এ বছর এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় সবদিক দিয়ে এগিয়ে মেয়েরা। দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডে ছাত্রীদের পাসের হার ৮১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আর ছাত্রদের পাসের হার ৭৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ। সংখ্যার হিসাবে ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীদের এগিয়ে থাকার ব্যবধান প্রায় ৪৮ হাজার। আবার ছাত্রদের চেয়ে ১৩ হাজার ৬৫০ জন বেশি ছাত্রী জিপিএ-৫ অর্জন করেছে। পরীক্ষায় অংশও নিয়েছিল বেশি সংখ্যক ছাত্রী। গত কয়েক বছর ধরেই এসএসসিতে শ্রেষ্ঠত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছে ছাত্রীরা। অন্যদিকে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে ছাত্ররা।
Advertisement
ছাত্রদের এ পিছিয়ে পড়ার পেছনে ‘কিশোর গ্যাং’-এ জড়িয়ে পড়াকে প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী।
আরও পড়ুন: ছাত্র সংখ্যা কমে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগ
রাশেদা কে চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা (ছাত্রদের পিছিয়ে পড়া) বোধহয় আরও একটু খতিয়ে দেখা দরকার। তাদের (ছাত্রদের) পিছিয়ে পড়ার একটি কারণ হলো- তারা মাধ্যমিক স্তরে এসে অনেকে শ্রমে যুক্ত হয়ে যায়। যেটা মেয়েরা এখন কম জড়াচ্ছে। দ্বিতীয়ত- যেটাকে আমি এখন প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করি, সেটা হলো- কিশোর গ্যাং। এতে কি কোনো মেয়ে আছে? নেই, সব কিন্তু ছেলেরা। কিশোর বয়সী ছেলেরা, যাদের অধিকাংশই স্কুলের ছাত্র। তো এ বয়সে ওরা কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে অপরাধে যুক্ত হয়ে পড়ছে। ঝরে যাচ্ছে, লেখাপড়ায় চরম অমনোযোগী হয়ে পড়ছে, শিক্ষাজীবন থেকে ছিটকে অন্ধকার জগতে জড়িয়ে পড়ছে ওরা।’
Advertisement
গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী
তিনি বলেন, ‘যখন তার পড়ার টেবিলে থাকার কথা, তখন সে একেবারে অনাবশ্যক, অনাকাঙ্ক্ষিত কাজে জড়িয়ে পড়ে। সেটার জন্য তার লেখাপড়ার ওপর খুবই বাজে প্রভাব পড়ে। এ বয়সের ছেলেরা বাইরে বাইরে বেশি সময় কাটিয়ে ফেলছে। স্কুলে বা বাসায় পড়ার টেবিলে বসার সময়ই যেন তাদের নেই।’
আরও পড়ুন: জিপিএ-৫ পেল ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮, এগিয়ে মেয়েরা
প্রযুক্তিতে আসক্ত হয়ে পড়ার ক্ষেত্রেও ছেলেরা এগিয়ে বলে মনে করেন রাশেদা কে চৌধুরী। তার ভাষ্য, ‘আমি একেবারে তথ্য-পরিসংখ্যান হাজির করে ঠিক বলতে পারবো না। অবজারভেশন করেছি, মনে হয়েছে- মেয়েদের চেয়েও ছেলেরা প্রযুক্তিতে বেশি আসক্ত। সেটা হোক মোবাইল বা ইন্টারনেট গেম, টিকটক হোক অথবা কখনো একটা ফেসবুক পেজ খুলে ভিডিও বানানো শুরুর নেশায় হোক; তারা কিন্তু বেশি প্রযুক্তিতে আসক্ত।’
Advertisement
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এ উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘আজকে ফল প্রকাশের সময় বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দেখলাম কথা বলেছেন। অবশ্যই সেটা ভালো দিক। ছাত্রদেরও ঝরেপড়া রোধে কাজ করতে হবে। তবে এই যে ছাত্রদের পিছিয়ে পড়া নিয়ে যে হাইপ উঠে গেলো, এতে সতর্কও থাকতে হবে। জেন্ডার ব্যালান্স (লিঙ্গ ভারসাম্য) পদক্ষেপ নিয়ে পরে যেন আবারও ইমব্যালান্স (ভারসাম্যহীন) তৈরি না হয়। সতর্কতার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।
রাশেদা কে চৌধুরী আরও বলেন, ‘আবার এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, এরা (২০২৩ সালের পরীক্ষার্থীরা) যখন অষ্টম-নবম শ্রেণির ছাত্র, করোনাভাইরাস মহামারিটা তো ঠিক তখনই গেলো। করোনাকালে তো ওদের পড়াশোনায় ভাটা পড়েছে। সেটার প্রভাবও থাকতে পারে। এটা যত দ্রুত কাটিয়ে ওঠা যাবে, ততই ভালো।’
