বিএনপি এখন সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে আছে। তারা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের কথা বললেও আন্দোলন যে সবসময় শান্তিপূর্ণ থাকবে না, সে আশঙ্কা করছিলেন অনেকেই। আশঙ্কা সত্যি হতে সময় লাগলো না। ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে বিএনপির অবস্থান কর্মসূচি ঘিরে আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজপথ। পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। অনেকে আহত হয়েছেন, গ্রেপ্তার হয়েছেন।
Advertisement
আবার গাড়িতে আগুন শঙ্কিত করেছে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের। ২৮ জুলাই মহাসমাবেশ থেকে পরদিনই রাজধানীর প্রবেশপথে অবস্থান ধর্মঘটের কর্মসূচিতে অবাক হয়েছেন অনেকেই। বিএনপি আসলে আন্দোলনের মোমেন্টাম ধরে রাখতে দেরি করেনি। তাছাড়া তাদের ভাবনায় ছিল মহাসমাবেশে আসা নেতাকর্মীদের দিয়েই অবস্থান কর্মসূচি সফল করতে। যথারীতি বিএনপির পাল্টা হিসেবে আওয়ামী লীগও রাজধানীর প্রবেশপথগুলোতে শান্তি সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করে। তবে রাজধানীর প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচি পালনে পুলিশের অনুমতি পায়নি বিএনপি বা আওয়ামী লীগ কেউই। অনুমতি না পেলেও কর্মসূচিতে অটল থাকে বিএনপি।
তবে আগের দিনের মহাসমাবেশের সাফল্য ধরে রাখতে পারেনি বিএনপি। বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী সমাগমের আশা থাকলেও সেটা ঘটেনি। আওয়ামী লীগ কর্মসূচি প্রত্যাহার করলেও বিএনপি মাঠে নামায় মাঠে থাকে আওয়ামী লীগও। অনুমতি ছাড়া কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে বিএনপি। পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগও ছিল মাঠে। ফলে কোথাও কোথাও ত্রিমুখী সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। সকাল থেকেই উত্তেজনা ছিল মাতুইয়াল ও গাবতলী এলাকায়। লোকসমাগম কম হওয়ায় বিএনপি নেতারা ইস্যু বানানোর ভিন্ন কৌশল নেন। গাবতলীতে আমানউল্লাহ আমান গ্রেপ্তার হওয়ার জন্যই যেন চেষ্টা করছিলেন।
পুলিশের সাথে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে রাস্তায় শুয়ে পড়েন আমানউল্লাহ আমান। সেখান থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। তবে মাতুয়াইলে পরিস্থিতি ছিল আরও উত্তপ্ত। উত্তপ্ত ছিল ধোলাইখাল এলাকায়ও। ধোলাইখালে কর্মসূচির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। দুপক্ষের ঢিল বিনিময়ের একপর্যায়ে আহত হন গয়েশ্বর। পুলিশ তাকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে তিনি মাটিতে পড়ে যান। সেখানে পুলিশ তাকে বেধড়ক লাঠিপেটা করে এবং তুলে নিয়ে যায়।
Advertisement
রাজনীতির সাথে ইদানীং গুজবের খুব সখ্য। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দ্রুত সে গুজব ছড়ায়ও। প্রথমে খবর আসে গয়েশ্বর রায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তাকে ন্যাশনাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, সেখান থেকে পুলিশ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। পরে নেওয়া হয়েছে গোয়েন্দা কার্যালয়ে। ঢিল লেগে গয়েশ্বর রায়ের কপালের দিকে কেটে গেলেও তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবরটি একেবারেই গুজব। তাকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে নেওয়া হলেও দুপুরের পর পুলিশ জানায় প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশের গাড়িতেই তাকে বিএনপি কার্যালয়ে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আর আমানউল্লাহ আমানকে ভর্তি করা হয় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে। পরে অবশ্য তিনি এভারকেয়ার হাসপাতালে চলে যান।
