স্বাস্থ্য

আক্রান্ত রোগীরাও স্বজনদের নিয়ে ছুটছেন হাসপাতালে

রাজধানীর মুগদার বাসিন্দা মো. শফিকুল ইসলাম হঠাৎ জ্বরে আক্রান্ত হন। প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষায় তার ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। এর আগেই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন তার স্ত্রী। জ্বর সারার পর অনেকটাই স্বাভাবিকও হয়ে ওঠেন। কিন্তু জ্বর কমলেও হঠাৎ জটিলতা দেখা দেয়, শুরু হয় রক্তক্ষরণ। দ্রুত স্ত্রীর সিবিসি (কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট) পরীক্ষা করেন শফিকুল। রিপোর্টে দেখা যায়, রক্তের প্লাটিলেট ৪০ হাজারের নিচে নেমে গেছে।

Advertisement

এ পরিস্থিতিতে দেরি না করে স্ত্রীকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান শফিকুল ইসলাম। হাসপাতালে ভর্তির পর রক্ত পরীক্ষায় দেখা যায়, প্লাটিলেট আরও কমে ৩২ হাজারে নেমে গেছে। স্ত্রীকে সুস্থ করে তুলতে ডেঙ্গু আক্রান্ত শফিকুল নিজেই হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে থাকেন।

স্ত্রীকে তিনদিন হাসপাতালে ভর্তি রেখে সুস্থ করে বাসায় নেওয়ার পর শফিকুল ইসলাম নিজে ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকেন। তার শরীরের বিভিন্ন অংশে শুরু হয় প্রচণ্ড ব্যথা। পরিস্থিতি অনুধাবন করে আবার তিনি রক্ত পরীক্ষা করান। সেখানে রিপোর্টে দেখা যায়, তার রক্তের প্লাটিলেট ৩৫ হাজারের নিচে নেমে গেছে।

আরও পড়ুন: ডেঙ্গু নিয়ে সতর্ক করলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

Advertisement

শফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে জানান, তার স্ত্রী ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর প্রায় স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিলেন। জ্বর সেরে যাওয়ার পর বাসায় রান্না ও গৃহস্থালির কাজও করছিলেন। কিন্তু হঠাৎই তার রক্তক্ষরণ দেখা দেয়। এরপর রক্ত পরীক্ষা করে দেখা যায়, প্লাটিলেট ৪০ হাজারের নিচে নেমে গেছে। হাসপাতালে ভর্তির পর প্লাটিলেট আরও কমে ৩২ হাজারে নামে। চিকিৎসকরা রক্তের ডোনার ম্যানেজ করতে বলেন। তবে শেষ পর্যন্ত রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি।

শুধু শফিকুল ইসলাম নন, রাজধানীতে অনেকেই এখন নিজে অসুস্থ থাকার পরও ডেঙ্গু আক্রান্ত স্বজনদের নিয়ে হাসপাতালে ছোটাছুটি করছেন। ডেঙ্গুর ভয়াল ছোবলে প্রতিদিন হু হু করে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, ডেঙ্গুরোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো। এমনকি রোগীর চাপ সামলাতে না পেরে অনেক হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ড বা ওয়ার্ডের বাইরের মেঝেতে বিছানা পেতে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে।

চিকিৎসাসেবা পেলেও ডেঙ্গু আক্রান্তদের অনেকে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে কাতরাচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে শিশুদের। কোনো কোনো শিশু বারবার বমি করছে। সন্তানের এ অবস্থা দেখে অনেক বাবা-মা চোখের পানি ধরে রাখতে পারছেন না। বহু রোগী ও তাদের স্বজনদের হাসপাতালে নির্ঘুম রাত কাটছে।

আরও পড়ুন: ঢাকার যে ১১ এলাকা থেকে ডেঙ্গুরোগী বেশি আসছেন

Advertisement

ডেঙ্গু আক্রান্ত সন্তানকে নিয়ে তিনদিন ধরে হাসপাতালে রাজধানীর বাসাবোর বাসিন্দা হাজেরা বেগম। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমার ছেলে খুবই দুরন্তপনা ছিল। বাসায় সবসময় ছুটাছুটি করতো। কিন্তু জ্বরে একেবারে কাবু হয়ে গেছে। কিছু খেতে পারছে না। জোর করে একটু খাওয়ালেই বমি করছে। ছেলেটা আমার মুখ দিয়ে কোনো কথা বলতে পারছে না। ছেলের এ কষ্ট আর সহ্য হচ্ছে না। ওর চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারি না। একটু চোখ বুজলেও পরক্ষণেই আবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে।

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত আট বছর বয়সী সন্তানকে নিয়ে আসা যাত্রাবাড়ীর আলেয়া বেগম বলেন, তিনদিন আগে আমার ডেঙ্গু ধরা পড়ে। আমি খুব বেশি অসুস্থ হইনি। বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছিলাম। কিন্তু এরই মধ্যে আমার একমাত্র ছেলে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়। জ্বর আর শরীরের ব্যথায় ছেলেটা ছটফট করছে। নিজের অসুস্থতা মানতে পারি, ছেলের এমন কষ্ট সহ্য হচ্ছে না।

