স্বাস্থ্য

বেশি খরচে ডেঙ্গুর ‘ভালো’ চিকিৎসা, দিনে ৫ হাজার টাকা

#রোগীপ্রতি দিনে গড়ে খরচ ৫০০০ টাকা#ভর্তি অধিকাংশ ডেঙ্গুরোগীই চাকরিজীবী#রোগীর চাপে ওয়ার্ড সম্প্রসারণের উদ্যোগ

Advertisement

ছয়দিন আগে ডেঙ্গু পজিটিভ হই। প্রথম দুদিন বাসায়ই কেটেছে। শরীরের অবস্থা বেগতিক দেখে হাসপাতালে ভর্তি হই। চিকিৎসাসেবা খুবই ভালো। সার্বক্ষণিক নার্সরা দেখভাল করেন। ইনজেকশন, ওষুধ, স্যালাইন সরবরাহ করেন। প্রতিদিন সকাল ১০টার দিকে রক্ত নিয়ে যান। টেস্ট করে প্লাটিলেট কেমন তাও জানান। সবই ঠিক আছে। কিন্তু খরচটা সাধ্যের বাইরে। বেড ভাড়াই ২ হাজার টাকা। অন্য সব দিয়ে খরচ প্রায় ৫ হাজার টাকা। মাত্র ২ হাজার টাকা নিয়ে ভর্তি হই। চারদিনে প্রায় ১৯ হাজার টাকা বকেয়া পড়েছে। শুনলাম, রিলিজ দেবে। হাসপাতাল ছাড়ার সময় এত টাকা কীভাবে দেবো!

ক্ষীণকণ্ঠে জাগো নিউজকে কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর মধ্যবাড্ডার এ এম জেড হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন মো. আল-আমিন (২২)। তার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল। থাকেন বসুন্ধরা এলাকায়। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের বেডে কাতরানো আল-আমিনকে দেখাশোনা করছেন তার এক সহকর্মী। পরিবারের লোকজন খবর পেলেও আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় ঢাকায় আসতে পারেননি বলে জানান এই তরুণ।

আল-আমিন বলেন, ‘আমি থাকি বসুন্ধরায়, ব্যাচেলর বাসায়। অফিসও একই এলাকায়। অফিস আর বাসা ছাড়া তেমন কোথাও যাওয়া হয় না। ডেঙ্গু বেড়ে যাওয়ার খবরে সচেতনই ছিলাম। হঠাৎ জ্বর এলো, শরীরে ব্যথাও। অফিসও করতে পারছিলাম না। পরে এই হাসপাতালে (এ এম জেড) এলাম। ওইদিন সকালে রক্ত দিয়ে বাসায় যাই। রাতেই জানালো, আপনি ডেঙ্গু পজিটিভ। তারপরও বাসায় ছিলাম। শরীর খুব ক্লান্ত অনুভব করায় হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন সহকর্মীরা।’

Advertisement

আরও পড়ুন> ডেঙ্গু রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসার দাবি

এ এম জেড হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে ভর্তি অধিকাংশ রোগীই আল-আমিনের মতো চাকরিজীবী। কিংবা চাকরিজীবী পরিবারের সদস্য। তাদের সবার ধরাবাঁধা আয়। মাসের খরচ মাসে জোগাতে হয় বেতনের টাকা থেকেই। ফলে হঠাৎ ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ায় মোটা অঙ্কের চিকিৎসা খরচ মেটাতে হিমশিম অবস্থা তাদের।

ডেঙ্গু ওয়ার্ড ‘এ’-এর ৬ নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন শেখ ওবায়দুল্লাহ বলেন, ‘আমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি। থাকি মধ্যবাড্ডার ময়নারবাগ এলাকায়। স্ত্রী ও সন্তান গ্রামের বাড়িতে থাকে। এখানে ব্যাচেলর বাসায় থাকি। প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে দুদিন অফিস করেছি। শুক্রবার হাসপাতালে আসি। টেস্টে ডেঙ্গু পজিটিভ আসায় ভর্তি হয়েছি। মাত্র ৫০০ টাকা অগ্রিম দিয়ে ভর্তি হয়েছি। চারদিন ভর্তি আছি। হয়তো আরও দুদিন থাকতে হতে পারে। ধারদেনা করে হাসপাতালের বিল মেটাতে হবে।’

