দেশজুড়ে

হালকা যানের লাইসেন্সে বাস চালাতেন মোহন

ঝালকাঠি সদরে বাস দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৭ যাত্রী। এর কারণ অনুসন্ধানে প্রশাসনের পর ঝালকাঠি বাস মালিক সমিতিও তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। মালিক ও শ্রমিকসহ মোট ছয়জনের এ কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।

Advertisement

এদিকে দুর্ঘটনার পর থেকে বাসের চালক নলছিটির রায়াপুর গ্রামের মোহন (৩৫), হেলপার বরগুনার আশিক (১৭) ওরফে বুলেট ও সুপারভাইজার রাজাপুরের মিজান (২২) পলাতক আছেন। এদের আসামি করে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে।

আরও পড়ুন: ইজিবাইককে সাইড দিতে গিয়ে প্রাণ গেলো বাসের ১৭ যাত্রীর

জানা গেছে, চালক মোহন হাওলাদার দুর্ঘটনা কবলিত বাশার স্মৃতি পরিবহনের ওই বাসটির সুপারভাইজার ছিলেন। খোদ ঝালকাঠি বাস মিনিবাস মালিক সমিতি এ চালকের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কারণ চালক মোহন হালকা যানের লাইসেন্স দিয়ে চালাতেন যাত্রীবাহী বাস। পুলিশ বাদী হয়ে চালকসহ তিনজনকে আসামি করে মামলা করেছে।

Advertisement

তবে ঝালকাঠি বাস ও মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হাবিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, মোহন আমার সংগঠনের সদস্য না হলেও মালিক কালাম ভাই তাকে গাড়ি চালানোর দায়িত্ব দেন। ওকে দিয়ে গাড়ি না চালানোর জন্য নিষেধও করেছি। একবার না একাধিকবার বলেছি। না শোনায় বিষয়টি ছয়মাস আগে লিখিতভাবে সমিতিকে জানানো হয়। মোহন কোনো চালক না। তিনি এর আগে কোনো গাড়ি চালাতেন না।

আরও পড়ুন: মেয়েকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হলো না নিপার

তিনি আরও বলেন, দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহ দেখে আমার চোখ দিয়ে পানি গড়ায়। যে কান্না চেষ্টা করেও থামাতে পারিনি। এর চেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতা আমার জীবনে আর কিছু নেই। চালক মোহন এখন গা ঢাকা দিয়েছে।

এ শ্রমিক নেতা বলেন, মোহন যদি আমাদের শ্রমিক সংগঠনের সদস্য থাকতেন তাহলে ছবি, ড্রাইভিং লাইসেন্সের ফটোকপি, জাতীয় পরিচয়পত্র, চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট জমা দিতে হতো। তা না দেওয়ায় ওকে সদস্য করা হয়নি। আগে চালক মোহন হাওলাদার একই গাড়ির সুপারভাইজার ছিলেন। মালিক সেই মায়ায় পড়ে হয়তো একবছর আগে তাকে চালক পদে নিয়োগ দেন। তার লাইসেন্স আছে বলে আমার জানা নেই।

Advertisement

আরও পড়ুন: অসুস্থ নাইম বেঁচে গেলেও মারা গেলেন বাবা

দুর্ঘটনা কবলিত গাড়ির তথ্য নিতে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) অফিসে গিয়ে জানা যায়, ২০১১ সালের মডেলের ওই বাসটির ফিটনেসের মেয়াদ আছে ২০২৪ সালের ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত। ট্যাক্স টোকেনের মেয়াদ একই বছরের ৯ মে এবং রুটপারমিটের মেয়াদ ২০২৫ সালের ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ৫২ সিটের এ বাসটি খুলনা বরগুনা রুটে চলাচলের অনুমতি থাকলেও দুর্ঘটনা কবলিত হয় ভান্ডারিয়া-বরিশাল রুটে।

তবে ঝালকাঠি মালিক সমিতি সূত্র জানায়, সমিতির সিদ্ধান্তে বরিশাল বিভাগের ৩২টি রুটেই মালিক পক্ষের সব গাড়ি চলাচল করতে পারবে।

আরও পড়ুন: মেয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফেরা হলো না পারভীনের

