দেবব্রত নীল
Advertisement
সংগীতের ক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বিরল ও বিস্ময়কর এক প্রতিভা। কাব্যের অভিসারের মধ্যেও নজরুল গীতিকবিতার ভুবনে প্রবেশ করেন। তার গীতিকাব্যে শব্দই হলো মূলধন। জীবনের সহস্র অনুভূতির অজস্র স্পর্শে তাঁর কথা হয়ে ওঠে নান্দনিক রূপকথা। তাঁর সমৃদ্ধ গীতিকবিতার সংখ্যাধিক্যের পাশাপাশি কালোত্তীর্ণ সংগীত নৈপুণ্য অনস্বীকার্য। অগ্রজ রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল বা রজনীকান্ত সেন ছিলেন সমকালীন সফল গীতিকার ও সুরস্রষ্টা। কিন্তু নজরুল শুধু সংগীতের রূপকারই নন, ছিলেন সংগীতের গবেষক ও আবিষ্কারক। রাগ-রাগিণীর মেলবন্ধনে নজরুল গড়ে তুলেছিলেন বাংলা গানে বৈচিত্র্যের এক অনন্য ভান্ডার। তাঁর সংগীত বিষয়ক জ্ঞান ও সৃজনশীল অবদান বাঙালির গানের দিগন্তকে বিস্তৃত করেছে অতুলনীয় মাত্রায়। শুধু তাই নয়, তাঁর অর্জিত ধ্রুপদী রাগ-রাগিণী আশ্রিত গানের অভিজ্ঞতাকে নজরুল বাংলা গানের অন্তর্ভুক্ত করায় বাংলা গান ফিরে পেয়েছে সংগীতের অনির্বচনীয় মাধ্যম। তিনি বহু নতুন রাগ সৃষ্টি করেছেন, হারিয়ে যাওয়া বহু রাগ-রাগিণীকে উদ্ধার করেছেন এবং পুরাতন ও নতুন রাগের সুসংমিশ্রণ ঘটিয়ে অনন্যসুন্দর সংগীত সৃষ্টি করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর কোনো তুলনা নেই।
আবার নজরুলের আরেকটি বড় কৃতিত্ব এই যে, তিনি বাংলা গানে অভূতপূর্ব বৈচিত্র্য এনেছেন। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, শহুরে-গ্রামীণ, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ, জাতি-উপজাতি সব শ্রেণির মানুষের জন্য গান রচনা করেছেন। প্রেমের গান লিখেছেন আবার বিপ্লবের গানও রচেছেন। বাংলা গানে আধুনিকতার প্রবর্তন করেছেন আবার লোকাঙ্গিকের গানেও নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য ধর্মীয় সংগীত রচনা করেছেন। নাটক ও সিনেমার জন্য গান রচনা করেছেন। দেশপ্রেমমূলক ও জাতীয় জাগরণের গান লিখেছেন। মানুষে মানুষে মহামিলনের সংগীত রচনা করেছেন। স্বভাবতই বৈচিত্র্যে ও সংখ্যায় নজরুলের গানের অবস্থান অন্যসব গীতিকারের অবস্থানের ওপরে। সংগীতকার নজরুলকে সম্যকভাবে বোঝার ক্ষেত্রে তাঁর সুরবৈচিত্র্য সম্পর্কে জ্ঞানলাভ যেমন প্রয়োজন; তেমনি তাঁর গানের বাণীর কাব্যিক বৈচিত্র্য ও অর্থব্যঞ্জনা বিষয়ে অবহিত হওয়াও আবশ্যক। সেই ভাবনা মাথায় রেখে শক্তিমান কবি ও গবেষক আমিনুল ইসলাম নজরুলের গানের ভাবসম্পদ নিয়ে রচনা করেছেন ‘নজরুল সংগীত: বাণীর বৈভব’ নামক এক অনন্যসাধারণ গ্রন্থ; যাতে আছে ২৪টি স্বতন্ত্র অধ্যায়। প্রতিটি অধ্যায়ের বিশ্লেষণে তিনি আবিষ্কার করেছেন ভিন্ন এক নজরুলকে।
