স্বাস্থ্য

‘হাত খুলে দাও পার্কে যাবো’

ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে ঢাকা শিশু হাসপাতালের দুই নম্বর ওয়ার্ডে। ওয়ার্ডে প্রবেশ করে দেখা গেলো, ১৩ নম্বর বেডে একটি শিশু চিৎকার ও কান্না করছে। শিশুটি বার বার বলছে, হাত খুলে দাও। হাত ব্যথা করে। এখানে থাকবো না। পার্কে যাবো।

Advertisement

বেডের কাছে গিয়ে জানা গেলো, শিশুটির নাম শাহরিয়ার ইসলাম নিঝুম, বয়স তিন বছর ৮ মাস। ১৩ দিন আগে নগরীর গেন্ডারিয়া থেকে শিশু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। শিশুটির প্রথমে টাইফয়েড হয়েছিল। পরে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। ফলে ১৩ দিন কেটে গেছে হাসপাতালেই।

স্যালাইন ও বার বার ইনজেকশন দেওয়ার জন্য হাতে ক্যানোলা পরানো। ক্যানোলার কারণে হাত ফুলে গিয়ে ব্যথা হচ্ছে। ব্যথার তীব্রতায় ক্যানোলা খুলে দেওয়ার জন্য ছটফট করছে শিশুটি।

শিশুটির বাবা সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমি আমার বাচ্চাকে নিয়ে খুব চিন্তায় আছি। প্রথমে টাইফয়েড, পরে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত। বাচ্চার পেট ফুলে উঠেছে। ১৩ দিন হাসপাতালে ভর্তি। হাতে ক্যানোলা রাখতে চায় না। হাতের ক্যানোলা খুলে দিয়ে পার্কে নিয়ে যেতে বলে। ক্যানোলা খুলে দিলেতো ইনজেকশন-স্যালাইন দেওয়া যাবে না।

Advertisement

তিনি আরও বলেন, বাচ্চা আমার খায় না। সারাদিন সারারাত কান্না করে। যখনই ইনজেকশন দেয় তখনই কান্না করে। কী যে বিপদে আছি। আল্লাহ বাচ্চার এমন রোগ না দিয়ে যদি আমার দিতো তবুও বেঁচে যেতাম।

আরও পড়ুন: ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়: মন্ত্রী

সোমবার (২৩ জুলাই) ঢাকা শিশু হাসপাতালে সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, ২ নম্বর ওয়ার্ড ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিৎকার ও কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে। সব শিশুরই হাতে ক্যানোলা। ইনজেকশন ও স্যালাইন পুশ করার সময় শিশুরা কান্না করছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রুহায়দা ভুইয়া রুহি। বয়স ২২ মাস। চারদিন আক্রান্ত ডেঙ্গু জ্বরে। আগারগাঁও থেকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ১৮ নম্বর বেডে ভর্তি। রক্তে প্লাটিলেট কমে গেছে। খেতে পারে না। পায়ে ক্যানোলা পরানো। ক্যানোলার ব্যথা সইতে না পেরে হাত দিয়ে খুলে ফেলে। এতে শরীর থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। শিশুর এমন অবস্থায় ভেঙে পড়েছেন বাবা বকুল ভুইয়া।

বকুল ভুইয়া বলেন, ছোট বাচ্চা বোঝে না। ক্যানোলার ব্যথা সহ্য করতে পারে না। মনে করে ক্যানোলা খুলে দিলে শান্তি পাবে। এজন্য ক্যানোলা হাত দিয়ে খুলে ফেলতে চায়।

Advertisement

আরও পড়ুন: বাংলাদেশে ‘মহামারির’ পর্যায়ে ডেঙ্গু, বলছেন বিশেষজ্ঞরা

ঢাকা শিশু হাসপাতালের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ২৩ নম্বর বেডে ভর্তি ১১ মাস বয়সী মুরসালিন। ছয় দিন আগে শিশুটি হাতিরঝিল এলাকা থেকে এসেছে। আদরের সন্তানকে যত্নে আগলে রাখার পরও কখন ডেঙ্গু মশায় কামড় দিয়েছে, সে চিন্তায় পাগল বাবা-মা। তাদের অভিযোগ, হাতিরঝিল এলাকায় মশা মারার ওষুধ বেশি দেওয়া হয় না। বাচ্চা অসুস্থ হওয়ার পরে মশা মারার উদ্যোগ দেখেন বলে দাবি ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুর বাবা আলামিনের।