তিনি বলেন, আমরা সবসময় বাসা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখি। বাসার আশপাশে কোথাও ময়লা নেই। পানিও জমে নেই। নিয়মিত ঘরের ভেতর মশার স্প্রে করি। এরপরও কীভাবে কী হয়ে গেলো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার পর ছেলেও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলো। আমার সাহেব (স্বামী) একটি কোম্পানিতে চাকরি করেন। তিনি এখনও সুস্থ আছেন।

আরও পড়ুন: ডেঙ্গু এখনো নিয়ন্ত্রণে: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত সন্তানকে নিয়ে আসা হাফিজুর রহমান বলেন, আমার ছেলে গত শনিবার (২২ জুলাই) হঠাৎ জ্বরে পড়ে। পরদিন রক্ত পরীক্ষা করলে ডেঙ্গু পজিটিভ আসে। জ্বরে আক্রান্ত হয়ে সে দ্রুত দুর্বল হতে থাকে। বারবার বমি করতে থাকে। হাসপাতালে ভর্তি করেছি, কিন্তু ছেলে এখনো সুস্থ হয়নি। হাসপাতালে প্রতিটি রাত আতঙ্কে কাটছে। ছেলেটার খুব কষ্ট হচ্ছে। এ কষ্ট চোখে দেখতে পারছি না।

গত সোমবার (২৪ জুলাই) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ৯ জনের মৃত্যু হয়। এসময় হাসপাতালে ভর্তি হন রেকর্ড দুই হাজার ২৯৩ জন। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮৫ জন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৫ হাজার ২৭০ জন। এরমধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২১ হাজার ১৮৭ জন। আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন ১৪ হাজার ৮৩ জন।

চলতি বছর হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গুরোগীদের মধ্যে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ছাড়পত্র পেয়েছেন ২৭ হাজার ৬২২ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ১৬ হাজার ৬৪৪ জন এবং ঢাকার বাইরের ১০ হাজার ৯৭৮ জন। ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৮১ জন মারা যান। ওই বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ডেঙ্গুতে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। বছরটিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন।

জানা গেছে, এ বছরে ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া ১৮৫ জনের মধ্যে ১১৫ জনই মারা গেছেন চলতি জুলাই মাসের প্রথম ২৩ দিনে। গত বছর একই সময়ে মারা গিয়েছিল মাত্র ২৯ জন। বাংলাদেশে এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হার গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দশমিক ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গত বছর এ হার ছিল দশমিক ৪৫ শতাংশ।

আরও পড়ুন: ডেঙ্গুর পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই, তবে পরিস্থিতি ভয়াবহ

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ইনচার্জ মো. মারুফ হোসেন শিকদার জাগো নিউজকে বলেন, এবার ডেঙ্গুরোগীর ভয়াবহ চাপ। অনেকদিন ধরেই আমাদের হাসপাতালে শয্যা খালি নেই। তারপরও ফ্লোরে বিছানা পেতে আমরা রোগীদের সেবা দিচ্ছি। আমাদের হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৭০০ রোগী আসছেন। তাদের ৮০ শতাংশই ডেঙ্গু আক্রান্ত।

এবার কোন বয়সীরা বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিশু ও তরুণরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এ বছর ডেঙ্গুর ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। আগে ডেঙ্গু হলে রোগীর জ্বর ও শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রচণ্ড ব্যথা হতো। সঙ্গে থাকতো সিভিয়ার (প্রচণ্ড) মাথা ব্যথা। এবার আক্রান্ত হওয়ার একদিনেই রোগী দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন। চোখের নিচে ব্যথা, মাথা ও হাঁটুতে ব্যথা তো থাকছেই। সঙ্গে বমি করছে, খেতে পারছে না ও পাতলা পায়খানা হচ্ছে।

মারুফ হোসেন শিকদার আরও বলেন, আগে কেউ ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে দু-তিনদিন পর পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে, এবার রোগীর পরিস্থিতি খুব দ্রুত খারাপ হচ্ছে। রোগীদের অনেকের ভীষণ মাত্রায় বমি হচ্ছে। একদিন জ্বর, পরের দিনই চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে। অনেকে খেতে পারছেন না। এগুলোই বেশি হচ্ছে। তবে আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে রোগীর শরীরে যেমন র্যাশ হতো, এবার তেমনটি কম দেখা যাচ্ছে।

ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের ক্ষেত্রে কী ধরনের জটিলতা বেশি দেখা যাচ্ছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, শিশুরা বারবার বমি করছে, খেতে পারছে না। কারও কারও পেট ফুলে যাচ্ছে।

এমএএস/এমকেআর/জেআইএম