গ্রন্থটির শুরতেই নজরুল সংগীতের বাণীর বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিস্তৃত আলোচনায় গবেষক ও কবি আমিনুল ইসলাম দেখিয়েছেন আকাশে বলাকার গান, জলে জলতরঙ্গের মিউজিক, বাতাসে মন উদাস করা সুর আর ভারত উপমহাদেশের ভূ-প্রকৃতি ও জীবনযাপন প্রণালি নজরুলকে এক অনন্য বৈশিষ্ট্য দান করেছে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নজরুলই ছিলেন শেষ পুরুষ; যিনি একই সঙ্গে কবি-গীতিকার-সুরকার-শিল্পী-অভিনেতা। তিনিই বাংলা গানের জগতে সর্বাধিক সংখ্যক গানের রচিয়তা। নজরুল স্বতন্ত্র, তাঁর সংগীত তাঁর নিজের মতো। তিনি যেমন উচ্চমার্গের বিদগ্ধ শ্রোতার রুচি উপযোগী গান রচনা করেছেন; তেমনই অখ্যাতজনদের জন্যও রচনা করেছেন লোকায়ত সুরে সহজ কথার অজস্র গান। নজরুল ইসলাম সব শ্রেণির মানুষের গীতিকার, তিনি সমাজের উঁচুতলার লোকদের সাথে যেমন মিশেছেন ততধিক গভীরভাবে ও নিবিড়ভাবে মিশেছেন সমাজের খেটে-খাওয়া কুলি-মজুর, শ্রমিক-কৃষাণ, জেলে-মাঝি, কামার-কুমার, সাঁওতাল-মুন্ডা, গারো-খাসিয়া, রাজমিস্ত্রি, তাঁতি-ধোপা, বাউল, সাপুড়ে-বেদে অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষের সাথে। তিনি তাদের মধ্যে প্রচলিত সংগীতকে কথিত ভদ্রসমাজের চোখের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছেন এবং সেই লক্ষ্যে তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আবেগ-কল্পনা, ভালো লাগা-মন্দ লাগাকে বিষয় করে অজস্র গান রচনা করেছেন। পণ্ডিত থেকে পথচারী, শহরবাসী ভদ্রলোক থেকে মাঠের রাখাল সবাই ছিলেন তাঁর আত্মার আত্মীয়। পর কাকে বলে এটা তাঁর সিলেবাসে ছিল না। গ্রন্থটির ২৪ পাতার এ অধ্যায়টি নজরুল জীবনের একটি সত্যিকারের ম্যাগনাকার্টা। শুধু একটি অধ্যায় দিয়েই একটি বই রচনা করা যেতে পারে। লেখকের গভীর আত্মনিবদেন, মগ্নতা প্রতিটি পৃষ্ঠায় শব্দরূপ ধারণ করে পাঠকের তৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম হয়েছে। তিনি নজরুলের গানের স্বর আর সুরকে সাধারণের বৈঠকখানায় পৌঁছে দিয়ে প্রমাণ করেছেন নজরুলের গান হলো মানবজীবনের বিশ্বকোষ। নজরুলের গানকে পরিপূর্ণভাবে বুঝতে অধ্যায়টির পাঠগ্রহণ আবশ্যক।
Advertisement
লেখক ও গবেষক আমিনুল ইসলাম ‘নজরুল সংগীত: বাণীর বৈভব’ গ্রন্থে নজরুলের গানের প্রতিটি শব্দ বিশ্লেষণ করে উৎস অনুসন্ধান করে দেখিয়েছেন নজরুল বিশ্বালয়ের বিরাট শিশু হয়ে খেলেছেন শব্দ নিয়ে। আরবি-ফারসি-উর্দু-হিন্দি-লোকজ-তৎসম-তদ্ভব-সংস্কৃত-গুরুগম্ভীর-হালকা-দেশি-বিদেশি শব্দের বিপুল ভান্ডার হৃদয়ে ধারণ করে নজরুল হয়ে উঠেছিলেন শব্দের ‘জাগলার’ বা জাদুকর। নজরুল গবেষক আমিনুল ইসলাম দেখিয়েছেন, কীভাবে নজরুলের হাত ধরেই বাংলা গান নেমে এসেছে ফসলের মাঠে, নদীর জলে, শ্রমিকের কারখানায় কয়লাখনিতে, সাঁওতালনীর তালপুকুরে কিংবা বাউলের বটতলায়। লেখক নজরুলের রচিত গানের সমুদ্র দেবতাদের মতো মন্থন করে তুলে এনেছেন এক অমূল্য অমৃত ভান্ডার। এই ভান্ডারে অমূল্য রতনের মতো আমরা পাই নজরুলের গানে লোকজ শব্দের নানা বাহার। দুইশতেরও অধিক লোকজ শব্দের উদাহরণ টেনে লেখক দেখিয়েছেন, নজরুল প্রতিটি শব্দের ব্যবহার ঘটিয়েছেন শিল্পসম্মতভাবে এবং রুচিসম্মতভাবে। সাধারণ সংসারী মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের নানাবিধ চিত্র এবং তার