৪৫) ও হাজেরা বেওয়া (৫০)।
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার নিজ গড্ডিমারী গ্রামের অসহায় হাজরা বেওয়া। স্বামী সোলেমান গণি ১০ বছর আগে মারা গেছেন। সেই থেকে হাজেরা বেওয়া সন্তানদের নিয়ে তিস্তার বাঁধের রাস্তায় আশ্রয় নিয়ে আছেন। একসময় সবই ছিল তাদের। তিস্তার করাল গ্রাসে একে একে ছয়বার ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়ায় নিঃস্ব হয়ে গেছে পরিবারটি।
আরও পড়ুন: আশায় বুক বাঁধছে তিস্তাপাড়ের মানুষ
Advertisement
একই এলাকার জোহরা বেগম। স্বামী সাঈদ আলী তিস্তায় পাঁচবার বসতভিটা, জায়গা-জমি হারিয়ে আজ দিনমজুর।
প্রধানমন্ত্রীর রংপুর আসার খবরে তিস্তায় মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে আশায় বুক বাঁধছেন তিস্তাপাড়ের মানুষ। তাদের দাবি, তিস্তা নদী খনন এবং দুই ধারে যেন টেকসই বাঁধ নির্মাণ করে দেওয়া হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, কয়েকদিন আগে উজানের ঢলে তিস্তার পানি যে গতিতে বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি গতিতে কমতে শুরু করেছে। তবে পানির স্রোত আর ঢলের তোড়ে ভেঙে যাচ্ছে নদীর দুই তীরের অরক্ষিত পাড়।
হাতীবান্ধা উপজেলার সিন্দুর্না ইউনিয়নের চর সিন্দুর্না ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা জাহিদ। তবে নদীভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে অন্যের জমিতে টিনশেড ঘরে আশ্রয় নিয়ে আছে তার পরিবার।
Advertisement
আরও পড়ুন: রংপুরে ৩০ উন্নয়ন কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধানমন্ত্রী
জাহিদ জাগো নিউজকে জানান, তার বাবা পেশায় একজন কৃষক। তিনি অনেক কষ্ট করে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেও চাকরি পাননি। গতবছর জায়গা-জমি, বাড়িঘর নদীর গর্ভে চলে যায়। এক আত্মীয়ের কাছে এক খণ্ড জমি নিয়ে বাবা, মাসহ কোনোমতে বাড়ি করে আছেন।
তিস্তাপাড়ের বাসিন্দা জাহিদ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের প্রাণের দাবি, নদীর দুই তীরে বাঁধ নির্মাণ করা হোক। তিস্তায় বাঁধ নির্মাণ হলে ৩০ বছরে হারিয়ে যাওয়া জায়গা- জমি ফিরে পাবো।’
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিস্তায় প্রতিবছর পানি সংকটে শুষ্ক মৌসুমে কৃষিজমিতে সেচ নিয়ে বিপাকে পড়েন উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার কৃষক। অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে উজানের ঢলে বেড়ে যায় তিস্তার পানি। তখন খুলে দিতে হয় তিস্তা ব্যারাজের সবকটি গেট। এতে বন্যায় প্লাবিত হয় এ অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা। খরা মৌসুমে পানি না পাওয়া এবং বর্ষা মৌসুমে অতিপ্রবাহের কারণে তিস্তা নদী গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এ অঞ্চলের মানুষের জন্য।
আরও পড়ুন: ‘বাপের দেওয়া ভিটাবাড়িও কাড়ি নিছে তিস্তা’
অভিন্ন নদী তিস্তা বাংলাদেশে প্রবেশের পর নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলায় ১২টি উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ১১৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে ডান তীরের ৭০ কিলোমিটার বাঁধ থাকলেও দুই তীরের ১৬০ কিলোমিটার এখনও সম্পূর্ণ অরক্ষিত।
হাতীবান্ধা উপজেলার গুড্ডিমারি ইউনিয়নের নিউ গুড্ডিমারি গ্রামের আব্দুল মান্নান বলেন, ‘বর্তমানে তিস্তার ভাঙনের কবল থেকে হেফাজতে আছি। তারপরও দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় কখন ভেঙে যায়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের দাবি, ভারত সীমান্ত থেকে চন্ডিমারী পর্যন্ত তিস্তার দুই তীরে বাঁধ ও খনন করলে তিস্তাপাড়ের লাখো মানুষ উপকৃত হবেন।’
তিস্তাপাড়ের সাঈদ আলী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমাদের একটাই আবদার, তিস্তা নদীর বাঁধ নির্মাণ করা। তিস্তা নদীতে কয়েক একর জমি পড়ে আছে। বাঁধ হলে জমিগুলো ফিরে পাবো।
আরও পড়ুন: তিস্তার পানি কমতেই ভাঙন শুরু
হাতীবান্ধা উপজেলার সিন্দুর্না ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আরিফুল ইসলাম আরিফ বলেন, এ ইউনিয়নের আটটি ওয়ার্ডই নদীর গর্ভে। প্রতিবছর বন্যা ও ভাঙনে সংকুচিত হচ্ছে ইউনিয়নটি। গত ২০ বছরে প্রায় দুই হাজার পরিবার বসতভিটা হারিয়েছে। তাই আমাদের দাবি, পদ্মা সেতুর মতো নিজ অর্থায়নে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হোক।
তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন দাবির সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানী। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে নদীতীরের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে। শিল্প-কলকারখানা, নদীবন্দর গড়ে উঠবে। আমরা চাই তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ দ্রুত শুরু হোক।
রবিউল হাসান/এসআর/এএসএম