‘মশার ওষুধ ছিটায় রাস্তায়। বিকালের পরে মশা বাড়তে থাকে। হেরা স্প্রে কইরা রাস্তার মশা খেদাইয়া বস্তিতে ঢুকাইছে। বড় লোকের ঘরে জন্ম নেওয়া মশা বস্তিবাসীর অবস্থা খারাপ কইরা দিছে।’
Advertisement
ক্ষোভ প্রকাশ করে কথাগুলো বলছিলেন রাজধানী ঢাকার মিরপুর-১২ নম্বর সেকশন এলাকার মোল্লা বস্তির এক নারী।
তার পাশে থাকা গার্মেন্টসকর্মী শাহনেওয়াজ বলেন, ‘বস্তিতে মশার ওষুধ ছিটায় না। আবার বস্তি পরিষ্কার করার কোনো বালাই নেই। সিটি করপোরেশনের লোকজন এদিকে আসে না। সারা বছরই মশা থাকে। বাচ্চাদের জ্বর লেগেই থাকে।’
সোমবার সরেজমিনে মোল্লা বস্তিতে গিয়ে দেখা যায় ঘরে ঘরে জ্বর। তবে চিকিৎসকের কাছে যান না কেউ। পাশের ফার্মেসিই তাদের ভরসা। ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেও থাকছেন ঘরেই। বস্তির একাধিক ঘরে কথা বলে জানা যায়, প্রায় অধিকাংশ পরিবারের কোনো না কোনো সদস্য জ্বরে আক্রান্ত। বেশিরভাগই টাকা খরচের ভয়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাননি। যারা করিয়েছেন তাদের মধ্যে হাসপাতালমুখী হওয়ার প্রবণতা কম। ফার্মেসি থেকে স্যালাইন, ওষুধ নিয়ে করিয়েছেন চিকিৎসা।
Advertisement
আরও পড়ুন>> একটি মশার দেখাও মেলে না যে দেশে
এই বস্তিতে থাকেন সবজি বিক্রেতা আল-আমিন। তিন ধরে তার স্ত্রী আয়েশার জ্বর। খিঁচুনি দিয়ে জ্বর আসা, বমি, পাতলা পায়খানা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিলে প্রাথমিকভাবে পাশের ফার্মেসিতে নেন। পরে সোমবার (২৪ জুলাই) সকালে পরীক্ষায় ডেঙ্গু পজিটিভ এলে বাসায় স্যালাইন নেওয়া শুরু করেন।
আল-আমিনের পাশের ঘরে মর্জিনা নামে আরেক নারী জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন কিছুদিন। তবে তিনি ডেঙ্গু পরীক্ষা করাননি। মানুষের বাসা-বাড়িতে কাজ করা ওই নারী জানান, গত বুধবার রাতে প্রচণ্ড জ্বর শুরু হয়। সঙ্গে শরীর ব্যথা। প্যারাসিটামল ওষুধ, আর ডাবের পানি খেয়েছেন তিনি। চলতি সপ্তাহ থেকে ভালো বোধ করায় আবার কাজে যাচ্ছেন।
কয়েক ঘর দূরে কথা হয় বৃষ্টি নামে ১১ বছর বয়সী একজনের সঙ্গে। বৃষ্টির মা বাসা-বাড়িতে কাজ করেন। বাবা থাকেন গ্রামের বাড়িতে। এক সপ্তাহ আগে তার সাত মাস বয়সী যমজ ভাই হাসান ও হোসাইনের ডেঙ্গু হয়েছিল। পাশের কমিউনিটি ক্লিনিকে চিকিৎসা নিয়েছে তার দুই ভাই।
Advertisement
আরও পড়ুন>> ডেঙ্গু নিয়ে সতর্ক করলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
বস্তিবাসীর কথার সত্যতা মেলে মোল্লা বস্তি সংলগ্ন জুয়েল ফার্মেসিতে গিয়ে। সেখানে একজনকে স্যালাইন নিতেও দেখা যায়। ফার্মেসিটির স্বত্বাধিকারী জুয়েল মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, এক সপ্তাহ ধরে জ্বর, শরীর ব্যথার উপসর্গ নিয়ে রোগীরা আসছে। তাদের ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হাসপাতালে যেতে বলছি। আজ দুজন জানিয়েছে তারা ডেঙ্গু পজিটিভ। গত দুদিনে আটজন ডেঙ্গু হয়েছে বলে জানিয়েছে। তাদের স্যালাইন দিচ্ছি। ডেঙ্গুর চিকিৎসাই তো স্যালাইন ও তরল খাবার।
খরচের ভয়ে হাসপাতালবিমুখ বস্তিবাসী, ফার্মেসিতে স্যালাইন সংকট
জ্বরে আক্রান্তদের স্বজনরা জানান, হাসপাতালে গেলেই প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। ডেঙ্গুর টেস্ট, ওষুধ, হাসপাতালে যাওয়ার খরচ অত্যন্ত বেশি। সব মিলিয়ে রোগীরা বাসায় চিকিৎসা নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন।
আল-আমিন বলেন, অসুখ-বিসুখ হলে তো অনেক খরচ। একটা ডাব ১৫০ টাকা। ওষুধের দামও চড়া। আমার স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে চার দিনে আট হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। এখন জ্বর একটু কমতির দিকে।
আরও পড়ুন>> ডেঙ্গু: রেকর্ড ২২৯২ জন হাসপাতালে ভর্তি, মৃত্যু ৯
জুয়েল মিয়া বলেন, বেশিরভাগ রোগী বস্তির। আমি এখানে আট বছর ধরে ব্যবসা করি। সবার পকেটের অবস্থা কম বেশি জানি। জ্বর নিয়ে এলে তাদের সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল কিংবা সরকারি ক্লিনিকে যেতে বলি। কিন্তু বেশিরভাগই আমার কাছ থেকে চিকিৎসা নিতে চান। এখন আবার ডিএনএস স্যালাইনের সংকট দেখা দিয়েছে। কোম্পানি ঠিকমতো সাপ্লাই দিচ্ছে না, তাদের সঙ্গেও কথা বলেছি। আজ-কাল দেবে বলে ঘোরাচ্ছে।
বিসমিল্লাহ ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী মো. নিজাম জাগো নিউজকে বলেন, কোম্পানি স্যালাইন কম দিচ্ছে। এখানে ১০-১২ দিন ধরে ডেঙ্গুরোগী বেশি। আর দুই-তিন ধরে স্যালাইন সংকট দেখা যাচ্ছে। আশপাশের অন্য ফার্মেসিতে স্যালাইন পাওয়া যাচ্ছে না।
বস্তিতে মশার ওষুধ ছিটানো সম্পর্কে জানতে সিটি করপোরেশনের ওয়েবসাইটে থাকা ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. তাইজুল ইসলাম চৌধুরীর (বাপ্পি) ফোন নম্বরে কল দিয়ে বন্ধ পাওয়া যায়। ওয়ার্ড সচিবও ফোন ধরেননি।
জুয়েল ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী জুয়েল মিয়া বলেন, মশার ওষুধ বস্তিবাসীর কাছে স্বপ্ন। এখানে ওষুধ কখনোই ছিটানো হয় না। অথচ রাস্তার ওপারে এমপি সাহেবের বাসা। মূল সড়কে সকাল-বিকাল ওষুধ ছিটানো হলেও মশক নিধনকর্মীরা বস্তিতে নামেন না। বস্তিবাসী সিটি করপোরেশনে বাস করে ঠিকই কিন্তু অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
এসএম/এএসএ/এএসএম