তবে সকালের উত্তেজেনায় দুপুরেই আসে নতুন টুইস্ট। গয়েশ্বর রায়কে গোয়েন্দা পুলিশ কী ধরনের ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ’ করেছে তা নিয়ে কৌতূহল ছিল অনেকেরই। কিন্তু সেই প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের সচিত্র বিবরণ দেখে হতবাক দেশবাসী। দ্রুতই সেই ছবি ছড়িয়ে পড়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তাতে দেখা যায় টেবিল ভর্তি হরেক পদের খাবার। গোয়েন্দা প্রধান হারুন অর রশীদ তুলে তুলে খাওয়াচ্ছেন গয়েশ্বর রায়কে। হোটেল সোনারগাঁও থেকে আনা সেই খাবার বাবু গয়েশ্বর রায় আয়েশ করে খাচ্ছেন।
গোয়েন্দা কার্যালয়ে গয়েশ্বর রায়কে আপ্যায়ন প্রসঙ্গে হারুন অর রশীদ সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা ভিআইপি রাজনীতিবিদদের যে মর্যাদা, সেটা তাদের দিয়ে থাকি। গয়েশ্বর রায়কেও ধোলাইখাল থেকে সেফ করে ডিবি কার্যালয়ে এনেছি। তাকে দুপুরে আপ্যায়ন করানো হয়েছে। তারপর পুলিশের গাড়ি দিয়ে তাকে কার্যালয়ে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।’
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তার সহকারী একান্ত সচিব-২ গাজী হাফিজুর রহমান লিকু জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমানকে দেখতে যান। এ সময় বিএনপি নেতাকে প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো দুপুরের খাবার, বিভিন্ন প্রকার ফল ও জুস তুলে দেন তিনি। গাজী হাফিজুর রহমান আমানউল্লাহ আমানকে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার জন্য এসব খাবার, ফল ও জুস পাঠিয়েছেন। তিনি আপনার স্বাস্থ্যের খোঁজখবর জানতে চেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী আপনার দ্রুত সুস্থতা কামনা করেছেন।’
Advertisement
তাছাড়া লিকু সাংবাদিকদের জানান, ‘চিকিৎসার জন্য দেশের ভেতরে অন্য যেকোনো হাসপাতালে জনাব আমানউল্লাহ আমান যেতে চাইলে তারও সুব্যবস্থা করে দেবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আমানউল্লাহ প্রধানমন্ত্রীর উপহার গ্রহণ করে মানবতা ও রাজনৈতিক শিষ্টাচারের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন বলেও দাবি করেন লিকু।’
দুই রাজনৈতিক দলের মুখোমুখি অবস্থানের মধ্যে বিরল এই শিষ্টাচার ও সৌহার্দ্য সবাইকে চমকে দেয়। বিরোধী দলের নেতাদের প্রতি সরকারের এই মনোভাব সবাইকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেয়। বিএনপির কর্মসূচির সাফল্য-ব্যর্থতা ছাপিয়ে আলোচনায় উঠে আসে শিষ্টাচার প্রসঙ্গ। কিন্তু আসলে শিষ্টাচারকে গ্রহণ করার মতো মানসিকতাও আমাদের নেই। আমরা সবকিছুকেই সন্দেহ করি। শিষ্টাচারকেও ভাবি সরকারের কৌশল। কৌশলও যদি হয় এ ধরনের কৌশলে আমাদের কারোই আপত্তি থাকার কথা নয়। রাজনীতির মাঠে রাজনীতি থাকবে। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা রাজনীতিবিদদের প্রাপ্য সম্মানের কথাটি ভুলে না গেলে সবার জন্যই মঙ্গল।
