এলাকার নামগুলো বেশ চমকপ্রদ। জনপ্রিয় নামসর্বস্ব এসব এলাকার মানুষ তিস্তাপাড়ের বাসিন্দা। তিস্তানদী কেড়ে নিয়েছে তাদের সবকিছু। তাদের কাছে তিস্তা দহন-পীড়নের নদী, সারা বছরের আতঙ্ক। গ্রীষ্মে বুকফাটা গরমে পানির অভাবে ক্ষেতের মাটি ফেটে চৌচির হয় আবার বর্ষাকাল শুরু হয়ে হঠাৎ ঢল নেমে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি ডুবে, জমির ফসল তলিয়ে পচে গিয়ে সর্বহারা বানিয়ে দেয় এসব বসতির জনগণকে।
Advertisement
ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার তিস্তা নদীতে নির্মিত গাজলডোবা ব্যারেজের জলকপাট হঠাৎ খুলে দেওয়ায় সেই পানি সামলাতে বাংলাদেশের তিস্তায় ডালিয়া ব্যারেজের সবকটি গেট (৪৪টি) খুলে দিতে হয়েছে। ফলে লালমনিরহাট, নীলফামারী ও রংপুর জেলার বহু এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। জুলাই ১৪, ২০২৩ তারিখে সেখানে আবারো গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে এসেছে বন্যা।
বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র ৬০ কি.মি. উজানে অভিন্ন তিস্তা নদীতে ভারতের গাজলডোবা ব্যারেজ যখন অতিরিক্ত বৃষ্টি বা বন্যার পানি আটকাতে পারে না তখন সেটা ছেড়ে দিয়েছে। সেই স্রোতের তোড়ে বন্যার থাবায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়ন ও হাতীবান্ধা উপজেলা। তিস্তায় কারণে বিপর্যস্ত এসব এলাকার নাম এখন সুপরিচিত। তবে গাজলডোবাকে ভুল উচ্চারণে চালিয়ে দিচ্ছে গণমাধ্যমগুলো।
মনে পড়ে সেই ১৯৯৮ সালে পরিবেশ বিজ্ঞানের একটি গবেষণা কাজে আমার জাপানিজ সুপারভাইজার আইআইটি খড়গপুরের একজন প্রফেসরকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। কলকাতায় বসে তার সাথে এ বিষয়ে কথা বলছিলাম তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। এরপর ভারতের উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের একজন প্রফেসর ও একটি সার্ভেটিম আমার সাথে যুক্ত হয়।
Advertisement
তাদের সাথে আমি কথার ফাঁকে বার বার গজলডোবা বলে ব্যারেজের নাম উচ্চারণ করছিলাম। তখন বাংলাভাষী প্রফেসর সি. পাঠক বললেন, মি. ফখরুল, ব্যারেজের নামটা গজলডোবা নয়, হবে ‘গা-জলডোবা’। কারণ ওখানে তিস্তানদী অনেকটা বিস্তৃত এবং পানি বেশি। সেখানে নদীতে নামলে গা বা গোটা শরীর পর্যন্ত ডুবে যায়। তাই এখানকার মানুষের আঞ্চলিক উচ্চারণ গাজলডোবা।
আমার গবেষণা রিপোর্টে নামটি গাজলডোবা লিখেছিলাম। তখনকার পত্রিকাগুলোতে এই নামেই ব্যারেজটার পরিচিতি তুলে ধরেছিলাম। কিন্তু আমাদের গণমাধ্যমে সেটার ভুল উচ্চারণ ছড়িয়ে পড়েছে।
সারা পৃথিবীতে মানুষ ড্যাম, ব্যারেজ বানিয়ে উজানের পানি আটকিয়ে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করে চলেছে। কিন্তু যখনই কোনো ব্যারেজ তার ধারণ ক্ষমতার মাত্রাতিরিক্ত পানির লোড সামলাতে অপারগ হয় তখনই জলকপাট খুলে দিতে বাধ্য হয়। আর সেখান থেকেই নিম্নাঞ্চলের মানুষের জন্য বিপদের ঘনঘটা শুরু হয়ে যায়। আর এই বিপদের ঘটনা বছরের যে কোনো সময় যেকোনো মৌসুমে ঘটতে পারে। তিস্তার উজানে ভারতের তৈরি গাজলডোবা ব্যারেজ নির্মিত হয়েছিল বাংলাদেশে ডালিয়া ব্যারেজ নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পাঁচ বছর পর।