ছাত্রদের পিছিয়ে পড়া নিয়ে কাজ করার তাগিদ দিয়েছেন আরেক শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান। তিনি জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা এবং গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) সাবেক পরিচালক।
আরও পড়ুন: পূর্ণ নম্বরের পরীক্ষা হওয়ায় পাসের হার-জিপিএ ৫ কম: শিক্ষামন্ত্রী
অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘সব ক্ষেত্রে ছেলেদের চেয়ে মেয়ে বেশি। দেশের জনসংখ্যা অর্থাৎ আদমশুমারি বা জনশুমারি যেটাই বলি না কেন, তাতে বালকদের সংখ্যা বালিকাদের চেয়ে বেশি দেখি অনুপাতিক হারে। কিন্তু এসএসসির রেজাল্টে দেখা যাচ্ছে- পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ছেলের চেয়ে মেয়ে বেশি। আবার পাসের হারেও মেয়েরা বেশি, জিপি-৫ পাওয়ার দিক থেকেও ছাত্রীরা এগিয়ে। এটা অবশ্যই বড় অর্জন। কিন্তু আমি মনে করি- ছেলে-মেয়ে সবাই এগিয়ে যাবে। একটা সেকশন এগিয়ে যাবে, আরেকটা পিছিয়ে যাবে এটা ভালো দিক নয়।’
কিশোর গ্যাংয়ের একটি দল। যাদের র্যাবের অভিযানে আটক করা হয়
তিনি বলেন, ‘ছেলেদের পিছিয়ে থাকার কারণ খুঁজতে হবে। সমাজের একটা অংশ পিছিয়ে পড়লে তা খারাপ দিক। এতদিন মেয়েরা পিছিয়ে ছিল। এখন ছেলেরা ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করে কারণ খুঁজে বের করতে হবে। বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে হবে।’
চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের ফল শুক্রবার (২৮ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফল প্রকাশ কার্যক্রমের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। এর আগে সকাল ৯টার দিকে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর হাতে ফলাফলের সারসংক্ষেপ তুলে দেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।
আরও পড়ুন: এসএসসিতে শতভাগ পাসের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কমেছে
ফল প্রকাশ কার্যক্রম উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, ‘এবার ২০ লাখ ৭৮ হাজার ২১৬ জন পরীক্ষার্থী ছিল। এরমধ্যে ছাত্রের সংখ্যা হচ্ছে ১০ লাখ ২৪ হাজার ৯৮০ জন, যা ৪৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। ছাত্রীর সংখ্যা হচ্ছে ১০ লাখ ৫৩ হাজার ২৪৬ জন, যা ৫০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ছেলের সংখ্যা কেন কমে যাচ্ছে, একটু ভেবে দেখা দরকার। এরা কি স্কুলে যাচ্ছে না? আমার মনে হয়- শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে তা ভালোভাবে দেখা দরকার।’
এদিকে, বেলা ১১টায় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে সংবাদ সম্মেলনে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী।
প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে, এবার এসএসসিতে গড় পাসের হার ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। মোট পাস করেছে ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৪০ জন। এরমধ্যে ছাত্র ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৪০৪ জন এবং ছাত্রী ৮ লাখ ৪৪ হাজার ৭৩৬ জন। অর্থাৎ ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীদের এগিয়ে থাকার ব্যবধান সংখ্যার হিসাবে প্রায় ৪৮ হাজার জন।
অন্যদিকে এবার মোট জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭৮ জন। তাদের মধ্যে ছাত্র ৮৪ হাজার ৯৬৪ জন এবং ছাত্রী ৯৮ হাজার ৬১৪ জন। ছাত্রদের চেয়ে ১৩ হাজার ৬৫০ জন বেশি ছাত্রী জিপিএ-৫ অর্জন করেছে।
এএএইচ/জেডএইচ/এমএস