মো. তায়েবুর রহমান তুষার
Advertisement
পাটশিল্প বাংলাদেশের এক অন্যতম প্রাচীন উৎপাদন ক্ষেত্র এবং বিশ্বব্যাপী বাংলার পাটের সুখ্যাতি অনেক আগে থেকেই। এখনো দেশের প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ পাট উৎপাদন ও শিল্পের সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে আছে। একসময় বাংলার অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি ছিল পাটশিল্প এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান হাতিয়ার ছিল পাট। তাই তো পাটকে ‘সোনালি আশঁ’ বলা হতো। আমাদের দেশে উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু, অত্যন্ত উর্বর পলিমাটি এবং অত্যাধিক বৃষ্টিপাত হওয়ায় পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত মানের শক্ত তন্তুযুক্ত পাট উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। বিশ্ব চাহিদার ৮০-৯০% কাঁচা পাট চাষ হতো আমাদের দেশে। উপমহাদেশ ভাগ হওয়ার আগে আমাদের দেশে পাটকল না থাকায় কাঁচা পাট রপ্তানি করা হতো। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপি পাট পণ্যের ব্যাপক চাহিদা দেখা দেয়। কিন্তু তখন পাটকল না থাকায় শুধু কাঁচা পাট বিক্রি করা হতো। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাটশিল্পের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখা যায় ১৯৫১ সালে, যখন পৃথিবীর বৃহৎ পাটকল আদমজী জুট মিলস তৈরি করা হয় (এটি ছিল তখনকার পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশের ৩য় পাটকল, প্রথমটি হলো বাওয়া পাটকল)। আদমজীকে তখন বলা হতো প্রাচ্যের ডান্ডি। পরে মূলত ষাট ও সত্তরের দশকে দেশে অসংখ্য পাটকল স্থাপিত হয়। তখন থেকে নিজেদের উন্নতমানের পাট ব্যবহার করে আদমজীসহ অন্য পাটকলগুলোয় উৎপাদিত হতো চট, কার্পেটসহ বিভিন্ন ধরনের পাটজাত পণ্য, যা দেশের চাহিদা পূরণ করে রপ্তানি হতো চীন, ভারত, কানাডা, আমেরিকা, থাইল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। পরিবেশবান্ধব দ্রব্য হিসেবে বিশ্ব বাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা ক্রমবর্ধমান হলেও তখন এ শিল্পের বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয়।
বাংলাদেশ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পাট উৎপাদক দেশ হলেও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রোগ পোকার আক্রমণে মাঝে মাঝেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে পাটকলগুলোয় কাঁচা পাটের জোগানে সমস্যা দেখা দেয়, শ্রমিকদের সময়মতো বেতন ভাতা ঠিকমতো না দিতে পারায় বিভিন্ন পাটকলে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। অন্যদিকে অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত দেশ হওয়ায় পাটকলগুলোয় আধুনিকীকরণ করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে, বিশ্ববাজারে পাটজাত পণ্যের চেয়ে কম মূল্যের বিকল্প পণ্য হিসেবে পলিথিন, প্ল্যাস্টিক, নাইলন ইত্যাদি আবিষ্কারের ফলে পাটজাত পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা বহুলাংশে হ্রাস পেতে থাকে। কৃষকরাও পাটের দাম কম হওয়ায় জমিতে পাট চাষ করার আগ্রহ হারাতে থাকে। তারা জমিতে অন্য ফসল চাষ করতে শুরু করে।
আরও পড়ুন: সোনালি আঁশকে ঘিরে স্বপ্ন দেখছেন চাষিরা
Advertisement
অন্য শিল্পের ন্যায় বাংলাদেশের পাটশিল্পের গুরুতর সমস্যা হলো বিদ্যুতের অনিয়মিত সরবরাহ। মাঝে মাঝেই পাটকলগুলোয় বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্ন ঘটে। ফলে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হয়। প্রতি বছর সরকার পাটকলগুলোয় লোকসান দিতে শুরু করে। ফলে পাটকলগুলোকে ১৯৭২ সালের পর থেকে জাতীয়করণ করা হয়, তখন পাটকলগুলোয় নেতৃত্ব ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের অভাব, বৈশ্বিক বাজার দখলের কৌশলগত ত্রুটি, আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও মেশিনের অভাব, অদক্ষ ও অপ্রয়োজনীয় বেশিসংখ্যক শ্রমিক নিয়োগের ফলে বছরের পর বছর লোকসান গুনতে হচ্ছিল, পাটকলগুলো বন্ধ হতে শুরু করে। ফলে দেশের সম্ভাবনাময় শিল্পটি অনিশ্চয়তার মাঝে পড়ে যায়।
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক দপ্তর খুঁজে পেয়েছে, বিশ্বব্যাপি প্রতি মিনিটে প্রায় ১ মিলিয়ন পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার হচ্ছে। যার মাঝে মাত্র ০.