অপরদিকে দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থলে গিয়ে গাড়ির কাগজপত্র ও চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স উদ্ধারের কথা জানালেও তা দেখাতে পারেননি ঝালকাঠি সদর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শফিকুল ইসলাম। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি তা থানায় জমা দিয়েছি।

বাসটির মালিক গুরুতর অসুস্থ বলে মালিক সমিতির দাবি। তাই চালকের বিষয়ে মালিকের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে ঝালকাঠি বাস মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, আমরা বাস মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নের সমন্বয়ে ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছি। পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটি প্রতিবেদন দেবে। এটা আমাদের সম্পূর্ণ নিজস্ব কমিটি। প্রশাসনের তদন্ত কমিটির সঙ্গে এর কোনো যোগসূত্র নেই।

কেন এ তদন্ত কমিটি জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিগত দিনে ঝালকাঠি বাস মালিক সমিতির কোনো গাড়ি এতো বড় দুর্ঘটনায় কবলিত হয়নি। অবশ্যই এর কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। যা আমাদের চিহ্নিত করে ভবিষ্যতে সতর্ক হতে হবে। এখানে চালক মোহনের ড্রাইভিং লাইসেন্স হালকা না ভারী তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ হালকা লাইসেন্স থাকলে এসব রুটে ভারী গাড়ি চালানোর কোনো সুযোগ নেই। যেটা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।

আরও পড়ুন: বাস পুকুরে পড়ে ১৭ মৃত্যু: ৩৭ ঘণ্টা পর পুলিশের মামলা

তার মতে, অবশ্যই এ দুর্ঘটনার দায় কারও না কারও নিতে হবে। দায় ছাড়া এতো বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে না। চালকের ভারী যান চালানোর যোগ্যতা আছে কিনা সেটাই এখন বিবেচনার বিষয়।

চালক মোহনের ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় তাকে দিয়ে গাড়ি না চালাতে ঝালকাঠি বাস মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল কি না এ বিষয়ে নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমার জানা নেই।

বিআরটিএ ঝালকাঠি-পিরোজপুর জোনের সহকারী পরিচালক ও জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটির সদস্য মাহাবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, এরই মধ্যে তদন্তের স্বার্থে ঘটনাস্থল পরিদর্শন, দুর্ঘটনায় আহত, ঘটনাস্থলের লোকজন এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলেছি।

চালক মোহনের লাইসেন্স ছিল কি না এ বিষয়ে তিনি বলেন, ২০২০ সালে ইস্যু করা হালকা মোটরযান চালানোর লাইসেন্স ছিল তার। বরিশাল থেকে ইস্যু করা প্রাথমিক ড্রাইভিং লাইসেন্স এটি। তিনবছর পার হলে ভারী লাইসেন্স পাওয়ার কথা ছিল তার। এরপর তিনি বাস চালাতে পারতেন।

যাত্রীদের বরাত দিয়ে বিআরটিএ কর্মকর্তা জানান, বাসটির ছাদে ও ভেতরে অতিরিক্ত যাত্রী থাকার কথা জানিয়েছে তারা। ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা অতিরিক্ত যাত্রীর সঙ্গে হেলপারের কথা কাটাকাটি হয়। এ সময় গাড়ির গতি একটু বেশি থাকায় হেলপারের সঙ্গে চালকও বাঁদিকে তাকিয়ে যাত্রীদের কথার জবাব দেয়। তখন গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুকুরে পড়ে।

এদিকে বাস দুর্ঘটনার বিষয়ে নিহতদের পরিবার কিংবা স্বজন এবং আহতরা কোনো অভিযোগ না করায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে।

এ বিষয়ে ঝালকাঠি পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল জাগো নিউজকে বলেন, বাস দুর্ঘটনার বিষয়ে এতো প্রাণহানি ঘটলেও নিহতদের পরিবার এবং আহতদের কোনো অভিযোগ নেই। ঘটনার পর থেকে বাসচালক মোহন, হেলপার আশিক ওরফে বুলেট ও সুপারভাইজার রাজাপুরের মিজান পলাতক আছেন। এদের আসামি করে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

গেলো ২২ জুলাই সকালে সদর উপজেলার ছত্রকান্দা এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদের ভবনের সামনে একটি যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুকুরে পড়ে ১৭ জন নিহত হন। জীবিত ২৩ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়।

এসজে/জেআইএম