আরও পড়ুন> ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়: মন্ত্রী

Advertisement

তবে চিকিৎসা খরচ নিয়ে সবাই যে আল-আমিন ও ওবায়দুল্লাহর মতো দুশ্চিন্তায় রয়েছেন, তা নয়। অনেকে ভালো সেবা পেতে চান বলেই এ এম জেডে ভর্তি হয়েছেন। তেমনই একজন রিয়াজুল হক। গুলশান-বাড্ডা লিংক রোড এলাকায়ই তার বাসা। কলেজপড়ুয়া এ তরুণের বাবা দীর্ঘদিন এ এলাকায় থাকেন। রয়েছে নিজস্ব বাড়িও। ছেলের জ্বর আসার সঙ্গে সঙ্গে এ এম জেড হাসপাতালে ভর্তি করান। প্রথমবার টেস্টে ডেঙ্গু পজিটিভ না এলেও শারীরিক অবস্থা খারাপ থাকায় দ্বিতীয় দফা টেস্ট করান। সেবার পজিটিভ আসার পর টানা সাত দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

রিয়াজুলের বাবা আব্দুল বাসেত জাগো নিউজকে বলেন, ‘আশপাশে তেমন সরকারি হাসপাতাল নেই। আর সরকারি হাসপাতালে ভিড় বেশি। আমার একটামাত্র ছেলে। ভালো চিকিৎসা যাতে পায়, সেজন্যই এখানে ভর্তি করেছি। এখানে সব ধরনের সেবা ভালো।’

সেবার মান সন্তোষজনক হলেও খরচ বেশি এটা মানতে নারাজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এই হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডের সমন্বয়ক আমিনুর রহমান বলেন, ‘হিসাব অনুযায়ী খুবই কম খরচ। রোগীদের সেবা নিশ্চিতে তিন শিফটে ২৪ ঘণ্টায় চিকিৎসক-নার্সরা তৎপর থাকেন। বলা চলে প্রতি চারজন রোগীর জন্য এখানে আমরা একজন নার্স রেখেছি। কোয়ালিটি অনুযায়ী বেড ভাড়াও খুব কম। দিনে মাত্র ২ হাজার টাকা। ভালো সেবা নিতে হলে একটু খরচ বাড়তি হবেই। আমরা তো জোর করে কারও থেকে টাকায় আদায় করছি না।’

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী জাইফা রহমান। জ্বর আসার সঙ্গে সঙ্গে তার বাবা-মা তাকে হাসপাতালে এনেছেন। তিন দফা টেস্ট করেও ডেঙ্গু পজিটিভ ধরা পড়েনি। কিন্তু জ্বর কমছে না। শরীরের ব্যথাও কমছে না। ফলে চারদিন ধরে শিশুকন্যাকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন চাকরিজীবী বাবা।

উত্তর বাড্ডায় থাকেন এস এম বারী। ২০ জুলাই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তিনি বলেন, আশপাশে সরকারি হাসপাতাল নেই। মেডিলিংকসহ কয়েকটা হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ড রয়েছে। সবখানে খরচ বেশি। এখানে সেবা ভালো জেনে ভর্তি হয়েছি।’

এস এম বারী বলেন, ‘আমার বাসায় অনেকে জ্বরে আক্রান্ত। সবাই টেস্ট করাচ্ছেন না। বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। টেস্ট করালে অনেকেরই ডেঙ্গু পজিটিভ হতে পারে বলে আমার মনে হয়। অবস্থা খুবই খারাপ।’