গাজলডোবা ব্যারেজকে তারা তিস্তা ব্যারেজ নামে অফিসিয়ালি ব্যবহার করে থাকে। এর মাধ্যমে মহানন্দা নদী দিয়ে কোলকাতার হুগলী নদীতে পানিপ্রবাহ বাড়ানোর হন্য একতরফা পানি প্রত্যাহার শুরু হলে বাংলাদেশের ডালিয়া তথা তিস্তা ব্যাজে এলাকার সেচ কাজে বিপর্যয় নেমে আসে।
Advertisement
এর সাথে শুরু হয়ে যায় খরায় পানি সংকট ও বষার্কালে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দিয়ে হঠাৎ বন্যা সৃষ্টির প্রয়াস। বাংলাদেশ তিস্তাকে নিয়ে এই জীবন—মরণ সংকটের মুখোমুখি হয়ে হা—হুতাশ করলেও ভারতের একাই খাব নীতিতে চরম একগুঁয়েমির ফলে গত আড়াই যুগেও কোন সমাধান সম্ভব হয়ে উঠেনি।
অধিকিন্তু আন্তর্জাতিক নদী তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের অন্তঃ ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় রাজনীতি তুঙ্গে উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিশেষ করে বর্তমান ক্ষমতাসীন মমতা সরকার কোনোভাবেই বাংলাদেশকে তিস্তার পানি দিতে চান না। এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারে বর্তমান মোদী প্রশাসনই নয়, এর আগের সরকারগুলোকেও তিনি তিস্তার পানি নিয়ে প্রসঙ্গ তুললেই নানাভাবে টালবাহানা করেছেন। তবে বিশ্লেষকরা ইতোমধ্যে এটাকে বাংলাদেশকে তিস্তার পানির ভাগ না দেওয়ার একটা আন্তঃরাষ্ট্রীয় চাতুরি বলে অভিহিত করেছেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সেটা বুঝেও না বোঝার ভান করে রাজ্য ও কেন্দ্রের মধ্যকার পারস্পরিক দোষারোপের মধ্যে ঠেলে দিয়ে কালক্ষেপণ করে চলেছেন।
বাংলাদেশে পনের বছর ধরে আওয়ামী শাসনামলে সবদিক থেকে তিস্তানদীর পানি বণ্টনের চুক্তি সই করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। বন্ধুপ্রতিম ভারতের সাথে নানা অভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হলেও তিস্তার ব্যাপারে সব প্রচেষ্টাই বিফলে পর্যবসিত হয়েছে।
বলা হয় প্রমত্তা পদ্মা নদীতে সেতু নির্মাণ করে বাংলাদেশ বড় গেম জিতেছে। কিন্তু সীমান্তের ছোট খরস্রোতা নদী তিস্তার ব্যাপারে বার বার হেরে গেছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে বর্তমান ক্ষমতাসীন মমতা সরকার আগের টার্মেও তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে চরম অসহযোগিতা করে আসছেন।
গত কয়েক বছরে মমতা ব্যানার্জীর তিস্তা নিয়ে রাজনীতি করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন তাতে এ বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের সাথে তিক্ততা আরও বেড়েছে। এসব বাগ্ড়া আঞ্চলিক ভূরাজনীতিকে আরও বেশি উসকে দিয়ে এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