ইহকাল-পরকাল ভাবনা, সমাজে প্রচলিত নানাবিধ রূপকথা ও কিংবদন্তির পাশাপাশি উপজাতীয় জনগোষ্ঠীসহ গ্রামকেন্দ্রিক বিভিন্ন পেশার মানুষের ভাবনা-চিন্তাকে নিবিড়ভাবে স্পর্শ করে গেছে তাঁকে। বিশ্ব শব্দসম্রাট কাজী নজরুল ইসলাম বিধাতার মত নির্ভয় হয়ে তাঁর গানে উদ্দীপনামূলক, আক্রমণাত্মক গতি, আত্মবিশ্বাসবৃদ্ধিকারী উপমা, প্রতিরোধের চিত্রকল্প, ভেঙে ফেলার উসকানি, রক্তে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী তাল ও ছন্দ সৃষ্টির শব্দাবলি ব্যবহার করে বাংলা সাহিত্যেকে ভিন্ন মাত্রার শব্দ ও ছন্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আমিনুল ইসলাম বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, নজরুল সংগীতের বাণীর নদীগুলো মোহনায় এসে মিলিত হয় সুরের সাতসমুদ্রে। নজরুলের গানে শব্দের ব্যবহার সম্পর্কিত অধ্যায়টিতে আমিনুল ইসলাম অজস্র উদাহরণযোগে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, নজরুল বাংলা ভাষার ভান্ডারে কী বিপুল পরিমাণ শব্দ যোগ করেছেন। অকাট্য প্রমাণযোগে তিনি আরও দেখিয়েছেন, নজরুলের হাতে কীভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে বাংলাভাষার ধারণ ও প্রকাশ ক্ষমতা।
আমিনুল ইসলাম ‘নজরুলসংগীত: বাণীর বৈভব’ গ্রন্থে সুনিপুণ চিত্রকরের দক্ষতায় হীরকখণ্ডের মতো মূল্যবান ও প্রভাময় নজরুলের গানের চিত্রকল্পগুলো এক মলাটে গেঁথে রেখেছেন। পারস্যের বুলবুল, শরাব, সাকী, গোল, নার্গিস আর দিলরুবাদের বাংলা গানের জগতে স্থান দিয়ে বাংলা ভাষার বর্ণোচ্ছল জগতের সৃষ্টি করেছেন নজরুল। তাঁর গানের জগতে ঢুকলে মনে হয় আমরা যেন বিশাল এক আর্ট গ্যালারিতে প্রবেশ করেছি। একটির পর একটি নজরুলের গানের বই পড়ুন, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ওল্টান, পর পর পঙক্তি দেখুন-দেখবেন কেবল স্তবকে নয় পঙক্তিতে পঙক্তিতে, পঙক্তির পর্বে, কখনো শব্দে শব্দে শুধু ছবি আর ছবি। এত সুন্দর অনুপম বিশ্লেষণ শুধু একনিষ্ঠ সাধক হলেই করা যায়। কবি আমিনুল ইসলাম যোগী তপস্যীর মতো একেবারে নজরুলের ভেতরে প্রবেশ করে নজরুলকে আবিষ্কার করেছেন। তাঁর এই আত্মনিবদেনই বইটিকে অনন্য করেছে।
নজরুলের প্রেমের গান নিয়ে বিশ্লেষণ করে গবেষক আমিনুল ইসলাম হাজারো নজরুল ভক্তের হৃদয়ের কথা ব্যক্ত করে বলেছেন, বিশ্ব-প্রেমিক নজরুল সর্বশ্রেণির মানুষের কবি। তিনি জনচিত্তজয়ী প্রেমের কবি। কাজী নজরুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী’ কবি নামে খ্যাত হলেও তিনি মূলত প্রেমের কবি। প্রেমকে তিনি অনুভব করেছেন হৃদয় দিয়ে। তাঁর সুবিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় তিনি ব্যক্ত করেছেন ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ-তূর্য’। নজরুলের বিদ্রোহী সত্তা মূলত তাঁর বৃহত্তর প্রেমসত্তারই একটি অংশ। তাঁর আধুনিক গান, রাগপ্রধান গান, লোকসংগীত গান প্রভৃতি মূলতই প্রেমের গান। কবি ও গবেষক আমিনুল ইসলাম প্রেমিক নজরুলের অন্দরমহলে প্রবেশ করে বলেছেন, প্রেম হলো নজরুলের আত্মার অর্জিত অভিজ্ঞান। ‘বিদ্রোহী’ নামক সুবিখ্যাত কবিতাটি রচে রাতারাতি বিদ্রোহী কবি হিসেবে চিহ্নিত না হয়ে গেলে হয়তো তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রধান প্রেমের কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করতেন। আমিনুল ইসলাম প্রমাণসহকারে দেখিয়েছেন সংগীতে নজরুলের প্রেমভাবনার আধুনিকতা ও অনন্যতা। আধুনিক গানের ভাষা কেমন হওয়া প্রয়োজন, নজরুলের গান থেকে অনেক উদাহরণ টেনে তিনি আলোচনা করেছেন।
গবেষক আমিনুল ইসলাম নজরুলের কবিতা-গানকে বাংলার ফুলবাগান বলে অভিহিত করেছেন। নীলযমুনার জল, কদম বনভূমি, নীলাম্বরী পরিহিত হয়ে নজরুলের সঙ্গে সহবাস করে বাংলার রূপ ও সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন। বসন্তে যেমন ফুল ফোটে, নতুন পাতা গজায়, পাখি ডাকে, তেমনি ঝরে যায় বয়স্ক পাতা, শুকিয়ে যায় অনাদরে আহত কুঁড়ি, অভিমানে ধুলোয় ঢলে পড়ে ভ্রমরের আলিঙ্গনবঞ্চিত ফুলবধূ। আর এসব পাওয়া না পাওয়াই নজরুল তার গানে তুলে ধরেছেন। নজরুলের গানে ফুল ব্যবহৃত হয়েছে উপমা ও চিত্রকল্প নির্মাণে। ফুলের প্রতীকে মানবজীবনের ছবিও অঙ্কিত হয়েছে। নজরুল শক্তিমান কবি বলেই ফুলের এমন কাব্যিক ব্যবহার করতে পেরেছেন। গ্রন্থটিতে বিষয়টি সুন্দরভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
Advertisement
কবি ও গবেষক আমিনুল ইসলাম নজরুলের ইসলামি গানগুলোর বিষয়ে আলোকপাত করে দেখিয়েছেন, সংগীতবিমুখ সংস্কৃতিবিমুখ বাঙালি মুসলমান সমাজকে মানসিক সংস্কারের অচলায়তন ভেঙে বের করে এনেছেন নজরুল। নজরুল ইসলামি গানের মধ্যে মুসলমানের হারানো শৌর্য-বীর্যের কথা, বীরত্বগাথা, তৌহিদী সুর ও বাণী, ইহকাল-পরকালের ছবি অঙ্কন করেছেন। তিনি নজরুলের ইসলামি গানকে বিশ্লেষণ করে জাগরণমূলক গান, প্রার্থনামূলক গান এবং স্তুতিমূলক গান এই তিন ধারায় ভাগ করেছেন। আমিনুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন, নজরুলের ইসলামি গান হতাশাগ্রস্ত মুসলমানদের আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলা এবং গানের ভেতর ইসলামের পরমতসহিষ্ণু বিশ্বভ্রাতৃত্বের মর্মবাণী তুলে দিয়ে বাঙালি মুসলমানদের আত্মমর্যাদাবোধ, আত্ম-স্বাতন্ত্র্য এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে নজরুল তাঁর ‘শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল’ ফরমুলায় ইসলামি গান রচনা করে সে-সময়ের সংগীতবিমুখ বাঙালি মুসলমানকে সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট ও ইতিবাচক মনোভাবের অধিকারী করে তোলেন। এতে তাদের মধ্যে বিরাজিত সাংস্কৃতিক কূপমণ্ডুকতা দূরীভূত হওয়ার শুভ সূচনা ঘটে। একইসঙ্গে হিন্দুধর্মসংগীত নিয়ে নজরুলের গান পরিমাণগত বিপুলতা, বিষয় বৈচিত্র্যের ব্যাপকতা ও সুরের উৎকর্ষের মাধ্যমে আবহমান বাংলার হিন্দুপ্রভাব পুনরুজ্জীবিত করেছে। নজরুল ধর্মের নামে হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ বিগ্রহ দূর করে মানুষের মাঝে হারানো ঐক্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য সর্বজনীন আবেদনের ভাষায় রচেছেন মহামিলনের গান। তিনি বলেছেন এই মহামিলনের বৃন্দাবন রচনার জন্য প্রয়োজন যুবশক্তির সৃজনশীল উদার মনের বিকাশ। তারা যদি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রীতিডোরে বাঁধে পরস্পরকে, তাহলেই জগতে প্রতিষ্ঠিত হবে ভালোবাসার রাজ্য। বইটিতে পর্যাপ্ত দৃষ্টান্তযোগে নজরুলের মহামলিনের গানের অনন্যতা ও উৎকর্ষের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে একজন আধুনিক নজরুলের আবিষ্কার লক্ষ্য করা যায় বইটিতে। বাংলা সাহিত্যে নজরুল আধুনিকতার সূচনা করেছেন এবং আধুনিকতাকে অনেকখানি প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। নজরুল ছিলেন ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠী-লিঙ্গভিত্তিক ভেদাভেদের বিপক্ষের মানুষ। তিনি সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করতেন যে, নারী-পুরুষের সম্মিলিত কর্মপ্রবাহেই চলমান রয়েছে মানবসভ্যতা। কাজী নজরুল ইসলাম আধুনিক বাংলা গানের প্রবর্তক এবং একইসঙ্গে আধুনিক বাংলা গানকে তিনি মহিমার শিখরে উন্নীত করেছেন। অন্যদিকে তাঁর গানের বাণীগুলো কবিতা হিসেবেও আধুনিকতার শৈল্পিক সৌন্দর্য বহনকারী। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিতে আধুনিকতার প্রবর্তন সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে হলে নজরুলের গানসমূহের পাঠ গ্রহণ অত্যাবশ্যক। আমিনুল ইসলামের এই বইয়ে বিষয়টি অজস্র প্রমাণ ও যুক্তিসহ উপস্থাপিত ও বিশ্লেষিত হয়েছে।
‘নজরুলসংগীত: বাণীর বৈভব’ গ্রন্থের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টির নাম ‘নজরুলের গান: বাণীর বৈভব’। এ অধ্যায়ে নির্বাচিত ১০০টি নজরুলসংগীতের বাণীর কাব্যিক ব্যঞ্জনা উপস্থাপিত ও বিশ্লেষিত হয়েছে। যারা নজরুলসংগীত পরিবেশন করেন এবং ভবিষ্যতে করবেন, তাদের জন্য অধ্যায়টির পাঠগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। কারণ সুরের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে বাণীকে ব্যঞ্জিত করা। গানের কাব্যের মর্মবাণী জানা হলে পরিবেশনের সময় সুর ও বাণীর হরগৌরী মিলন ঘটানো সহজ হয়। নজরুলের গানের বাণীর বিকৃতি ঘটালে কী ধরনের অর্থ-বিপর্যয় ঘটে, সে বিষয়টিও আলোচিত হয়েছে উদাহরণ সহযোগে। অধ্যায়টিও নজরুল সংগীত শিল্পীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য মর্মে গণ্য হতে পারে।
কবি ও গবেষক আমিনুল ইসলাম দেখিয়েছেন বিষয়, ভাব, ভাষা ও ছন্দ ব্যবহার করে নজরুল বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে এক নতুন ঝড়ের সূত্রপাত করেন। ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙ্গে ফেল্ করলে লোপাট’ গানটি রচিত হওয়ার পূর্বে কেউ ভাবতে পারেনি এমন জ্বালাময়ী ভাষায় ও সুরে বাংলা গান রচিত হতে পারে। ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ’ গানটি আব্বাসউদ্দীন আহমদের কণ্ঠে প্রচারিত হওয়ার আগে কেউ কল্পনা করতে পারেননি এভাবে ইসলামি গান রচনা করা যায়। ‘কালবৈশাখী যেমন কোথা থেকে এলো, কী করে এলো, বুঝতে বুঝতে না বুঝতেই সব ছিন্ন করে দেয়, তেমনি মানুষ নজরুলের আগমনও মৌসুমি ঝড়ের মতো। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে তাঁর আবির্ভাবটাও ঝড়ের মতো আকস্মিক। তাঁর আগমনের কোনো আভাসই ছিল না। সহসা এলেন, দেখলেন এবং বিজয় নিশান উড়িয়ে দিয়ে সহসাই থেমে যাওয়া ঝড়ের মতো নীরব হয়ে গেলেন। ঝড় থেমে গেলেও যেমন ঝড়ের ঝাপটা থেকে যায়, তেমনি নজরুল নামক এ ঝড়ের ফলাফল চিরস্থায়ী রূপে রয়ে গেছে বাংলা সাহিত্যে। সংগীতের ক্ষেত্রে নজরুলের অবদান অতুলনীয় ও অবিনশ্বর মহিমা লাভ করেছে, বিষয়টি আমিনুল ইসলাম বিশ্বাসযোগ্য মাত্রায় উপস্থাপন করেছেন।
নজরুল তাঁর সাংগীতিক সাধনায় বাংলা সংগীতের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্য ও ভাষাকে কী অপরিমেয় ঐশ্বর্য দিয়ে গেছেন, নজরুলের গানগুলো পাঠ ও বিশ্লেষণ করলে তা আঁচ করা সম্ভব। আসলে সংগীতকার নজরুলকে ভালোমতো পাঠ করা ছাড়া প্রকৃত নজরুলকে সম্যকভাবে জানা অসম্ভব ব্যাপার। নজরুলের সব কবিতা না হলেও অনেক কবিতাই বর্ণনামূলক এবং অনেক সময় শিথিলবাঁধন। কিন্তু তাঁর গানগুলো কবিতা হিসেবে অনেক বেশি সংযত, ব্যঞ্জনাময় ও শৈলীর সৌকর্যে সমৃদ্ধ। কবি হিসেবে নজরুল কত শক্তিশালী ছিলেন তার উজ্জল স্বাক্ষর বহন করে তাঁর গানগুলোর বাণী। নজরুল ছিলেন বাংলা গানের ধ্রুবতারা। হিন্দু পুরাণের মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত, বশিষ্ট প্রমুখ মুনি-ঋষিদের মিলিত সত্তায় সৃষ্ট সপ্তর্ষি মণ্ডলের মহাশক্তি, মহাজ্ঞানী, মহাঋষি ছিলেন নজরুল। বাংলার ভাগ্যাকাশের এক অতি দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে ‘বিনাশায় চ দুস্কৃতম’ বিদ্রোহী কবি নজরুলের আবির্ভাবের প্রয়োজন ছিল; আর সেই জন্যই তিনি এসেছিলেন। বাংলার যুবশক্তিকে উজ্জীবিত করে, মূঢ় ম্লান দেশবাসীর মুখে ভাষা দিয়ে কবি নজরুল আবার চির নিস্তব্ধ হয়ে যান। কবি নজরুল আর সংগীত-গীতিকার নজরুল একই পাতার দুটি পৃষ্ঠা। তাই তাঁকে পূর্ণভাবে জানতে হলে একই সাথে তাঁর অন্য সৃষ্টির সঙ্গে গানগুলোও সমান গুরুত্বে অবশ্যপাঠ্য। সেক্ষেত্রে আমিনুল ইসলামের ‘নজরুলসংগীত: বাণীর বৈভব’ গ্রন্থটি হতে পারে সবচয়ে বড় সহায়। গানের বাণীর বৈভব নিয়ে এমন পূর্ণাঙ্গ প্রকৃতির গবেষণামূলক গ্রন্থ সম্ভবত এটিই প্রথম। সংগীতে বাণীর ঐশ্বর্য নিয়ে ভবিষ্যতে গবেষণার ক্ষেত্রে এটি একটি আকরগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হবে। যতদিন কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা-গান থাকবে, ততদিন প্রাসঙ্গিক থাকবে আমিনুল ইসলামের ‘নজরুলসংগীত: বাণীর বৈভব’ গ্রন্থটির পাঠ।
বইয়ের নাম: নজরুলসংগীত: বাণীর বৈভবগবেষক: আমিনুল ইসলামপ্রচ্ছদ: আনওয়ার ফারুকপ্রকাশকাল: জুন ২০২১প্রকাশক: বাংলা একাডেমিমূল্য: ৬২০ টাকা।
এসইউ/জেআইএম