আলামিন বলেন, আমার এলাকায় মশা বেশি। কিন্তু মশা মারার তেমন কার্যকরী উদ্যোগ দেখি না। যখন ছেলে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলো তখন উদ্যোগ দেখেছি।

শিশু হাসপাতালের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের ৪ নম্বর বেডে ভর্তি শিশু আমিনুল। শিশুটি সাভার ধামরাই থেকে এসেছে। ডেঙ্গু জ্বরে কাহিল সে। তারও শরীরে ক্যানোলা। শিশুটিকে ১৪ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ২ নম্বর ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়েছে। শিশুটির শারীরিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় ঘুম নেই বাবার।

এরই মধ্যে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। ফলে দেশের নানান প্রান্ত থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসায় ছুটে আসছেন স্বজনরা। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুর সঙ্গে মাত্র একজন বেড শেয়ার করে থাকতে হবে। কোনো পুরুষ অভিভাবক রাত ১০টার পর হাসপাতালের ভেতরে থাকার অনুমতি নেই। ফলে রাতে বাবারা হাসপাতালের খোলা আকাশের নিচে মশারি টানিয়ে শুয়ে থাকেন। সামান্য বাতাসেই অনেক সময় মশারি উড়ে যায়, মশা প্রবেশ করে।

আরও পড়ুন: ডেঙ্গু এখনো নিয়ন্ত্রণে: স্বাস্থ্যমন্ত্রী

রাতে হাসপাতালের খোলা আকাশের নিচে শুয়ে ছিলেন রুবেল হোসেন। তিনি কুষ্টিয়া দৌলতপুর থানার হোসেনাবাদ এলাকা থেকে এসেছেন। বাচ্চার বয়স ৯ বছর। প্রথমে জ্বর শুরু হয়। এর পরে দৌলতপুর থেকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। সেখানেও শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রুবেলের ঢাকায় কেউ না থাকায় হাসপাতাল চত্বরের খোলা আকাশের নিচে রাত কাটছে।

রুবেল বলন, ঢাকায় কেউ নেই। তাছাড়া অসুস্থ বাচ্চাকে রেখে কোথায় যাব? কোনো ওষুধ লাগলে বউ একা কিনতে পারবে না। অসুস্থ বাচ্চা রেখে অন্য কোথাও ঘুমও আসবে না। আকাশের নিচেই সাত দিন কাটিয়ে দিলাম। বাচ্চার অবস্থাও ভালো নয়।

শুধু রুবেল নন, দেড় শতাধিক বাবা ও স্বজন ১৫০ টাকায় পাটি ও ১৩০ টাকায় মশারি কিনে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছেন। একদিকে যেমন বেডে শিশু ভর্তি বাড়ছে, ঠিক একইভাবে বাড়ছে খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়ে থাকা অভিভাবকের সংখ্যা। সন্তান ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ায় উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে বাবা-মার।

আরও পড়ুন: ঢাকার যে ১১ এলাকা থেকে ডেঙ্গুরোগী বেশি আসছে

চাঁদপুর সদরের বাবুরহাট থেকে ঢাকা শিশু হাসপাতলে এসেছেন মোহাম্মদ হাসমত আলী। বাচ্চার বয়স ছয় মাস চারদিন। জ্বর নিয়ে ১০ দিন হাসপাতালে ভর্তি।

মোহাম্মদ হাসমত আলী বলেন, বাচ্চা ১০ দিন হাসপাতালের বেডে, আমিও ১০ দিন খোলা আকাশের নিচে। ঢাকায় কেউ নেই। কোথায় যাবো?

