সাহিত্য

যে আকাশ শুধুই আমার

মসজিদের ঘাটলা দিয়ে নামার পথে তালের চারাটা বড্ড বেশি ঝুঁকে আছে। কুদ্দুস মনে মনে বলে, একটা দা থাকলে এখনি তালপাতার কিনারা কেটে ঘাটলায় নামার পথ পরিষ্কার করা যেতো। তাড়াতাড়ি তালের পাতা একদিকে সরিয়ে কুদ্দুস ঘাটলা দিয়ে নামে। পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে আকাশের দিকে তাকায়। ওখানে ধূসর মেঘ ধেয়ে চলেছে অজানার পানে।

Advertisement

ভেজা আর নিস্তেজ রোদের মহড়া তরু-পল্লবের ফাঁকে ফাঁকে। সূর্যের সোনালি শেষ আলোটুকু নিস্তরঙ্গ পুকুরকে বিদায় জানাতে ব্যস্ত।

জলের সুপ্তোত্থান ঘটলো কুদ্দুসের হস্তচালনে। আসরের আজান দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। গলায় ঝুলানো তামার খিলান দিয়ে দাঁত খিলান শেষ করে অজু সারলো।

মসজিদের লাগোয়া গড়। এদেশে পুকুর নয়, খালও নয় এমন জলাধারকে “গড়” বলে। কুদ্দুস কান সচল করে ঘাড় ঘুরিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো কীসের শব্দ কানে আসছে। মনে হচ্ছে গড়ের দিক হতেই কণ্ঠস্বরের আগমন। এলোমেলো নৌকা ভিড়ানোর ফুড়ত-ফাড়ত আওয়াজ। তড়িঘড়ি শেষ কুলিটা ঘাটলার পাশে নিক্ষেপ করে কুদ্দুস উপরে এসে দাঁড়ায়। চোখে-মুখে তার স্পষ্ট জলের ছাপ।

Advertisement

নওয়াবাড়ির হেলাল বউসহ গ্রামে এসেছে। নৌকা থেকে নেমে বহুদূরপথের পথিকের মতো ক্লান্ত-অবসন্ন বদনে তারা মসজিদের লাগোয়া পথে দাঁড়ায়। চারদিকে চোখ রাখে। গ্রামের শান্তিময় বৈচিত্র্য অনেকটাই এখন পরিবর্তিত। গড়ের পাড়ের কাউগাছটি আরো উপরে মাথা তুলেছে। পানশিউলির ঝোপটি খুব বেশি বিস্তৃত হতে পারেনি বটে; তবে প্রোথিত শেকড়ের দৌরাত্ম্য চোখে পড়ার মতো। পুকুরের ওই পাড়ে তরুরাজির আড়ালে গোয়ালঘরের নতুন চালের স্তিমিত রৌদ্রস্নাত কিয়দংশ নজর কাড়ছে।

হেলাল কেরায়া নৌকার ভাড়া মিটিয়ে দিলো। সে কুদ্দুসদের বংশেরই লোক, সম্পর্কে কুদ্দুসের চাচা হয়।

পুকুরের পূর্বপাড়ে হেলালের বাবা রমিজুদ্দিনসহ তারা কয়েক গৃহস্থ মিলে নতুন বাড়ি বেঁধেছে। এজন্য ঐ বাড়ি ‘নওয়া বাড়ি’ নামে পরিচিত।

হেলাল হাসি দিয়ে কুদ্দুসের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, “কিও কুদ্দুস ভালো আছোনি?”

Advertisement

“আছি একরকম কাগা! আমনেরা কেরুম আছেন?”

“আমরাও ভালো আছি। তোমার চাচিআম্মার খুব শখ বারিষকালে গ্রামে আসবে। নৌকায় বেড়াবে। এজন্যই চলে এলাম।”

হেলালের স্ত্রী ঘোমটা টেনে হাসি মুখে দুই কদম এগোয়। তার ঘোমটা ছাপিয়ে কয়েক গোছা সরু চুলের ফালি সৌন্দর্যের দ্যুতি ছড়াচ্ছে। কপালের বড় টিপখানাও কুদ্দুসের দৃষ্টি এড়ালো না। কুদ্দুসের সম্মুখে এসব কিছুই সুন্দর অথচ কুদ্দুস তাতে কেবল আঁধার অনুভব করে। সে দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। খানিকটা সহজ হয়ে বলে, “চাচিআম্মার লেখাপড়া শেষ হইছেনি কাগা?”

“আর অল্প কয়দিন।”

“আইচ্ছা কাগা, বেয়াদবি নিবেন না। আমনেরা বাড়ির দিগে যান। আমি আমনের ব্যাগডা আগাইয়া দেই।”

কুদ্দুস তড়িঘড়ি হেলালের বড় ব্যাগটি কাঁধে নিতে গেলে হেলাল নিষেধ করে। বলে, “আরে আরে করো কি! এই ব্যাগ আমি নিতে পারবো। ওজনতো বেশি নয়!”

হেলাল নিজেই ব্যাগ হাতে নিয়ে বউসহ বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়।

কুদ্দুস সন্তর্পণে গাব গাছের নিচে এসে কেবলামুখি হয়ে দাঁড়ায়। বুঝ হওয়ার পর থেকে ঝাঁকড়া চুলের কালচে সবুজ পাতার গাছটিকে এইরকম দেখে আসছে সে। সময়ের নির্যাস লেগে আছে প্রতিটি পাতার আনাচেকানাচে।

কুদ্দুস আজান শুরু করে। চারপাশে ব্যাঙের হৈ-হল্লা। তার সাথে আজানের সুরের ডালি বর্ষার নিস্তরঙ্গ জলের স্রোতে ছড়িয়ে পড়লো সেতুপুর গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায়।

দশবছর বয়স থেকে কুদ্দুস প্রতি সন্ধ্যায় মসজিদের হারিকেন মাঝে। পুড়ে যাওয়া সলতের কালি হাত দিয়ে ডলে সরায়। হারিকেনে কেরোসিন ঢালে। মেচবাতি ঠুকে সলতে জ্বালায়।

এখন সে এই মসজিদের ইমাম। এখনো সে নিজ হাতেই এই কাজগুলো করে।

মসজিদের সামনে চৌকো গড় ছাড়িয়ে পুবে যেতে যেতে সরু খাল সরলরেখায় চলে গিয়েছে বেশ খানিকটা। তারপরেই চওড়া হোচ্চার খাল। বর্ষায় কোথাও কোথাও হোচ্চার খাল ওপাশের জমির সঙ্গে গলাগলি করে ফুলে-ফেঁপে ছোটখাটো নদীর আকার ধারণ করে।

কুদ্দুস আসরের নামাজ শেষে আজ আর ঘরের দিকে গেলো না। আবহাওয়া ভালো বিধায় গড়ের পাড় ধরে হোচ্চার খালের দিকে রওনা দিলো।

সামনের বাঁশঝাড় পেরিয়ে কুদ্দুসের দৃষ্টি হগার বাড়ির বাঁশের সাঁকোর দিকে নিবিষ্ট হতেই অস্পষ্ট অবয়বের মানুষটিকে সাঁকোতে পদক্ষেপ দিয়ে হাত থেকে খালের দিকে কি যেন একটা ছুড়ে মারতে দেখলো। কুদ্দুসের মনে হচ্ছে এ মানুষটি হাকিম না হয়ে যায়না। নিশ্চয়ই হাত থেকে শেষ হয়ে আসা বিড়ির অবশিষ্টাংশ নিক্ষেপ করেছে সে। সাদা পাতা দিয়ে হাকিম বিড়ি বানায় আর অনবরত টানে।

ধীরে ধীরে মনুষ্য অবয়বটি আরো কাছে এলো।কুদ্দুসের অনুমান ঠিক। হাকিম মন্থর পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে। প্রকৃতিতে শেষ বিকেলের যায়মান আলোর হাতছানি। রাস্তাজুড়ে ঝরা বাঁশপাতারা সবুজাভ হারিয়ে বাদামি বর্ণে সারা। লম্বাপথে বৃষ্টির জলভর্তি গর্তগুলো ছোট সরোবর যেন। বাঁশঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে মেঘলা আকাশের প্রতিচ্ছবি। বিষণ্ন পথে আরো বিষণ্নতা নেমে এসেছে।

হাকিম গর্ত পার হয়ে আগ বাড়াতেই কুদ্দুস কথা পাড়লো, “কই যাছ হাকিম?”

“বাই! আন্নেগো বাইর দিগেনা যাই।”

“কিল্লাই?”

জিজ্ঞেস করেই কুদ্দুসের কারণটা মনে পড়ে গেলো।

“আইচ্ছা, বুঝছি! যা! তাড়াতাড়ি যা!আবার মেঘ আয়া পড়বো “

বিকেল হলেই হাকিম কুদ্দুসদের বাড়িতে যায় জাল আনতে। সুবিধামতো জায়গায় জাল পাতে, আন্তা পাতে, বারা পাতে। এই কাজগুলো হাকিম করে দেয়। যা মাছ পায় পরদিন কুদ্দুসের ছেলে এমরান এসে মাছ নিয়ে যায়।

কুদ্দুস হোচ্চার খালের দিকে এগোয়। তার হাঁটা পথের পাশেই আরেকটি সরু খাল। এটিও জলে টইটম্বুর। হোচ্চার খাল এবং এই সরু খাল, আকৃতিতে তারা পৃথক হলেও গ্রামীণ জনপদে কর্মসূত্রে তাদের বেশ সখ্য। কুদ্দুসের আলাপ পেয়ে ঝপ করে লাফিয়ে পড়ে বিশাল এক ব্যাঙ। খালে পুঁতে রাখা বাঁশের খুঁটি থেকে উড়ে যায় নাম না জানা তেল চিটচিটে কালো রঙের পাখি।

নিস্তেজ বাতাস গরমকে পরাজিত করতে হিমশিম খাচ্ছে। খালের পাড়ে থোকা থোকা কচুবন সবুজের মাঝে সবুজকে আরো ঝাঁকিয়ে তুলেছে। উন্মুখ হয়ে হলুদাভ জিরাকাটারা কুদ্দুসকে কি যেন বলতে চায়! কুদ্দুসের গা বেয়ে দরদরিয়ে ঘাম ঝরছে। অবশ্য হোচ্চার খালে পৌঁছালেই শরীর আবার হিম হয়ে আসবে। সেই আশায় কুদ্দুস জোরে পা চালায়।

সেতুপুর গ্রাম থানা থেকে সাড়ে তিন মাইল উত্তরে। মানুষ পায়ে হেঁটে খালপাড়ের উঁচু রাস্তা ধরে গঞ্জে যায়। কদাচিৎ রিকশা চলে। সামর্থ্যবানদের নাইয়ররা এসব রিকশায় যাতায়াত করে। অন্যথা বর্ষায় নৌকা হলো প্রধান বাহন। জরুরি টেলিগ্রামের প্রয়োজন হলে সেই গঞ্জে যেতে হয়।

নিচু এলাকাজুড়ে এদিকের গ্রামগুলো দ্বীপের মতো। গ্রামজুড়ে অগভীর গড়-পুকুর-খানা-খন্দ। এগুলো কেটে মাটি ফেলে উঁচু করে এখানকার মানুষ বসতভিটা বাঁধে। নতুন বাড়ি বাঁধা প্রচুর ব্যয়সাপেক্ষ। তাই এ অঞ্চলে অল্প জায়গায় বেশি মানুষের বসবাস।

কুদ্দুস কাদা ডিঙিয়ে কাপড় বাঁচিয়ে সতর্কভাবে হাঁটে। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হতে ঢের দেরি। দুপাশের গ্রাম থেকে ছোট ছোট খাল এসে হোচ্চার খালের কাছে নিজেদের সমর্পণ করেছে। খালপাড়ের উঁচু কাঁচা রাস্তা একদম সেই দূরে থানার রেলরাস্তার সঙ্গে গিয়ে মিশেছে।

কুদ্দুস চারপাশে তাকায়। কেবল পানি আর পানি! এই পানির বিশালতায় ছিন্নবিচ্ছিন্ন মেঘের মধ্য হতে জ্যোৎস্নার পাংশুবর্ণ বিকির্ণের জন্য অবলোকনকারীদের আরো বহুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। উঁচু কয়েকটি রাস্তাবাদে মাঠঘাট সব জলের তলে। লোকজন নৌকা নিয়ে গন্তব্যের দিকে ছুটছে। গুমোট আকাশ ঝুঁকে আছে পৃথিবীর ধূসর মৃত্তিকার পটে।

 

কালো রঙা আঁচলের ন্যায় দৃঢ় পাটাতনে ভোরের মৌন আলোর পরশ প্রতি প্রত্যুষে চুমু দিয়ে যায়। এটি এ বাড়ির কালের সাক্ষী। এই পাটাতনে কত সুহাসিনী স্বপ্নিল উচ্ছলতায় মেতে উঠেছে। মনে মনে প্রত্যাশার জাল বুনেছে। হয়তো কখনো গড়িয়ে পড়েছে কোনো নর-নারীর অতৃপ্তির চোখের ধারা।

   

খালপাড়ের টং দোকানগুলো বাক্স পেটরার মতো। প্রায় দোকানে রেডিও বাজে। কোনো এক দোকান হতে নারীকণ্ঠের স্পষ্ট সুরেলা ধ্বনি কুদ্দুসকে সচকিত করে তোলে। কুদ্দুসের মুখে বিকেলের শেষ আলোটুকুর ন্যায় ঐ প্রতিধ্বনি খোশ মেজাজের রেশ ছড়িয়ে দেয়। পৃথিবীর বিশালতার সন্ধান এই গ্রামীণ মানুষেরা এখানেই কিছুটা হলেও অনুভব করে। গরুর দুধের ধোঁয়া ওঠা চায়ের উত্তাপের চেয়েও ইথারে ভেসে আসা খবরা-খবরের উত্তাপ তাদের চাঙা করে অনেক অনেক বেশি।

কিন্তু এই বাইরের জগৎ কুদ্দুসকে টানেনা। রাজনীতির লেশমাত্র কুদ্দুসের কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনা। কুদ্দুস মনে করে, এতো ঝামেলা তার মাথায় সংকুলান হবে না। ছোটকাল থেকেই সে আল্লাহ ভীরু। এক আল্লাহর অভিমুখে জীবন চালিয়ে যেতে পারলেই তার সুখ। জীবনের কাছে এর চেয়ে বেশিকিছু তার চাওয়ার নেই।

যাদের রাজনীতি নিয়ে বেশি উচ্ছ্বাস কুদ্দুস সযতনে তাদের এড়িয়ে চলে। এ ব্যাপারে সে মায়ের শিক্ষাটা নিজের ভেতরে ধারণ করেছে ভালোভাবেই। তার মা বলে, “জগতের বেক বিষয়ে মাতা গামায় বেকুবেরা। যার যেই কাজ হে হেইডা লইয়া মাতা গামাইলেই জীবনের উন্নতি।”

কুদ্দুস চায়ে চুমুক দেয়। তার দৃষ্টি খাল পাড়ের গ্রাম ছেড়ে দিগন্ত যেখানে প্রান্তর ছুঁয়েছে সেখানে। মাঝে মাঝে জনারণ্যেও একধরনের নিস্তব্ধতায় পায়চারী করে সে। অনন্ত আকাশ তখন তার ভেতরে কেবল শান্তির মন্ত্র উচ্চারণকারী এক শান্তির দূত।