৫০ শতাংশ পুনঃব্যবহার হচ্ছে বাকি ফেলে দেওয়া অংশ পরিবেশ নষ্ট করছে। ফলে নদ-নদী, খাল-বিল, নালা ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে প্ল্যাস্টিক প্রাকৃতিক পরিবেশে মিশে যেতে প্রায় ৩০০-৪০০ বছর সময় লাগে। প্ল্যাস্টিক মাটির মাঝে অবস্থান করে অক্সিজেন ও পানির প্রবাহকে ব্যাহত করে। প্ল্যাস্টিক পোড়ানো হলে এর বিষাক্ত ধোঁয়া বায়ু দূষণ করে। বিশ্বজুড়ে এর ভয়াবহতা বুঝতে পেরেই ২০০৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত আফ্রিকা, এশিয়া প্যাসিফিক, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশেই প্ল্যাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ হতে থাকে। তখন বিকল্প হিসেবে পুনঃব্যবহার যোগ্য কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহারের কথা ভাবা হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য বিনষ্ট, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ দূষণের কথা চিন্তা করে পরিবেশবান্ধব পাটের কথা বলা হয়। পাট এমন একটি পণ্য যার কোনো অংশই ফেলে দিতে হয় না। সিনথেটিকের ব্যবহার পরিহার করে পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে জ্যামিতিক হারে বিশ্বে পাটের চাহিদা বাড়ছে। পাটের আঁশ দিয়ে তৈরি করা হয় সোনালি ব্যাগ, যা প্রতি বছর ৫০০ মিলিয়ন পচনশীল শপিং ব্যাগের চাহিদার সমতুল্য। এছাড়া পাট থেকে তৈরি হয় ‘ভিসকস’ সুতা, যা উৎপাদন করতে পারলে আমাদের গার্মেন্টস সেক্টরের আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব। পাশাপাশি পাট থেকে বস্তা, ফেব্রিক্স, হ্যান্ডব্যাগ, কার্পেট, শাড়ি, পর্দা, সুতা, সোফা, শো-পিসসহ শতশত রকমের পণ্য তৈরি করা সম্ভব। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকায় এসব পণ্যের বিশেষ চাহিদা ও বাজার রয়েছে।
আরও পড়ুন: পাট চাষ: কোন পোকা দমনে কী করণীয়
বর্তমানে পাট পাতা দিয়ে অর্গানিক চা তৈরির কৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে, গুণগত মানসম্পন্ন এ চা উৎপাদন ও রপ্তানি করছে জার্মানি। কেনাফ বীজ থেকে ভোজ্যতেল হচ্ছে। অন্যদিকে পাটকাঠি (রুপালি কাঠি) পুড়িয়ে যে ছাই উৎপন্ন হয়, তাতে আছে অ্যাক্টিভেটেড কার্বন, যা দিয়ে তৈরি করা হয় ব্যাটারি, ওষুধ, প্রসাধনীসহ নানাবিধ সামগ্রী। কার্বন পেপার, ফটোস্পিয়ার মেশিনের কালি, ওয়াটার পিউরিফিকেশন পস্ন্যান্টি বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি করা হয়।
Advertisement
অপরদিকে পরিবেশের জন্য পাট চাষ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি ১ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করলে ১৫ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং ১১ টন অক্সিজেন প্রকৃতিকে দেয়। দুঃখজনকভাবে এ শিল্প বহুভাবে অবহেলিত হলেও পরে আন্তর্জাতিক বাজার ও পরিবেশবান্ধবের কারণে সরকার এ শিল্পের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরে কিছু যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সরকারের পক্ষ থেকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিয়ে ‘পাটনীতি’ প্রণয়ন করা হয়েছে। জাতীয় সংসদে ‘পণ্যের মোড়কীকরণে পাটপণ্যের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন ২০১০’ পাস করেছে। পাট উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সংস্থা ‘বিজেএমসি’কে আধুনিক করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পাটের উচ্চফলন ও কাঁচা পাট প্রক্রিয়াজাত করণের জন্য সরকার গবেষণার উপর বেশি প্রাধান দিচ্ছে।
২০১৩ সালে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ড. মকসুদুল আলমের নেতৃত্বে দেশি পাটের জীবন রহস্য উন্মোচন করে গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়। বিজেআরআই বিজ্ঞানীগণ পাটের আরেকটি জাত তোষা পাট ও পাটের জন্য ক্ষতিকারক এক ধরনের ছত্রাক ম্যাক্রোফোমিনা ফ্যাসিওলিনাজীবন রহস্য উন্মোচন করেছেন। উচ্চফলন ও উন্নতমানের জন্য তোষা পাটকে সবুজ সোনা হিসেবেও দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে উদ্ভাবিত নতুন জাত ও পাটকে প্রক্রিয়াজাত করণের বিভিন্ন প্রযুক্তি কৃষক ও উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন ট্রেনিং ও সেমিনার করে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: পাটের জৈবিক ও ফার্মাকোলজিক্যাল ক্রিয়াকলাপ
সরকারি পাটকলগুলোয় আধুনিকরণের লক্ষ্যে নতুন কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগ এবং মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার অব্যাহত আছে। বিশ্ববাজারে টিকে থাকার জন্য পাটের বহুমুখী ব্যবহার, নতুন ও ভিন্নধর্মী পণ্য আবিষ্কারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। পাটশিল্পটি আমাদের দেশে অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের ভেতর দিয়ে এখনো টিকে আছে। বর্তমানে বিশ্ববাজারের চাহিদার শতকরা ৯০ ভাগ কাঁচা পাট এবং ৬০ ভাগ পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বহু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে জাতীয় রাজস্ব খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বাংলাদেশ সর্ব্বোচ পাট রপ্তানি কারক দেশ হিসেবে পরিচিত। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এর সুফল অচিরেই পাটশিল্পের তথা দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। ফলে বিশ্ববাজারে পাটের হারানো গৌরব ফিরে পাবে।
লেখক: বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট।
এসইউ/এমএস