ভ্রমণ

একদিনেই ১১ জনের নিকলী ভ্রমণ

ইশতিয়াক আহাম্মেদ

Advertisement

ওরা ১১ জন। কথাটি শুনলে প্রথমে কি মাথায় আসে? নিশ্চয়ই ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত স্বাধীনতাত্তোর প্রথম চলচ্চিত্রের কথা যা ১৯৭২ সালে মুক্তি পায়। এখন ওরা ১১ জনের পরিবর্তে আমরা ১১ জনের একটি ছোট্ট ভ্রমণ কাহিনি শেয়ার করবো।

আমার গল্পে হয়তো বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের রেসকোর্স ময়দানের স্বাধীনতার ডাক থাকবে না, তবে বন্ধুবান্ধব নিয়ে ট্যুর দিতে হলে এমন ডাকের যে প্রয়োজন তা একটু পরে পাঠক নিজেই বুঝতে পারবেন আশা করি। আর সেটা যদি হয় মেডিকেল লাইফের ব্যস্ততম সময়ের মাঝে তাহলে বুঝতেই পারছেন আয়োজককে কতটা ঘাম ঝরাতে হয়েছে।

আরও পড়ুন: একদিনের ছুটিতেই ঘুরতে পারবেন দেশের যেসব স্থানে 

Advertisement

অনেক কথা বলেছি, অনেক ঘেমেছি এখন এই ঘাম শুকাবো আমাদের সাবেক রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ আব্দুল হামিদের স্মৃতিঘেরা নিকলী হাওরে। অচেনা-অজানা কোন মাঝির পালতোলা নৌকায় বসে।

‘মাঝি নাও ছাইড়া দেও মাঝি পাল উড়াইয়া দে।’

জীবন্ত এই গানগুলো শুনতে শুনতে শহর জীবনের একঘেয়েমি কাটিয়ে উঠতেই হঠাৎ পরিকল্পনা। যেভাবেই হোক সময় বের করতেই হবে, তবে একদিনের বেশি বের করা সম্ভব হলো না। স্থান ঠিক করা হলো ঢাকার অদূরে কিশোরগঞ্জের নিকলী হাওর। এবার শুরু হলো আসল সংগ্রাম। কেউ রাজি তো কেউ রাজি না। এ নিয়ে শুরু হলো কথা।

মেসেঞ্জারে খোলা হলো নতুন গ্রুপ। মুরুব্বীদের মুখ থেকে শুনেছি একশত একটা কথা না হলে নাকি বিয়ে হয় না। গ্রুপের সবার কনভারসেশন দেখে রীতিমতো আমার তাই মনে হচ্ছিলো। যদিও এটা ট্যুর, বিয়ে না। অবশেষে সবাই একমত। গুনে গুনে দেখা গেল ১০ জন। তখন ভাবলাম ভালোই হলো হাইস গাড়ি নিয়ে যাবো।

Advertisement

আরও পড়ুন: মোটরসাইকেলে ঢাকা থেকে কুয়াকাটা ভ্রমণ 

এটি ১০ জনের জন্য পারফেক্ট। তবে মুক্তমনের মানুষ। স্বাধীনতার পর প্রথম মুক্তি পাওয়ার চলচ্চিত্রকে তারা যেন হৃদয়ে ধারণ করেছে। ওরা ১১ জন হতেই হবে। সব জায়গায় যাব কি যাব না টাইপের একটা গ্রুপ থাকে? সেখান থেকে জুটে গেল আরো একজন। এই হয়ে গেলাম আমরা ১১ জন।

তবে ১০ জনের জন্য তো গাড়ি ইতিমধ্যে বুকিং দিয়ে রেখেছি। তবে আমরাও বাঙালি। একজনেই দুই বার্গার খায় আবার পকেটে টাকা না থাকলে তিনজনে মিলে এক বার্গার খায়। সুতরাং টাকা কীভাবে বাঁচাতে হয় সেটা আমাদের জানা আছে। মোটা চিকন মিলেমিশে ১১ কে ১০ করে নেওয়া আমাদের জন্য ব্যাপার না।

‘কোথায় তুমি সুহাসিনী? আসবে কি এ তিরে? ভেঙে দিবে অভিমান।আমার অপেক্ষার অবসান। ’

