অর্থনীতি

নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি: প্রায় অর্ধেকে নেমেছে ফ্ল্যাট বিক্রি

# ২০২২ সালের ৫ হাজার ফ্ল্যাট এখনো অবিক্রীত

Advertisement

সম্প্রতি আবাসন খাতসংশ্লিষ্ট নির্মাণসামগ্রীর দাম আকাশছোঁয়া। নির্মাণের অপরিহার্য উপকরণ রডের দাম ইতিহাসে সব রেকর্ড ভেঙেছে। খুচরা বাজারে প্রতি টন রড লাখ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। উচ্চদামে বিক্রি হচ্ছে সিমেন্টসহ অন্য নির্মাণসামগ্রী। রেকর্ড গড়েছে ইট, বালু, ভরাট বালু, পাথরও। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে নির্মাণে জড়িত শ্রমিকের খরচও। মূল্যবৃদ্ধির এ প্রভাব পড়েছে আবাসন প্রকল্পগুলোতে।

নির্মাণসামগ্রীর দামের সঙ্গে কনস্ট্রাকশনের খরচও বেড়েছে। প্রতি স্কয়ার ফুটে দেড় থেকে তিন হাজার টাকা বাড়তি খরচ বহন করতে হচ্ছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের। এতে বাড়তি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন বিক্রেতা। এ কারণে ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনায় আগ্রহ কমেছে ক্রেতার। বিক্রি না হওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। বড় অর্থ সংকটে রয়েছেন ছোট বিনিয়োগকারীরা।

আরও পড়ুন>> ‘নানা করারোপে ভয়ংকর সংকটে পড়বে আবাসন শিল্প’

Advertisement

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার মধ্যবিত্তদের আবাসন সমস্যা দূর করার যে স্বপ্ন দেখিয়েছে তা ভণ্ডুল হতে পারে। বিভিন্ন উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন মধ্যবিত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন। নগরে সবার আবাসন গড়তে এখনই নির্মাণ উপকরণের দাম কমানোর দাবি তাদের।

আবাসন খাতের চলমান প্রকল্পে বিনিয়োগ করেন হাবিব আহমেদ। এজন্য পুরো টাকাই পরিশোধ করেন কোম্পানিকে, এ কারণে বাজারমূল্যের চেয়ে কিছুটা কম দামে ফ্ল্যাট কিনতে পারেন। প্রকল্প শেষ হলে তার ফ্ল্যাটগুলো সাধারণ ক্রেতার কাছে বিক্রি করেন। ২০২১ সালের শেষ ও ২০২২ সালের শুরুর দিকে রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় এক ডেভেলপার কোম্পানির প্রকল্পে দুই ফ্লোরে চারটি ফ্ল্যাটের বুকিং দেন হাবিব আহমেদ। পরে পুরো টাকা পরিশোধ করেন তিনি। এর মধ্যে দফায় দফায় নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়েছে। সঙ্গে নিত্যপণ্যের দামও। কোম্পানির কাছ থেকে তার চারটি ফ্ল্যাট বুঝে পেলেও তিনি আর বিক্রি করতে পারেননি।

আরও পড়ুন>> সিমেন্টে বহুজাতিকের রমরমা ব্যবসা, ডলারে ‘ধরা’ দেশীয় প্রতিষ্ঠান

হাবিব আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, নির্মাণ উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় খরচ বেড়েছে, এজন্য ফ্ল্যাটের দামও বেড়েছে। এখন বেশি দাম হওয়ায় ক্রেতা পাচ্ছি না। তাছাড়া নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় ক্রেতার অর্থেও টান পড়েছে। এখন টাকা আটকে আছে ফ্ল্যাটে, নিজেও চলতে পারছি না।

Advertisement

আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) তথ্য বলছে, প্রতি বছর দেশে প্রায় ১৫ হাজার ফ্ল্যাট বিক্রি হয়। তবে, সদ্যবিদায়ী অর্থবছরের প্রায় ৫ হাজার ফ্ল্যাট অবিক্রীত রয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে যেখানে ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হয়েছিল ১৫ হাজার। বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের পুরো সময়ে বিক্রি হয়েছে প্রায় ১০ হাজার। বিক্রি খরা কাটে চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের শুরুর মাসেও। আগামীতে আরও সংকট ঘনীভূত হতে পারে এ খাতে। যার প্রভাব পড়ে ফ্ল্যাটের ওপর। এতে মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বপ্নভঙ্গ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাবে আবাসন খাত।