আমানউল্লাহ আমান প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো খাবার খেয়েছেন বা গয়েশ্বর গোয়েন্দাদের খাবার খেয়েছেন বলেই তো বিএনপির আন্দোলন শেষ হয়ে যায়নি বা যাবেও না। আমান গয়েশ্বর যদি কাল আবার আন্দোলনের মাঠে নামেন সমস্যা তো নেই। মাঠে যতই লড়াই থাকুক, রাজনীতি থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়া শিষ্টাচার ফিরে এসেছে, এটাই স্বস্তির। এটা ধরে রাখতে হবে, সবাই মিলেই। সৌহার্দ্য হোক, শিষ্টাচার হোক, এমনকি কৌশল হোক; এমন কৌশলে আমার অন্তত কোনো আপত্তি নেই।
কিন্তু সরকারের এ আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সকালে মারের ছবি আর দুপুরে খাওয়ানোর ছবি পাশাপাশি দিয়ে হাস্যরস করেছেন। সরকারের সমর্থকরা বলছেন, যারা পুলিশের অনুমতি ছাড়া কর্মসূচি পালন করে আইন ভঙ্গ করলো, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। গ্রেপ্তার না করে তাদের আপ্যায়ন করা হলো কেন। এতে কি সরকারের দুর্বলতা উঠে এসেছে। আর সরকার বিরোধীরা তো ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজছেন। সরকার আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার জন্যই এ কৌশল নিয়েছে। অনেকে এমন অভিযোগও করেন, আমানউল্লাহ আমান কেন প্রধানমন্ত্রীর খাবার গ্রহণ করলেন। কেন প্রধানমন্ত্রীকে শিষ্টাচারের জন্য ধন্যবাদ দিলেন। গয়েশ্বর রায় কেন গোয়েন্দা কার্যালয়ে খাবার খেলেন।
আন্দোলনের মাঠে থেকে, মার খেয়েও আমান আর গয়েশ্বর এখন দলের নেতাকর্মীদের সন্দেহের তালিকায়। অবস্থা এতটাই খারাপ যে আমানউল্লাহ আমানকে এখন বলতে হচ্ছে, ‘আহত অবস্থায় হাসপাতালে থাকার সময় ওষুধ দিয়ে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। এ সময় কে বা কারা তাকে দেখতে এসেছিল এবং ফলের ঝুড়ি দিয়ে গেছে, তা আমি বুঝতে পারিনি।’
চলমান আন্দোলনে তার ভূমিকার পিঠে ছুরি মারার জন্য, নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত করার জন্য এই নাটক সাজানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। এ আন্দোলনে আছি, এতে মৃত্যু হলেও পিছপা হবো না।’
আমানউল্লাহ আমান বুঝতে পারেননি দাবি করলেও ভিডিওতে আমরা দেখেছি, প্রধানমন্ত্রীর এপিএস লিকু তার কানে কানে কথা বলছেন। ছবি দেখে মনে হয় তাদের সাক্ষাৎ খুব সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল। গয়েশ্বর রায়কেও হারুন অর রশীদ জোর করে খাওয়াননি। বেশ আন্তরিক ভঙ্গিতেই তুলে তুলে খাইয়েছেন।
এখন হয়তো নেতাকর্মীদের চাপে আমান দাবি করছেন, তিনি বুঝতে পারেননি। কিন্তু আমান এবং গয়েশ্বর ভুল কিছু করেননি। শিষ্টাচারের জবাব শিষ্টাচার দিয়েই দিতে হয়। প্রধানমন্ত্রীর উপহার ফিরিয়ে দেওয়া বা গোয়েন্দা কার্যালয়ে খাবার না খাওয়াটাই বরং অভদ্রতা হতো।
আমানউল্লাহ আমান প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো খাবার খেয়েছেন বা গয়েশ্বর গোয়েন্দাদের খাবার খেয়েছেন বলেই তো বিএনপির আন্দোলন শেষ হয়ে যায়নি বা যাবেও না। আমান গয়েশ্বর যদি কাল আবার আন্দোলনের মাঠে নামেন সমস্যা তো নেই। মাঠে যতই লড়াই থাকুক, রাজনীতি থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়া শিষ্টাচার ফিরে এসেছে, এটাই স্বস্তির। এটা ধরে রাখতে হবে, সবাই মিলেই। সৌহার্দ্য হোক, শিষ্টাচার হোক, এমনকি কৌশল হোক; এমন কৌশলে আমার অন্তত কোনো আপত্তি নেই।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম