কৃষি ও প্রকৃতি

মাচায় ঝুলছে আতিকুল্লাহর সবুজ স্বপ্ন

গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার জাঙ্গালীয়া ইউনিয়নের বরাইয়া (ভূঁইয়া বাড়ী) গ্রামের মো. আতিকুল্লাহর বাগানে ফলেছে মিষ্টি আঙুর। বিশাল ক্ষেতে এ মিষ্টি আঙুর চাষ করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন ষাটোর্ধ্ব ওই কৃষক। তার প্রায় এক বিঘা জমির মাচায় থোকায় থোকায় ঝুলছে আঙুর। তা দেখতে যেমন মানুষ ভিড় করছেন; তেমনই আঙুর চাষের পরামর্শ ও চারা সংগ্রহও করছেন বিভিন্ন এলাকার কৃষকেরা। এ অঞ্চলের মাটিতে আঙুর চাষ করতে দেখে একসময় যারা আতিকুল্লাহকে নিয়ে উপহাস করেছিলেন; এখন তারাই হতবাক হয়ে তার গুণগান গাইছেন।

Advertisement

আঙুর চাষ নিয়ে ইউটিউবে প্রচুর ভিডিও দেখেন কৃষক আতিকুল্লাহ। এরপর উদ্বুদ্ধ হয়ে ২০২২ সালে চুয়াডাঙ্গা থেকে কুরিয়ারের মাধ্যমে প্রতি পিস ৫৫০ টাকা দরে ভারতীয় চয়ন জাতের ১০টি চারা কিনে আনেন। শুরু করেন আঙুর চাষ, তবে শুরুটা খুব একটা ভালো হয়নি। কিন্তু সহজে দমে যাওয়ার পাত্র নন কৃষক আতিকুল্লাহ বরং তিনি এ বছর দুটি স্থানে একই জাতের ৫০টি চারা দিয়ে বৃহৎভাবে শুরু করেন। চারা রোপণের ৭ মাসের মধ্যে গাছে ফল আসা শুরু করে।

কৃষক আতিকুল্লাহ আঙুর চাষের পাশাপাশি চারা উৎপাদনও করছেন। তার আঙুরের বাম্পার ফলন দেখে আশপাশের কৃষকরা উদ্বুদ্ধ হয়ে এ চাষে ঝুঁকে পড়ছেন। স্থানীয় বিভিন্ন নার্সারি ও ব্যক্তি তার কাছ থেকে চারা সংগ্রহ করতে আসছেন। তিনি প্রতিটি আঙুর কলম চারা মাত্র ২০০ টাকা করে বিক্রি করছেন।

আরও পড়ুন: পাহাড়ে মিয়াজাকি আমের কেজি ৯০০ টাকা 

Advertisement

কৃষক আতিকুল্লাহ জানান, প্রথমবার ৭ মাসের মাথায় গাছগুলোয় আঙুর ধরেছিল এবং ২০-২৫ মণ ফল পান। তবে প্রথম ফল পাওয়া একটিও তিনি বিক্রি না করে এলাকার মানুষকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বারের মতো এবারও গাছে প্রচুর পরিমাণ ফল হয়েছে। এবারও তিনি ফল বিক্রি করবেন না। যারা বাগানে আসেন, তাদের তিনি বিনা মূল্যে দেবেন। এ আঙুর গাছে ৩০ বছর পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়।

তিনি আরও জানান, আঙুর গাছ ৮ ফুট দূরত্বে লাগানো হয়েছে। এ গাছ লাগানোর আগে জমি প্রস্তুত করে প্রতিটি গর্তে পাঁচ কেজি বিভিন্ন উপাদান দেওয়া হয়। সেগুলো হচ্ছে ইটের গুঁড়া, মোটা বালু ও জৈব সার। এগুলো ৩ ফুট গর্ত করে মাটির সঙ্গে মিশ্রণ করে দেওয়া হয়। প্রতিটি গাছের গোড়া মাটি দিয়ে উঁচু করা, যাতে পানি না জমে। আঙুর গাছ যাতে দ্রুত লম্বা হতে পারে তার জন্য উঁচু করে সিমেন্টের খুঁটি দিয়ে মাচা তৈরি করেছেন। ফলে ঝড়-বৃষ্টি এলে গাছ ভেঙে পড়ার আশঙ্কা কম থাকে।