আরও পড়ুন>> শেষ হলো অবকাঠামো নির্মাণশিল্পের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী

এছাড়া ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত গড়ে বিক্রি হয়েছিল ১৫ হাজার করে ফ্ল্যাট। ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত বিক্রি হয় গড়ে ১২ হাজার ৫০০ ফ্ল্যাট। ২০১৭ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ১৪ হাজার এবং ২০২১ সালে বিক্রি হয় ১৫ হাজার ফ্ল্যাট। নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় ফ্ল্যাটের দামও কিছুটা বেড়েছে। এতেই বিক্রিতে ধস নেমেছে।

রিহ্যাব সূত্র বলছে, দুই বছরের ব্যবধানে রডের দাম (প্রতি টন) বেড়েছে ৩৫ হাজার টাকা। ২০২০ সালে এক টন রোড ছিল ৬৪ হাজার টাকা, ২০২১ সালে ৭০ হাজার, ২০২২ সালে হয় ৯৪ হাজার টাকা। ২০২৩ সালে চলে আসে এক লাখ টাকায়। দাম বেড়েছে সিমেন্ট, বালু, পাথর, ইট, থাই অ্যালুমিনিয়াম, গ্রিল ও রেলিং, জেনারেল ইলেকট্রিফিকেশন, স্যানিটেশন, টাইলস ও লেবার খরচ। দুই বছর আগে এক ব্যাগ সিমেন্ট ৩৭৫ থেকে ৪০৫ টাকায় পাওয়া গেলেও এখন তা ৫৬০ টাকা ছাড়িয়েছে। লাল বালু প্রতি সেফটি ছিল ৮ টাকা এখন তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ থেকে ৩৪ টাকা। সাদা বালু প্রতি সেফটি ২৫ টাকা ছিল, এখন তা ৬০ টাকা ছাড়িয়েছে।

আরও পড়ুন>> ঢাকায় ভবন নির্মাণ তদারকিতে থার্ড পার্টি নিয়োগ করবে রাজউক

দাম বেড়েছে ভরাট বালুর। ২০২১ সালে এক গাড়ি ভরাট বালু বিক্রি হয়েছিল ১ হাজার ২০০ টাকা, ২০২৩ সালে এসে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকায়। দুই বছরের ব্যবধানে পাথরের দাম বেড়েছে ৮০ থেকে ৮৭ টাকা। দুই বছর আগে প্রতি স্কয়ার ফুট পাথরের দাম ছিল ১৬০ টাকা, এখন তা বেড়ে হয়েছে ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা। ইটের দাম বেড়ে সর্বোচ্চ ১৪ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। দাম বেড়ে রেকর্ড পর্যায়ে এসেছে থাই অ্যালুমিনিয়াম, গ্রিল ও রেলিংয়ের দাম। চড়া দাম এখন শ্রমিকের খরচও।অন্যদিকে, নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় যেমন ফ্ল্যাটের দাম বেড়েছে। ফ্ল্যাট মালিকও তাদের নিজ নিজ ফ্ল্যাটের ভাড়াও বাড়িয়ে দিয়েছেন। নানাবিধ সংকটে রয়েছেন সাধারণ মানুষ। নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দাম বাড়ায় জনজীবনে নাভিশ্বাস। অনেকে বড় ফ্ল্যাট ছেড়ে ছোট ফ্ল্যাটে উঠেছেন। নগরের অনেকেই খরচ মেটাতে পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়েছেন। ফ্ল্যাট ছেড়ে বেছে নিয়েছেন সাবলেট।

আরও পড়ুন>> ইতিহাস গড়ে লাখ টাকা ছুঁলো রডের দাম

এসব নিয়ে কথা হয় রিহ্যাব সহ-সভাপতি (প্রথম) কামাল মাহমুদের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, নতুন ড্যাপের ‘ফার’ হ্রাসের ফলে বেশিরভাগ ভবন হবে ছোট আকারে। জমির মালিকের সঙ্গে ব্যবসায়ীরা কোনো চুক্তিতে যেতে পারছেন না। আবাসন ছোট হয়ে এলে দাম বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি।

তিনি বলেন, এসব কারণে আবাসনের স্বপ্ন মধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। আগামীতে সবার জন্য মানসম্মত আবাসন পাওয়া কঠিন হবে। এ সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন নির্মাণ উপকরণের দাম কমানো। সরকারকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এখন উল্লেখযোগ্যহারে কমেছে ফ্ল্যাট বিক্রি।

আরও পড়ুন>> এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ রড-সিমেন্টের দাম

ইএআর/এমএএইচ/এএসএম