ঢাকার ধামরাইয়ের বিলে পল্লী বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনের ঝুলন্ত তারে জড়িয়ে দুই হাত হারানো কিশোর সাদীকে দেড় ১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ কেন দেওয়া হবে না সে বিষয়ে রিটের চূড়ান্ত শুনানির জন্য আগামী ৯ আগস্ট দিন ঠিক করেছেন হাইকোর্ট। ওই দিন রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জারি করা রুলের ওপর শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে বলে জানান সাদীর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
Advertisement
এ বিষয়ে মঙ্গলবার (২৫ জুলাই) বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি মো. শওকত আলী চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ সাইফুজ্জামান ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল জুলফিয়া আক্তার।
আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, আজকে এ বিষয়ে শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করা ছিল। শুনানি আংশিক করা হয়েছে। চূড়ান্ত শুনানির জন্য আগামী ৯ আগস্ট দিন নির্ধারণ করেছেন আদালত।
এর আগে গত ১২ জুন এক রিট আবেদনের বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে দুই হাত হারানো মো. শেখ সাদী নামে এক কিশোরকে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট একই বেঞ্চ এ রুল দেন।
Advertisement
শেখ সাদীর বাবা মো. জসিম উদ্দিন গত ২ মার্চ বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন করেন। ফল না পেয়ে ২ মে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড বরাবর দেড় ১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে আইনি নোটিশ পাঠান। এর পরিপ্রেক্ষিতে কোনো পদক্ষেপ না পেয়ে গত ৪ জুন তিনি হাইকোর্টে রিটটি করেন।
ওইদিন রিটকারীর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ধামরাই বর্ণমালা স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়তো সাদী। ধানসিঁড়ি আবাসিক এলাকার পুকুরে গত বছরের ১৫ জুলাই দুপুরে গোসল করতে যায় সাদী। পুকুরে ঝাঁপ দেওয়ার সময় পানির ওপর ঝুলন্ত বিদ্যুতের তারে স্পৃষ্ট হয়ে তার দুই হাতে আগুন লাগে। উদ্ধার করে তাকে ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসক তাকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাঠান। তবে, শারীরিক অবস্থা গুরুতর হওয়ায় সেখানকার চিকিৎসক সাদীর দুই হাত কেটে ফেলেন।
আইনজীবী জানান, দুর্ঘটনাস্থল ও এর আশপাশে বিভিন্ন সময় পল্লী বিদ্যুতের তার ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল। ঝুঁকিপূর্ণ তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য স্থানীয় লোকজন ধামরাই জোনাল কার্যালয়ের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজারকে অনুরোধ করলেও ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিসহ বিবাদীদের এক সপ্তাহের মধ্যে ওই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
ভুক্তভোগী ওই কিশোর তার মা-বাবা ও তাদের আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধামরাইয়ের বরাতনগরে তাদের বাড়ি। স্থানীয় বর্ণমালা উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে (ঘটনার সময় অষ্টম শ্রেণি) পড়াশোনা করছে সাদী। ২০২১ সালের ১৫ জুলাই বাড়ির অদূরে ধানসিঁড়ি আবাসিক এলাকার একটি বিলে বন্ধুদের সঙ্গে গোসল করতে যায় সে। বেলা ১১টার দিকে সবাই মিলে পানিতে নেমেছিল। বিলের ওপর দিয়ে হাত ছুঁই ছুঁই ঝুলন্ত অবস্থায় পল্লী বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আরও আগেই স্থানীয় পল্লী বিদ্যুৎ অফিসকে অবহিত করা হয়। ওই দিন অসাবধাণতাবশত সাদীর দুই হাত লেগে যায় তারে। সঙ্গে সঙ্গে ঝলসে যায় দুই হাত। তাৎক্ষণিকভাবে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়ার পরামর্শ দেন। ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয় তাকে। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সাদীকে বাঁচাতে তার কাঁধ থেকে দুটি হাতই কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন তারা। ১৭ জুলাই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হাত কেটে ফেলা হয়। আরও এক মাস হাসপাতালে থাকার পর কিছুটা সুস্থ হলে বাড়ি ফিরে যায় সাদী। কিন্তু জীবনটা আর তার কাছে জীবনের মতো থাকেনি। হয়ে যায় এলোমেলো।
Advertisement
সাদীর বাবা মো. জসিম উদ্দিন ময়মনসিংহে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। মা রাশেদা বেগম গৃহিণী। সাদীর বড় বোন ইশরাত জাহান মীম উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিন বছরের ছোট ভাই সামী। পরিবারটির একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি জসিম উদ্দিন। মাসে বেতন যা পান তা দিয়ে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা আর সংসার চালাতে গলদঘর্ম অবস্থা। ১১ মাস সাদীর চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে আর্থিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে পরিবারটি।
দুই হাত হারানোর পর সাদীর জীবন কীভাবে চলছে তার বর্ণনা পাওয়া গেছে মা রাশেদা বেগমের মুখে। ছেলের খাওয়া, গোসল, শৌচাগারে যাওয়া সবকিছুর দেখাশোনা করছেন তিনি। যখন পড়তে বসে পাশে মা কিংবা ভাই-বোনেরা বই-খাতা-কলম এগিয়ে দেন। সাদীকে এখন লিখতে হয় পায়ের আঙুল দিয়ে। কিন্তু সেটি তার জন্য অনেক কষ্টসাধ্য। স্কুলে মাঝেমধ্যে গেলেও আগের সেই উৎসাহ-উদ্দীপনা এখন আর নেই। তার পড়াশোনা প্রায়ই বিঘ্নিত হচ্ছে।
এফএইচ/এমএএইচ/এএসএম