গত কয়েক মৌসুমে দেশে চালের বাম্পার উৎপাদন হয়েছে। সবশেষ (২০২২-২৩) অর্থবছরে সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে চালের উৎপাদন। সরকারের গুদামেও রেকর্ড পরিমাণ খাদ্য মজুত আছে, আমদানি পরিস্থিতিও সন্তোষজনক। ডলার সংকটসহ নানা অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যে খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে কিছুটা হলেও স্বস্তিতে বাংলাদেশ। তবে ক্রেতাদের অতটা স্বস্তি মিলছে না। এত উৎপাদন ও মজুত থাকার পরও বাজারে চালের দাম কমছে না, বরং বাড়ছে। এতে চরম সংকটে পড়েছে সাধারণ মানুষ। ফলে খাদ্যশস্য উৎপাদনে সরকারের যে সাফল্য, সাধারণ জনগণের কাছে তা অনেকটাই ম্লান।
Advertisement
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ- টিসিবির তথ্য বলছে, সবশেষ বৃহস্পতিবারও বাজারে মোটা চালের দাম বেড়েছে। কেজিপ্রতি ২ টাকা বেড়ে মোটা চাল এখন বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকা পর্যন্ত।
তবে বাজারের চিত্র বলছে ভিন্ন তথ্য। টিসিবির এ দামের থেকেও চড়া দামে চাল বিক্রি হচ্ছে বাজারে। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল এখন ৫৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। বিগত কয়েকমাস ধরে এ বাড়তি দামেই আটকে আছে মোটা চালের বাজার। এছাড়া প্রতি কেজি সরু চাল কিনতে গুনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৮৫ টাকা পর্যন্ত। চালের এ দাম নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে কারও জন্যই স্বস্তিদায়ক নয়। ফলে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাম্পার ফলনের সুফল সরাসরি পাচ্ছে না জনগণ।
আরও পড়ুন: আমাদের চাল রাখার জায়গা নেই, এখন খালি করি কীভাবে
Advertisement
সরকারি স্কুলের শিক্ষক এনায়েতুল্লাহ। রামপুরা বাজারে তার সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের। এনায়েতুল্লাহ বলেন, এত উৎপাদন ও মজুতে সাধারণ ক্রেতার লাভ কী? দাম তো কমে না, বরং বাড়ে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে সদ্য সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় চার কোটি ৯ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে সবশেষ বোরো মৌসুমে উৎপাদন হয়েছে ২ কোটি ১০ লাখ টন। এ উৎপাদন দেড় যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশে চাল উৎপাদনের এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখারও পূর্বাভাস উঠে এসেছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) গ্লোবাল ফুড আউটলুক প্রতিবেদনে। সংস্থাটির সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, এক বছরে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি হারে চালের উৎপাদন বাড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশে। বিদায়ী বছরের (২০২২-২৩) তুলনায় নতুন বছরে (২০২৩-২৪) উৎপাদন বাড়তে পারে এক দশমিক ৮ শতাংশ। পাশাপাশি মোট চাল উৎপাদনে চীন ও ভারতের পর তৃতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।
এক বছরে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি হারে চালের উৎপাদন বাড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশে। বিদায়ী বছরের তুলনায় নতুন বছরে উৎপাদন বাড়তে পারে এক দশমিক ৮ শতাংশ। পাশাপাশি মোট চাল উৎপাদনে চীন ও ভারতের পর তৃতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।
Advertisement
খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, বর্তমানে সরকারি গুদামে খাদ্যশস্য মজুতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৪৬ হাজার ৪০৯ টন। এর মধ্যে চালের মজুত ১৬ লাখ ৮ হাজার ২৩৩ টন এবং ধান এক লাখ ২১ হাজার ৯২ টন, যা গত বছরের চেয়ে বেশি।
আরও পড়ুন: ৫ লাখ টন চাল, ৬ লাখ টন গম আমদানি করবে সরকার
চলতি বছর বোরো মৌসুমে অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ১৬ লাখ ৫০ হাজার টন ধান-চাল কিনছে সরকার। এরই মধ্যে ৯ লাখ ৮৬ হাজার ১২৪ টন ধান-চাল সংগ্রহ হয়েছে। গতবারের (২০২১-২২) তুলনায় এবার ধানের ক্রয়মূল্য কেজিতে ৩ টাকা এবং সেদ্ধ চাল ৪ টাকা বেশি হওয়ায় সংগ্রহ কার্যক্রম ভালো চলছে। গত ৭ মে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে, যা চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রার শতভাগ সফল হবে বলে আশা করছে খাদ্য অধিদপ্তর।
এসব বিষয়ে খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক তপন কুমার দাস জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের উৎপাদন, সংগ্রহ ও মজুত রেকর্ড ছুঁয়েছে। ফলে চাল নিয়ে কোনো শঙ্কার কারণ নেই। বরং সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছি আমরা। নানা অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যে বাংলাদেশ এখন কিছুটা হলেও খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে স্বস্তিতে আছে।
