শেষ চার বছরের মধ্যে একবারও ২ শতাংশের বেশি লভ্যাংশ দিতে পারেনি ফু-ওয়াং ফুড। শেয়ারের ক্রেতা না থাকায় দিনের পর দিন আটকে ছিল ফ্লোর প্রাইসে (সর্বনিম্ন দাম)। সেই কোম্পানিটির শেয়ার দাম সম্প্রতি লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। মাত্র ১০ কার্যদিবসেই শেয়ার দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।
Advertisement
গত ২ জুলাই কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ২৩ টাকা ৫০ পয়সা। সেখান থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বেড়ে ১৬ জুলাই লেনদেন শেষে প্রতিটি শেয়ারের দাম দাঁড়ায় ৪৩ টাকা ৫০ পয়সা। অর্থাৎ, অর্ধ মাসের মধ্যে কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়েছে ৮৫ শতাংশ।
অন্যভাবে বলা যায়, যদি কোনো বিনিয়োগকারী ২ জুলাই কোম্পানিটির ১০ লাখ টাকার শেয়ার কেনেন, সেই শেয়ার ১৬ জুলাই বিক্রি করলে লাভ পেয়েছেন ৮ লাখ ৫১ হাজার টাকা। এ যেন রীতিমতো টাকা বানানোর মেশিন!
আরও পড়ুন>> শেয়ারবাজারের গলার কাঁটা ফ্লোর প্রাইস
Advertisement
শুধু ফু-ওয়াং ফুড নয়, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। এমন আরেকটি কোম্পানি খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ। গত ১২ জুন এ কোম্পানিটির শেয়ার দাম ছিল ১৩ টাকা ৮০ পয়সা। সেখান থেকে লাফিযে লাফিয়ে বেড়ে ১৮ জুলাই লেনদেন শেষে দাঁড়ায় ৩৮ টাকা ৯০ পয়সা।
অর্থাৎ, এক মাসের কিছু বেশি সময়ে কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়েছে ১৮২ শতাংশ। অন্যভাবে বলা যায়, কোনো বিনিয়োগকারী ১২ জুন কোম্পানিটির ১০ লাখ টাকার শেয়ার কেনেন, সেই শেয়ার ১৮ জুলাই বিক্রি করলে লাভ পেয়েছেন ১৮ লাখ ১৮ হাজার টাকা। অর্থাৎ, মাত্র এক মাসে বিনিয়োগ করা টাকা প্রায় তিনগুণ হয়ে গেছে।
শেয়ারের এমন দাম বাড়া কোম্পানিটি সবশেষ ২০২২ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত বছরে বিনিয়োগকারীদের ২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। তার আগে ২০২১ সালে কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। আর ২০২০ ও ২০১৮ সালে ২ শতাংশ করে নগদ লভ্যাংশ দেয়। ২০১৯ সালে কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। অর্থাৎ, কোম্পানিটির লভ্যাংশ ইতিহাস খুব একটা ভালো নয়।
লোকসানে পড়ে ২০২০ সালের পর বিনিয়োগকারীদের কোনো ধরনের লভ্যাংশ দেয়নি খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং। সবশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোম্পানিটি লোকসানের মধ্যেই রয়েছে। ২০২২ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি লোকসান করেছে ১১ পয়সা।
Advertisement
এ কোম্পানিটির শেয়ার দামও সম্প্রতি অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। গত ৬ জুন কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিল ৯ টাকা ৪০ পয়সা। সেখান থেকে দাম বেড়ে ১৯ জুলাই লেনদেন শেষে ১৫ টাকা ২০ পয়সা হয়। অর্থাৎ, দেড় মাসে কোম্পানিটির শেয়ার দাম বেড়েছে ৬২ শতাংশ।
এ কোম্পানিগুলোর শেয়ারের এমন দাম বাড়াকে অস্বাভাবিক বলছে খোদ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ। এজন্য বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করে সতর্কবার্তাও প্রকাশ করেছে ডিএসই। তাতেও কোম্পানিগুলোর শেয়ার দাম বাড়ার প্রবণতা থামানো যায়নি।
অবশ্য অস্বাভাবিক দাম বাড়ার পর এক পর্যায়ে দাম কমেছে। সবশেষ কার্যদিবসে অর্থাৎ, ২০ জুলাই এই তিনটি কোম্পানিরই শেয়ার দাম কমেছে। এর মধ্যে ফু-ওয়াং ফুডের ৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের ৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগের ২ দশমিক ৭০ শতাংশ দাম কমেছে।
