দেশজুড়ে

বরিশালে ঝুঁকিপূর্ণ দেখিয়ে অর্ধশতবর্ষী ১২৯ গাছ কাটার পাঁয়তারা

ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এবং ঝুঁকিপূর্ণ দেখিয়ে কেটে ফেলা হচ্ছে বরিশাল নগরীর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কলোনির বিভিন্ন প্রজাতির ১২৯টি গাছ। নগরীর বান্দরোডের ওই গাছ কাটার জন্য এরইমধ্যে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এখন চলছে গাছ কাটার প্রস্তুতি।

Advertisement

এদিকে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের এমন সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদী সংগঠন ও সচেতন মহল। তবে পাউবোর কর্মকর্তারা বলছেন, একটি কেটে দুটি গাছ লাগানো হবে। তাই ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিগ্ৰস্ত গাছগুলো কাটার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

আরও পড়ুন: মরা গাছের টেন্ডার পেয়ে কাটা হচ্ছে তাজা গাছ

বুধবার (২৬ জুলাই) সকালে নগরীর বান্দরোডের পানি উন্নয়ন বোর্ড কলোনিতে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, প্রায় অর্ধশত বছর বয়সী ১২৯টি গাছ কাটার জন্য এরইমধ্যে লাল ও নীল রং দিয়ে শনাক্তকরণ নম্বর দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রেইনট্রি, মেহগনি, শিশুসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে। কাটার তালিকায় শুধু এসব গাছ নয়, পানি উন্নয়ন বোর্ড কলোনির প্রবেশদ্বারেই রয়েছে ফলজ গাছ কাঁঠাল ও জাম। সেগুলোও কাটার জন্য চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে।

Advertisement

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল নগরীর বান্দরোড এলাকায় বিশাল আয়তনজুড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কার্যালয় এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য দুটি আবাসিক এলাকা গড়ে ওঠে। একটি ‘বিআইপি’ কলোনিও অপরটি ‘ওয়াপদা’ কলোনি নামে পরিচিত। স্বাধীনতার আগে এসব স্থাপনা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষরোপণ করা হয়।

এই দুই কলোনির ১২৯টি গাছ নিলামে দিয়ে কেটে ফেলার এমন সিদ্ধান্তে খোদ কলোনির বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু পাউবোর কর্মচারী হওয়ায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের এমন পরিবেশঘাতী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে পারছেন না তারা।

আরও পড়ুন: স্কুলের কদম গাছ কাটা পড়বে শুনে শিক্ষার্থীদের হাউমাউ কান্না

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বিআইপি কলোনির কয়েকজন বাসিন্দা জাগো নিউজকে বলেন, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এমন কয়েকটি গাছ দেখিয়ে ১২৯টি গাছ বিক্রি করছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে গাছগুলো বিক্রির বিষয়টি পুনর্বিবেচনার দাবি তাদের।

Advertisement

তারা আরও বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এবং ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় বিভিন্ন প্রজাতির ১২৯টি গাছ কাটা বা অপসারণে নিলাম দরপত্র আহ্বান করা হলেও বাস্তব চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। বাস্তবে দুই-তিনটি গাছ বন্যায় ভেঙে গেছে এবং হেলে পড়েছে। তবে নিলামে বিক্রির জন্য রং দিয়ে নম্বর লিখে চিহ্নিত করা গাছগুলো সম্পূর্ণ অক্ষত এবং সতেজ।

নগরীর পরিবেশবাদী সংগঠন ও সচেতন মহল পাউবোর এমন সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তারা বলছেন, বরিশাল নগরীতে এরইমধ্যে সড়ক প্রশস্তকরণের নামে শতবর্ষী গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। এর ফলে অনেকটাই বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ছে বরিশাল নগরী। তার মধ্যে আবার নতুন করে পুরোনো এতগুলো গাছ কাটার উদ্যোগ আত্মঘাতী। এতে শহরের পরিবেশ-প্রতিবেশে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়ক লিংকন বায়েন বলেন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য গাছের ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। তাই চাইলেও গাছ কাটা যাবে না। সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া গাছ কাটা হলে সেটা অবশ্যই আইন পরিপন্থী। উন্নয়নের জন্য হলেও পরিবেশের বিষয়টি মাথায় রেখে প্রকল্প হাতে নিতে হবে। বিষয়টি দুঃখজনক। আমরা সামাজিকভাবে এ বিষয়ে আন্দোলন গড়ে তুলব। পাশাপাশি কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে অবশ্যই আমরা আইনি পদক্ষেপ নেবো।

পাউবোর একটি সূত্র জানায়, এই দুই কলোনির ১২৯টি গাছ নিলামের জন্য গত ২২ জুন দরপত্র আহ্বান করা হয়। জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে দরপত্র সম্পন্ন হয়। এতে ৪০টির ওপর দরপত্র বিক্রি করা হলেও নিলামে অংশগ্রহণ করেছে মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠান। সর্বোচ্চ দর উঠেছে ২৪ লাখ টাকা। সর্বোচ্চ দরদাতা হয়েছেন মো. আরিফ নামের এক ব্যক্তি।

জানতে চাইলে পাউবোর বরিশাল জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিব হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, যেসব গাছ নিলামে বিক্রি করা হচ্ছে, সেগুলো ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত। বড় ঝড় হলে এগুলো ভেঙে পড়ে, হেলে পড়ে আমাদের ভবনগুলোকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। তাই নিলামে বিক্রি করা হচ্ছে। তাছাড়া এ বিষয়ে আমরা বন বিভাগের অনুমতি নিয়েছি। বন বিভাগ আমাদের শর্ত দিয়েছে, যে একটি গাছ কাটলে দুটি লাগাতে হবে। আমরা সেই শর্ত মেনেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছি।

আরও পড়ুন: উন্নয়নের নামে গাছ কাটা-পাখি হত্যা দূরদর্শিতার অভাব

এদিকে, পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী ও সামাজিক বন বিভাগ বরিশালের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. মোহা. আব্দুল আউয়ালের বক্তব্যে রয়েছে ভিন্নতা। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, গাছ কাটার বিষয়ে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত দিইনি। গাছগুলো পানি উন্নয়ন বোর্ডের। সেখানে আমাদের কোনো হাত নেই। তারা আমাদের জানিয়েছে, আমরা শুধু গাছগুলোর মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছি।

পুরোনো গাছ কাটতে বন বিভাগের কোনো অনুমতির প্রয়োজন হয় কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বন বিভাগের অনুমতির প্রয়োজন আছে। তবে ওই গাছগুলো যেহেতু পাউবোর তাই তাদের সিদ্ধান্তেই কাটা হচ্ছে।

শাওন খান/এমআরআর/জেআইএম