যার প্রভাবে চীনের সাথে বাংলাদেশের তিস্তানদী পুনজীর্বনের মহাপরিকল্পনার বিষয়টি আটকে রয়েছে। বাংলাদেশ অনেকটা নিরুপায় হয়ে ‘তিস্তা রিভার রেস্টোরেশন প্রজেক্ট’ গ্রহণ করেছে চীনের সহযোগিতার আশ্বাসে। এটা বাংলাদেশের নিজস্ব উপলব্ধি ও তিস্তা বেসিন এলাকার দুর্গত মানুষের বেঁচে থাকার ভবিষ্যৎ অবলম্বন হতে পারে। কিন্তু ভারত আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক সমস্যার কথা বলে এই চীনা প্রকল্পে আপত্তির কথা শোনাচ্ছে।
এ কাজে ভারতের বাগ্ড়া দেওয়াটা বাংলাদেশের জন্য মোটেই সুখকর হতে পারে না। এ নিয়ে রুগণ তিস্তার আবার মরণ দশা হলে শুধু গাজলডোবার থাবায় বিপর্যস্ত মহিষখোচা ও হাতীবান্ধার মানুষই নয়, গোটা বাংলাদেশের মানুষ হয়তো তা কোনোভাবেই ক্ষমা করতে পারবে না।
অপরদিকে চীনের সাথে ব্রাজিল, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে ব্রিকস গঠন করা হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশসহ আরো নতুন কুড়িটি দেশকে সদস্যপদে গ্রহণের চেষ্টা চলছে।
ছোট দেশগুলোর স্বার্থকে উপেক্ষা করে বড় দেশগুলো সবসময় তাদের কাছে টেনে নেয়। বড়রা ছোটদের মাথা তুলে দাঁড়াতে দিতে চায় না—কিন্তু তাদের ব্যবহার করার সময় সিদ্ধহস্ত। যেমন- রাশিয়া ইউক্রেনকে, চীন তাইওয়ানকে, ভারত বাংলাদেশকে নানা প্রয়োজনে ব্যবহার ও বঞ্চিত করছে। এরপরও দাদাগিরি করতে গিয়ে নিজেদের স্বার্থ একটু কম হলে ক্ষুদ্র দেশগুলোর কাজে বাগ্ড়া দিতে মোটেও দ্বিধা করছে না।
এবছর মধ্য জুলাইয়ে জলপাইগুড়িতে গাজলডোবায় জলকপাট খুলে দেওয়ার ফলে লালমনিরহাট জেলার মহিষখোঁচা ও হাতিবান্ধার মানুষেরা যে চরম বিপদের সন্মুখীন হয়েছে তার ছিটেফোটা যদি ভারতীয় কতৃর্পক্ষ উপলব্ধি করতে পারতো তাহলে হয়তো বন্ধুত্বের ঘনিষ্ঠতা প্রমাণিত হতো। এসব এলাকার বারবার বন্যাক্রান্ত অসহায় মানুষের আর্তচিৎকার কি তাদের কানে পৌঁছাবে?
ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পদ, ফসল ডুবে যাওয়া এসব মানুষের হাহাকার শুনেও যদি বন্ধুরা কানে তুলা দিয়ে ঘুমায় এবং বিকল্প উপায়ে বাঁচার চেষ্টা করার মহাপরিকল্পনাকে নষ্ট করতে বাধা দেয় তাহলে তার বিরুদ্ধে করণীয় কি তা হয়তো বর্তমান বাংলাদেশ সরকার গভীরভাবে আঁচ করতে পেরেছেন।
গণমানুষের সমস্যাকে অগ্রাহ্য করে সরকার যদি অকৃতজ্ঞ বন্ধুর সেবাদাস হয়ে ভূমিকা পালন করতে থাকে তাহলে বাংলাদেশের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ অচিরেই রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। দুর্গত এলাকায় জীবনসংগ্রাম অটুট রাখার জন্য আমাদের মা, মাটি, মানুষকে নিয়ে আত্মপ্রচেষ্টা চালিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে যাওয়াটাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। fakrul@ru.ac.bd
এইচআর/এএসএম