কৃষক আতিকুল্লাহ নিজের আঙুর বাগানকে উপজেলার একমাত্র বাগান দাবি করে বলেন, ‘আশা করি এ বছর ভালো ফল পাবো। সাধারণত ৮০-৮৫ দিনে ফল খাওয়ার উপযোগী হয়। এখন যে ফল দেখছেন, তা আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে খাওয়া যাবে। সবচেয়ে বড় কষ্টের বিষয় হলো, এ চাষ যখন শুরু করি; তখন আশপাশের মানুষ বিভিন্নভাবে উপহাস করতে থাকে। অনেকে পাগলও বলেন।’

আরও পড়ুন: কারিশমা জাতের তরমুজ চাষে সবুজের সাফল্য 

Advertisement

তিনি বলেন, ‘দোকানে তো বসতেই পারতাম না। এখন আমার আনন্দ ধরে না। প্রতিদিন আঙুর দেখার জন্য অনেকের সাক্ষাৎ মিলছে। আশা করি এ বছর অনেক লাভবান হতে পারবো। এর আগে কোনো মানুষের কাছ থেকে কোনোরূপ সহযোগিতা পাইনি। এখন স্থানীয় কৃষি অফিসসহ সব সময় মানুষ পাশে থাকছে। এ পর্যন্ত প্রায় ২ থেকে ৩ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। তবে এখন আর তেমন বেশি খরচ নেই।’

কৃষক আতিকুল্লাহর স্ত্রী নূর আক্তার জানান, আঙুর বাগান নিয়ে তার স্বামী প্রচুর খাটা-খাটুনি করেন। প্রচণ্ড খরার রাতেও বাগানে ২ ঘণ্টা পানি দেওয়ার কাজ করেন। তবে স্বামীর সাথে তিনিও মাঝে মধ্যে সহযোগিতা করেন। তারা এ আঙুর বাগান করে এবার লাভবান বলেও জানান তিনি।

বরাইয়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম আব্দুস সালাম বলেন, ‘আতিকুল্লাহ অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে বাগানে এ আঙুর উৎপাদন করেছেন। পুরো উপজেলায় একমাত্র আতিকুল্লাহই আঙুরের চাষ করেন।’

আরও পড়ুন: জয়পুরহাটে বাড়ছে বাহারি রঙের তরমুজ চাষ, লাভ চারগুণ

বরাইয়া গ্রামের যুবক পারভেজ বেপারী বলেন, ‘আতিকুল্লাহ নানার বাগান দেখে আমরা এলাকার যুবকরা অনুপ্রাণিত। ষাটোর্ধ্ব আতিকুল্লাহ নানা পারলে ইনশাআল্লাহ আমরাও পারবো। বিদেশ থেকে না এনে নিজ দেশের চাষাবাদ করা আঙুরের বাজার সৃষ্টির অনুরোধ করছি।’

একই গ্রামের আরেক যুবক ইফতেখার আহমেদ ইমন বলেন, ‘প্রতিবেশী আতিকুল্লাহ চাচার আঙুর বাগান দেখে আমরা অনুপ্রাণিত। এখান থেকে আঙুর চারা নিয়ে নিজেও চাষ করবো।’

কালীগঞ্জ উপজেলার উপ-সহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ কর্মকর্তা মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘গত বছর তিনি ১০টি চারা দিয়ে আঙুর চাষ শুরু করেন। খুব বেশি ফলন না হলেও তিনি সেটি রেখে দিয়েছেন। এ বছর তিনি আমাদের কৃষি অফিসের সহযোগিতায় সার ব্যবস্থাপনা, পানি ব্যবস্থাপনা এবং বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আরও বৃহদাকারে শুরু করেছেন। তিনি এখানে জৈবিক বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কোনো প্রকার কীটনাশক ছাড়াই এবার আঙুরের চাষ করছেন।’

আব্দুর রহমান আরমান/এসইউ/জিকেএস