চলতি বছরের শুরু থেকেই ডেঙ্গু নিয়ে শিশুরা ঢাকা শিশু হাসপাতালে ভর্তি হতে থাকে। প্রথম দিকে শিশুর সংখ্যা কমই ছিল। তবে জুন মাস থেকে হাসপাতালটিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। জুনে ১৯০ শিশু ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়। আর জানুয়ারি থেকে বর্তমান পর্যন্ত ৩২৩ জন শিশু ভর্তি হয়েছে।

চাপ বাড়ায় ১৪ নম্বর ওয়ার্ড ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বরাদ্দ করা হয়। তাতেও স্থান সংকুলান না হওয়ায় ৪২ আসন বিশিষ্ট ২ নম্বর ওয়ার্ডকে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের জন্য বরাদ্দ দেয় হাসপাতালটি। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না। তাই ২ নম্বর ওয়ার্ড ছাড়া অন্য ওয়ার্ডেও ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের ভর্তি করা হচ্ছে।

একদিনে এই হাসপাতালে সর্বোচ্চ ৭৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিল গত শনিবার। বুধবার পর্যন্ত ৬২ শিশু ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি আছে। তাদের মধ্যে ৯ শিশু আইসিইউতে।

আরও পড়ুন: ডিএনসিসি হাসপাতালকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড ঘোষণা, হটলাইন চালু

রোগী বাড়ায় মৃত্যুও বেড়েছে। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসে শিশু হাসপাতালে তিনজন শিশু মারা গেছে। গত মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও এক শিশুর মৃত্যু হয়। হাসপাতালে মোট ছয় শিশু ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।

হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুতে ভরা ২ নম্বর ওয়ার্ড। সব শিশুর জন্যই শয্যার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিশুদের সামলাতে বাবা-মা অস্থির সময় পার করছেন। যে শিশুদের অবস্থা ভালো তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যেসব শিশুর অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছে, তাদের ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. কামরুজ্জামান কামরুল জাগো নিউজকে বলেন, প্রতিদিন অনেক রোগী আসছে। সব রোগীকে আমরা অ্যাডমিশন দিচ্ছি না। ডেঙ্গু রোগীদের মোট তিন ভাগে ভাগ করেছি। যাদের নরমাল ডেঙ্গু, তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছি। সিভিয়ার ডেঙ্গু যাদের, তাদের আমরা ভর্তি করছি। সবাইকে ভর্তি করলে হাসপাতালে জায়গা হবে না। যাদের অনেক সমস্যা শুধু তাদেরই ভর্তি নিচ্ছি।

‘ডেঙ্গু রোগীর চাপ এখন পর্যন্ত আমরা সামলাতে পারছি। রোগীর চাপ আরও বাড়লে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’

কোন সমস্যা বেশি হচ্ছে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, যারা আসছে তাদের বেশির ভাগ রোগীর জ্বর। জ্বরের সঙ্গে বমি এবং পাতলা পায়খানা, যা খাচ্ছে সবই বমি হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন যদি তিনবারের বেশি বমি করে, এটি খারাপ সাইন। অনেক রোগী পেটে ব্যথা নিয়ে ভর্তি হচ্ছে, এটিও ডেঙ্গুর লক্ষণ। যাদের জ্বরের সঙ্গে পাতলা পায়খানা আছে তাদের জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। শিশুর জ্বর হলে অবহেলা করা যাবে না। জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু রোগীর চাপ বাড়ছে। রোগীর চাপ আরও বাড়লে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। হাসপাতালে সরেজমিনে ঘুরে আরও দেখা গেছে, জরুরি বিভাগের সামনে শত শত রোগীর ভিড়। এমন চিত্র কখনো দেখা যায়নি এ হাসপাতালে। এমনকি হাসপাতালের একটি ওষুধের দোকান, বিভিন্ন টেস্টের জন্য টাকা জমা দেওয়ার বুথের সামনেও অভিভাবকদের দীর্ঘ লাইন। বাড়তি রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এমওএস/এমএইচআর/এমএস