রেকর্ড উৎপাদনের পর আরও পাঁচ লাখ টন চাল আমদানির প্রক্রিয়াও চালু রেখেছে সরকার, যা শিগগির দেশে এসে পৌঁছাবে। তাতে সরকারের মজুত পরিস্থিতি সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করবে। দুই বছর আগেও ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন চাল আমদানি করতে হয়েছিল। কিন্তু এ বছর উৎপাদন ভালো হওয়ায় বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ কমে নেমেছে আট লাখ টনে। এতে কমেছে আমদানিনির্ভরতা, সাশ্রয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা।
আরও পড়ুন: বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে, সরকারি গুদামে চাল রাখার জায়গা নেই
যদিও সরকারের হিসাবে দেশে বছরে চালের চাহিদা সাড়ে ৩ কোটি টন। এ চাহিদার বিপরীতে জোগানের তথ্য পর্যালোচনা করলে এক কোটি টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। বাজারে কিনতে গেলেই বাড়তি দাম, এক্ষেত্রে সংকটের অজুহাত নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
যদিও সরকারের হিসাবে দেশে বছরে চালের চাহিদা সাড়ে ৩ কোটি টন। এ চাহিদার বিপরীতে জোগানের তথ্য পর্যালোচনা করলে এক কোটি টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। বাজারে কিনতে গেলেই বাড়তি দাম, এক্ষেত্রে সংকটের অজুহাত নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
এ বিষয়ে কৃষি গবেষক ও অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান জাগো নিউজকে বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয় এবং এর অধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উৎপাদনের যে তথ্য দেয় সেটা অনেক সময় মেলে না। আবার ভোগের যে তথ্য দেওয়া হয় সেটাও সামঞ্জস্যহীন। মানুষের খাদ্য ছাড়াও চালের বহুমুখী ভোগ (ব্যবহার) বাড়ছে। পরিসংখ্যানে সেসব আসছে না। যে কারণে সামান্য সংকটে চাল আমদানির প্রয়োজন হয়।
তিনি আরও বলেন, এ বিষয়গুলো কখনো পরিষ্কার হয় না, যে সুযোগটা নেন ব্যবসায়ীরা। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের দুর্বলতা থাকে। ফলে রেকর্ড উৎপাদনের সুবিধা পান না ভোক্তারা।
আরও পড়ুন: চাল বেশি আমদানি করলে কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবে না
চাল নিয়ে সরকারের দেওয়া তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে একমত নন চালকল মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক লায়েক আলী। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, চাহিদা ও সরবরাহে ঘাটতি থাকে বলেই অনেক সময় আমাদের (ব্যবসায়ীদের) চাল আমদানি করতে হচ্ছে। উদ্বৃত্ত থাকলে সেসব চাল যায় কোথায়? চড়ামূল্যের এ বাজারে নিশ্চয় কেউ বছরের পর বছর চাল মজুত রাখে না। সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলে ব্যবসায়ীরা কেন আমদানি করেন, এমন প্রশ্ন রাখেন তিনি।
বাড়তি দামের বিষয়ে লায়েক আলী বলেন, সবকিছুর বাজার এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সে প্রভাব চালের দামেও রয়েছে। অন্য নিত্যপণ্য চড়া দামে কিনে ব্যবসায়ীরা কম দামে চাল বিক্রি করতে চাইবেন না নিশ্চয়ই। চাল যারা বিক্রি করেন তারা যদি দাম না পান, তাহলে তাদের জীবন চলবে কীভাবে? সে হিসেবে অন্য নিত্যপণ্যের তুলনায় চালের দাম স্থিতিশীল বলা যায়।
চাহিদা ও সরবরাহে ঘাটতি থাকে বলেই অনেক সময় ব্যবসায়ীদের চাল আমদানি করতে হচ্ছে। উদ্বৃত্ত থাকলে সেসব চাল যায় কোথায়? চড়ামূল্যের এই বাজারে নিশ্চয় কেউ বছরের পর বছর চাল মজুত রাখে না।
তিনি বলেন, এ বছর ধানের দাম নিয়ন্ত্রণে আছে। আসলে কৃষক থেকে মিল পর্যন্ত কোনো সমস্যা নেই, সমস্যা বাজারে। মিলগেটের মূল্য থেকে খুচরা বাজারে চালের দামে বিস্তর ফারাক। আমরা বার বার এ কথা বলছি, অথচ কেউ খুচরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে না।
আরও পড়ুন: মিনিকেট নাম দিয়ে চাল বিক্রি করা যাবে না
এসব বিষয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশিদুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, চালের উৎপাদন খরচ বেড়েছে এটা সত্য। ফলে দাম কিছুটা বাড়বে সেটাই স্বাভাবিক। তবে সে তুলনায় ধানের দাম সেভাবে না বাড়ায় উৎপাদন খরচের বাড়তি ব্যয় কৃষককেই বহন করতে হচ্ছে। মিল বা বিক্রি পর্যায়ে এর (উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির) প্রভাব পড়েনি।
তিনি বলেন, এবার বোরো মৌসুমে এক কেজি চাল উৎপাদনের খরচ ৩ টাকা বেড়ে প্রায় ৪১ টাকা হয়েছে। প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে খরচ ২৮ টাকা থেকে বেড়ে প্রায় ৩১ টাকায় দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ধান ও চালে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ১০ শতাংশ। তবে মিল থেকে ভোক্তা পর্যায়ে চাল পৌঁছাতে কেজিতে ১২ থেকে ১৫ টাকা ব্যবধান হচ্ছে। এটা অস্বাভাবিক। ফলে ভোক্তা-কৃষক উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ড. রাশিদুল হাসান আরও বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে জোরালো ভূমিকা নিতে হবে সরকারকে। পাশাপাশি কৃষকদের ভর্তুকির মাধ্যমে তাদের বাড়তি খরচ কমিয়ে আনতে হবে। এছাড়া চালের উৎপাদন, মজুত ও আমদানি নিয়ে সরকারকে পরিষ্কার তথ্য দিতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সঠিক তথ্য এখন সবচেয়ে জরুরি।
এনএইচ/কেএসআর/জেআইএম