লতিফ মিজির একমাত্র ছেলে কুদ্দুস মিজি। গায়ের রঙ ফর্সা। লম্বাচওড়া জোয়ান। সৌন্দর্যের দিক থেকে গ্রামের অন্যদের চেয়ে একেবারে আলাদা। সে কোরআনের হাফেজ। কুদ্দুসেরও এক ছেলে। নাম ইমরান মিজি। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। দেখাশোনায় ইমরান কুদ্দুসকেও ছাড়িয়ে যাবে, এমনটাই গ্রামের মানুষ বলাবলি করে।

টং দোকানের সামনে লম্বা করে পাতা বাঁশের তৈরি টুল। এগুলোতেই লোকজন বসে। গল্পগুজবে মত্ত হয়। কুদ্দুস এমনি একটা টুলে বসে ছিল। চারদিক ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। আনমনে বসা থেকে উঠলো। মাগরিবের আজান দিতে হবে।

অর্ধেক পথ আসার পরে মনে পড়লো, নূরি বারবার ইমরানের ওষুধ আনতে বলে দিয়েছে। ওষুধ শেষ। সে আবার ওষুধের দোকান লক্ষ্য করে রওনা দেয়। পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে দেখলো ওষুধ কেনার মতো পর্যাপ্ত টাকা পকেটে নেই। তবুও রওনা দেয়। বাকিতে আনবে।

কতটুকু যাওয়ার পর মতির সাথে দেখা।

“ও মতি! কাক্কারে একটু ওষুধ আইন্না দেছনা।”

মতি দাঁড়ায়। কুদ্দুস চিন্তান্বিত হয়ে বলে, “নারে থাক! টাকা নাই। বাকিতে তোরে দিতোনা।”

“কাক্কা, বাইত যাইয়া আন্নে টাকা দিয়েন। হরে আঁই ওষুধ কিন্যা কাকীর কাছে দিয়া আইয়াম।”

“তাইলেতো খুব বালা অয়।”

কুদ্দুস মতিকে নিয়ে বাড়ি অভিমুখে পা দেয়। মতি ইমরানের চেয়ে বছরখানিকের বড়। সেতুপুর গ্রামের শেষ মাথার সীমানা ছাড়িয়ে মতিদের ঘর।

কুদ্দুস মতিকে নিয়ে বাড়িতে ঢোকে। সন্ধ্যা ঘনায়মান।

কালের স্রোতধারায় এক মিজিবাডি এখন তিনবাড়ি। মসজিদকেন্দ্রিক বিরাট বাড়িটি তিনভাগে পৃথক হলেও ধনী-গরিব মিলিয়ে বাড়িত্রয়ে মেলা পরিবারের বসবাস।

পরিবারগুলো অল্পবেশ জমির মালিক। অনেক পরিবার চেষ্টা করছে তাদের সন্তানদের লেখাপড়া করানোর। এর মধ্যে নতুন মিজিবাড়ি যা নওয়াবাড়ি নামে পরিচিত তারা লেখাপড়ায় অনেকটা এগিয়ে। তাদের কেউ কেউ কষ্টে সৃষ্টে সন্তানকে ঢাকায় পাঠিয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছে। বাকিদের কোনো কোনো পরিবারের দু-একজনকে মধ্যপ্রাচ্য পাঠানোর চেষ্টা চলছে। তবে এখনও এই বাড়ির কেউ সন্তানকে প্রবাসে পাঠানোর ব্যাপারে সফল হতে পারেনি।