হাসপাতালের ‘এ’ ওয়ার্ডে ভর্তি ইশরাত জাহান মিম জানান, তার স্বামী চাকরিজীবী। গত দুই সপ্তাহে তিনি বাসার বাইরেও যাননি। বাসায়ও ডেঙ্গুর প্রজনন হয়, এমন পরিবেশ নেই। তাছাড়া সন্ধ্যার পর সার্বক্ষণিক তারা বাসায় মশারি টাঙিয়ে থাকেন, কয়েল জ্বালান। বাসায় কোথাও পানিও জমতে দেননি। তারপরও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘এ হাসপাতালে সেবা ভালো, খরচ বেশি। খাবারও এখানকার ক্যান্টিন থেকে দেওয়া হচ্ছে। নিয়মিত খাবারের বাইরে বাড়তি খাবারও কিছু সরবরাহ করছে। রিলিজের সময় সব হিসাব কষে বিল করবে। ছয় দিন ভর্তি আছি, এখানেই খাচ্ছি। ওদের ফার্মেসি থেকেই ওষুধ, ইনজেকশন, স্যালাইন সব নিচ্ছি। হয়তো মোটা অঙ্কের টাকা খরচ হবে।’

সকালের শিফটে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড দুটি ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত নার্সপ্রধান জান্নাতুন নাঈমা ও মৌটুসি রায় জাগো নিউজকে জানান, রোগী বা স্বজনরা না ডাকলেও আমরা দিনে অন্তত আটবার রাউন্ড দেই। মেডিসিন থেকে শুরু করে সব সেবা আন্তরিকতার সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে। রোগীদের কোনো অভিযোগ-অনুযোগ নেই।

আরও পড়ুন> স্বাস্থ্য অধিদপ্তর/ডেঙ্গু আক্রান্ত সব রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন নেই

এদিকে, বাড্ডা এলাকায় ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। ফলে এ এম জেড হাসপাতালে রোগীর চাপও বাড়ছে। প্রতিদিন ৮-১০ জন ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠায় হাসপাতাল ছাড়ছেন। তবে নতুন করে ভর্তি হচ্ছেন তারও বেশি। ফলে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে এখন আর বেড ফাঁকা নেই। অনেকে বেড না পেয়ে বাসায় থেকে এ হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা ও পরামর্শ নিচ্ছেন।

রোববার (২৩ জুলাই) সকাল ৮টা থেকে সোমবার (২৪ জুলাই) সকাল ৮টা পর্যন্ত সময়ে ২৪ ঘণ্টায় এ এম জেড হাসপতালে নতুন করে ১৫ জনের ডেঙ্গু পজিটিভ হয়েছে। বর্তমানে হাসপাতালটিতে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৩৪ জন। ছাড়পত্র পেয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ৪২ জন। গত পাঁচদিনে রোগী ভর্তি ও ছাড়পত্র পাওয়ার হিসাব কষে দেখা গেছে, এ এম জেড হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন ১৪ জন ডেঙ্গুরোগী এখানে ভর্তি হয়েছেন।

ডেঙ্গু রোগীদের জন্য এ হাসপাতালে দুটি ওয়ার্ড রয়েছে। একটি আক্রান্তদের জন্য। অন্যটি সন্দেহভাজন রোগীদের জন্য। তবে পজিটিভ রোগী বাড়ায় দুটি ওয়ার্ডের প্রায় সব বেডই ডেঙ্গুরোগীতে ভরে গেছে। ফলে ডেঙ্গু চিকিৎসায় আরও একটি ওয়ার্ড চালুর পরিকল্পনা করছে কর্তৃপক্ষ।

এ প্রসঙ্গে হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ডের সমন্বয়ক আমিনুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রথমদিকে রোগী কম ছিল। তিন-চার দিন ধরে বেশি আসছে। হয়তো আরও বাড়বে। তখন বেড দেওয়া কষ্ট হয়ে পড়বে। সার্বিক দিক বিবেচনায় রেখে আমরা আরও একটি ওয়ার্ড চালুর চিন্তা-ভাবনা করছি।’

এএএইচ/এসএনআর/এএসএম