কবির কথামতো অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে চলে এলো কাঙ্খিত দিন। সকাল ৬টায় আমরা সেগুনবাগিচা বারডেম-২ এর সামনে থেকে রওনা দিবো। একটু বলে রাখি আমাদের ট্যুরের ১১ জনই আমরা ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের (বারডেম) শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। অনেকে আবার হবু ডাক্তার বলেও ডাকে।

আরও পড়ুন: বিমান ঘুরতে গেলে সঙ্গে যেসব জিনিস নেওয়া উচিত নয় 

গাড়ি যদিও ভোর পাঁচটার সময় এসে পৌঁছে গিয়েছিলো। তবে আমাদের যাত্রা শুরু করতে করতে বেজে গেল ৮টা। গাড়ি ছাড়তে না ছাড়তেই শুরু হলো সংগীত প্রেমীদের গানের আসর। তবে খালি গলায় গান গাওয়ার মতোত এমন বিশিষ্ট কোনো শিল্পী আমাদের মাঝে না থাকায় গাড়ির সাউন্ড সিস্টেমেই শুনতে হলো।

আর যে যা খাবার একা একা চুপি চুপি খাবে বলে বাসা থেকে নিয়ে এসেছিল সব দিয়ে দিলো আমাদের মতো পেটুকদের। খেতে খেতে তখন অলরেডি গাজীপুর পৌঁছে গেছি। গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুরে হোটেল নিরিবিলিতে সকালের নাস্তাটা শেষ করেই আবার যাত্রা শুরু।

গুগল ম্যাপ আমাদের সঙ্গী হয়ে পথ দেখাচ্ছিলো, যদিও একবার দুষ্টুমি করে আমাদের নদীতে নামিয়ে দিয়েছিল। পড়ে দেখি আর রাস্তা নাই। আমিতো নদীর উপর দিয়েই গাড়ি চালানোর সিদ্ধান্ত মোটামুটি নিয়েই ফেলেছিলাম। তবে আমাদের ড্রাইভার মামা নতুন হলেও খুব সহজেই সব চিনে যায়। তাই আমাদের তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি।

আরও পড়ুন: মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সে গিয়ে যা যা দেখবেন 

তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে নিকলি পৌঁছানোর আগেই আমরা আরেকটি স্পট পেয়ে যায়। আর সেটি ছিলো আফিফার নানার বাড়ি। হঠাৎ এমন নতুন স্পট পাওয়াতে আমাদের আনন্দে যেন নতুন মাত্রা যোগ হলো। আমাদের এক লাল পরী লিমা তো জবা ফুল মাথায় দিয়ে সাজতে শুরু করলো। ভূত আসবে বলে কেউ কেউ রীতিমতো ক্ষেপাতেও শুরু করলো।

ওইদিকে লাঠিকে ব্যাট আর পেয়ারা কে বল বানিয়ে জাতীয় টিমের প্লেয়ারদের মতো ক্রিকেট খেলতে শুরু করলো সাকিব আর আরিফ। তবে আমরা বেশি সময় দেরি না করে শুধু শরবত খেয়ে বেরিয়ে পরলাম। হয়তো সময় থাকলে পুরো দিনটাই কাটিয়ে দিতে পারতাম কিন্তু নিকলী আগেই মন প্রাণ সব কেড়ে নিয়েছে। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নতুন কাউকে আর মন দিতে পারলাম না।

অতঃপর পৌঁছে গেলাম নিকলী। ততক্ষণে দুপুর হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি করে একটি ট্রলার নিলাম অষ্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। আরেকটু আগে পৌঁছাতে পারলে হয়তো ছাতিরচড় ঘুরে আসতে পারতাম। তবে সময় আমাদের সেই সুযোগ করে দেয়নি। ট্রলারে উঠতেই রীতিমতো শুরু হয়ে গেল ফটোসেশন।

আরও পড়ুন: কমলগঞ্জ গিয়ে ঘুরে আসুন চা বাগানের ভূত বাংলোয় 

প্রকৃতি-পানির সঙ্গে একটুখানি নিজের চেহারা কে না ক্যামেরাবন্দি করতে চায়। সাকিব ভাই অনেক ভালো ছবি তোলেন। মুন্নি, সিমিনসহ প্রায় সবাই কেমন জানি তার ফ্যান হয়ে গেল। তবে সেটা শুধু ছবি তোলার জন্য যা আমি কিছুক্ষণ পরে টের পেয়েছিলাম। এদিকে পেছনে তাকিয়ে দেখি ট্রলারের মাঝে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলে। রীতিমতো ড্রোন হামলা হচ্ছে। তবে এটা এক পাক্ষিক।

রাশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করে পুতিনের দেখানো পথেই যেন অর্ণব ছোলা দিয়ে চালাচ্ছে এ ড্রোন হামলা। আর এই যুদ্ধে ইউক্রেনের প্রতিনিধিত্ব করছে রাইসা। ছোলার প্যাকেট যে কয়টা শেষ হয়েছে বলতে পারবো না তবে মজাই লেগেছিল এই ছোলা নামক ড্রোন দিয়ে হামলা চালানো। এই যুদ্ধের প্রধান ইন্ধনদাতা হিসেবে যদিও রাইসার চোখে মুখে আমার নাম জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল, তবে আফিফার ভয়ে কিছুই বলতে পারেনি বেচারি! তাহলে আবার কালোজাম মিস হয়ে যাবে।

এখানেই শেষ নয়, ট্রলারে বসে কাপল ছবি তোলার মনোরম দৃশ্যও আমাদের দেখতে হয়েছে তবে এই কাপল জুটি কোন কপোত-কপোতীর নয়। দুই কপোতীর এই জুটি তৈরি হয়েছিল ইনফতা আর উর্মিকে দিয়ে। যাইহোক দেখতে দেখতে মিঠামইন পৌঁছে গেলাম। দুপুরের খাবার সেরে নিলাম এখানেই।

আরও পড়ুন: বিশ্বের একমাত্র স্থান যেখানে কখনোই বৃষ্টি হয় না 

সিলেটের পাঁচ ভাই কিংবা পানসির মতো না হলেও খাবারের মান একেবারে খারাপ ছিলো না। দুপুরের খাবার শেষ করে রওনা দিলাম অষ্টগ্রামের সেই চোখ ধাঁধানো দৃশ্য দেখতে,যা বছরে বিভিন্ন সময় রূপ বদলায়। চিরসবুজ ধানক্ষেত বর্ষা এলেই যেন মহাসমুদ্র।

খুব দ্রুত সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিলো। খুব দ্রুত কিছু ছবি তুলে নিয়ে আবার ফিরে আসলাম আমাদের জন্য অপেক্ষমান ট্রলারে। ওঠার সময় কিছু খাবার নিয়ে উঠেছিলাম। সেগুলো দিয়ে জাবর কাটতে কাটতে শুরু হয়ে গেল আমাদের ট্রুথ-ডেয়ার খেলার পর্ব। অত্যন্ত কৌশলী মানুষজন সবাই। ছলে বলে কৌশলে তাদের মেধা দ্বারা অত্যন্ত সুকৌশলে সবার মনের কথা বের করে আনার জন্য রীতিমতো উঠে পড়ে লেগেছিলো।

দেখতে দেখতে রাতের আঁধার নেমে এলো। আমরাও পৌঁছে গেলাম ঘাটে। আবার সেই ১০ জনের সিটে ১১ জন বসে ফিরতি যাত্রা শুরু করলাম। আবার শুরু হলো গানের আসর। মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে চা প্রেমীদের গরুর দুধের চায়ের আড্ডা। এ যেন স্বপ্নের রাজ্যে বন্ধুদের নিয়ে কাটানো স্বপ্নীল সময়।

আরও পড়ুন: যে শহরে থাকতে লাগে না টাকা, সবাই স্বাধীন!

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অগ্রসর হতে লাগলাম ইট পাথরের শহরের দিকে। এরই মধ্যে আমাদের এই ১১ জনের সবারই নাম হয়তো তাদের কোনো না কোনো বিশেষ কাজের জন্য বলা হয়ে গেছে।

তবুও বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বরূপ সবার নামই একবার স্মরণ করছি- সিমিন, আফিফা, মুন্নি, সাকিব, ইনিফতা, লিমা, রাইসা, অর্ণব, আরিফ, উর্মি ও আমি ইশতিয়াক। নিকলি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে পরিশেষে শুধু এটুকুই বলবো, সুন্দর কিছু দেখার সুযোগ কখনো হারানো ঠিক নয়।।

লেখক: ইব্রাহীম মেডিকেল কলেজ (বারডেম), ঢাকাঅধ্যয়নরত (শেষ বর্ষ)

জেএমএস/জিকেএস