মসজিদের পশ্চিমে পতিত জায়গা। পাশেই উত্তর-দক্ষিণে লম্বালম্বি মিজি বাড়ির মধ্যাংশ। এখানে এককালে কুদ্দুসদের ঘর ছিল। তারা এখন মূল বাড়ির পাশে আড়াআড়ি পথ ডিঙিয়ে নিজেরা নতুন বসতবাড়ি করেছে। তাদের ভদ্রায় সুপারির সারির পাশে পশ্চিম ভিটায় চৌচালা টিনের ঘর। ঘরের সম্মুখ আর দক্ষিণের বেড়া চৌকাঠ। উত্তর ও পেছনের বেড়ায় ঢেউ খেলানো টিন লম্বালম্বি পাতা।

উত্তরে বানদুয়ারের ওধারে রান্নাঘর। রান্নাঘর মানে দোচালা কুঁড়েঘর। বৃষ্টিতে কুঁড়ে ঘরে রান্না হয়। রান্নাঘরের কোলঘেঁষে খড়ের একচালা ছাউনি যেখানে ঝকঝকে তকতকে মাটির চুলা। পাশে পুকুর। পুকুরের ঘাটলায় কাঠের গুঁড়ি বাঁশের খুঁটি দিয়ে ঠেস দেয়া।

ঘাটলার শেষ প্রান্তে বড় চ্যাপ্টা মসৃণ কালো একটা কাঠের পাটাতন। এটিতে কাপড় কাচা হয়, হাঁড়ি-পাতিল মাজা হয়। বর্ষায় জলের বহর উঠানামার সাথে এই পাটাতনের অবস্থানেরও নড়চড় হয়।

কালো রঙা আঁচলের ন্যায় দৃঢ় পাটাতনে ভোরের মৌন আলোর পরশ প্রতি প্রত্যুষে চুমু দিয়ছে যায়। এটি এবাড়ির কালের সাক্ষী। এই পাটাতনে কত সুহাসিনী স্বপ্নিল উচ্ছলতায় মেতে উঠেছে। মনে মনে প্রত্যাশার জাল বুনেছে। হয়তো কখনো গড়িয়ে পড়েছে কোনো নর-নারীর অতৃপ্তির চোখের ধারা।

আগে পুরান বাড়ির ঘাটলায় এটা ছিল। কুদ্দুসের বাবা লতিফ মিজি তার ছোট বয়সে এ পাটাতনে বসে পানিতে পা ডুবিয়ে পোড়া মিষ্টি আলু খেতো। পোড়া মিষ্টি আলু তার খুব পছন্দ ছিল। বিয়ের পর পর লতিফ মিজি স্ত্রী মরিয়মের সাথে এই গল্প বহুবার করেছে।

উঠানের পূর্বভিটায় দোচালা টিনের আরেকটি মাঝারি ঘর। পাতার বেড়ার ঘরটিতে পুরনো চকির উপরে মোস্তাগের পাটি। তারও উপরে তেল চিটচিটে বালিশ। মেঝের একপাশে কৃষির সরঞ্জাম রাখা আছে।

প্রকৃতির নিয়মে ঘরের চারধারের সবুজের উপরে মেঘ-রৌদ্রের বিচ্ছুরণ শিহরিয়া ওঠে। রাতের নিস্তব্ধতায় চন্দ্রের রুপালি ঝলক আছড়ে পড়ে। কুদ্দুসের জমিতে হাকিম বর্গা চাষ করে। সকালবেলা মসজিদের চালাঘেরা দাওয়ায় কুদ্দুস গ্রামের কচি ছেলে-মেয়েদের আরবি পড়ায়। মাসে কেউ চাল দেয়, কেউ টাকা। এভাবে হাকিমের দেয় অর্ধেক ফসল আর ছেলে-মেয়েদের আরবি পড়িয়ে প্রাপ্ত যৎসামান্যে কুদ্দুসের সংসারের চাকা কোনোমতে ঘুরছে। কুদ্দুসের আর্ত জীবনের সঙ্গে এসবই নিত্য ছন্দে নিদারুণ ঘনিষ্ঠতায় এক হয়ে মিশে আছে। (চলবে)

এইচআর/ফারুক/জিকেএস