এর আগে এমারেল্ড অয়েল, লিগ্যাসি ফুটওয়্যার, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, ওরিয়ন ইনফিউশন, সি পার্ল বিচ রিসোর্ট, জেমিনি সি ফুড, রূপালী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, এডিএন টেলিকম, প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ঢাকা ইন্স্যুরেন্স, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার, অ্যাপেক্স ফুড, ন্যাশনাল টিসহ আরও কয়েকটি কোম্পানির শেয়ার দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বড় চমক দেখায় দুর্বল আর্থিক সক্ষমতার কোম্পানি এমারেল্ড অয়েল। ৩০ টাকা ৮০ পয়সা থেকে দফায় দফায় দাম বেড়ে কোম্পানিটির শেয়ার দাম ১৮২ টাকা ৫০ পয়সায় ওঠে। অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দাম ৪৯৩ শতাংশ বাড়ে। এই অস্বাভাবিক দাম বাড়ার পর কিছুটা মূল্য সংশোধন হলেও এখন আবার দাম বাড়তে দেখা যাচ্ছে। শেষ দুই কার্যদিবসে শেয়ার দাম ৯ শতাংশ বেড়েছে।
আরও পড়ুন>> দাপট দেখাল দুর্বল কোম্পানি
শেয়ারের এমন দাম বাড়া কোম্পানিটি সবশেষ ২০২৩ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত আর্থিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বিনিয়োগকারীদের (উদ্যোক্তা ও পরিচালক বাদে) ৫ শতাংশ অন্তর্বর্তী লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। একই সঙ্গে ২০২২ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত বছরেও উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের বাদ দিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে।
মূলত এ লভ্যাংশ ঘোষণাকে কেন্দ্র করেই কোম্পানিটির শেয়ার দাম এমন অস্বাভাবিক বাড়ে। তার আগে লোকসানে পড়ে ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি কোম্পানিটি।
এভাবে একের পর এক দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দাম বাড়লেও মাসের পর মাস ধরে ফ্লোর প্রাইসে আটকে রয়েছে অথবা ফ্লোর প্রাইসের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে মৌলভিত্তিসম্পন্ন বা ব্লুচিপ কোম্পানি। শক্তিশালী আর্থিক অবস্থার পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠান প্রতিবছর আকর্ষণীয় লভ্যাংশ দেওয়ার পরও বিনিয়োগকারীদের যেন আকৃষ্ট করতে পারছে না। অনেকটা শীতঘুমের মতো অবস্থা এসব প্রতিষ্ঠানের।
ব্লুচিপ বা মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ার দাম একই জায়গায় পড়ে থাকলেও দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়াকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বাজারে বিনিয়োগের স্বাভাবিক পরিবেশ নেই। প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। গুটিকয়েক বিনিয়োগকারী বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দাম বাড়াচ্ছেন।
তারা বলছেন, সম্প্রতি কিছু দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দাম যে হারে বেড়েছে, তাতে খালি চোখেই বোঝা যাচ্ছে কোনো বিশেষ চক্র এই দাম বাড়ানোর পেছনে রয়েছে। বিশেষ চক্রের ভূমিকা ছাড়া কোনোভাবেই হঠাৎ একটি কোম্পানির শেয়ার দাম দ্বিগুণ-তিনগুণ হওয়া সম্ভব নয়।
তারা আরও বলছেন, এসব চক্র সম্প্রতি বেশ বেপরোয়া হয়ে কিছু কিছু কোম্পানির শেয়ার দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়েছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান তেমন কঠোর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যাচ্ছে না। বরং নিয়ন্ত্রক সংস্থার বেঁধে দেওয়া ফ্লোর প্রাইস (সর্বনিম্ন দাম) এই চক্রকে আরও সহায়তা করছে। এতে বাজারে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কারসাজি চক্র। এখন বাজারে কোনো শেয়ারের দাম বাড়া বা কমা এই চক্রের ইশারায়ই হচ্ছে।
ডিএসইর এক সদস্য বলেন, শেয়ারবাজার এখন বিশেষ চক্র দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এই চক্র একেক সময় একেকটি কোম্পানির শেয়ার দাম বাড়াচ্ছে। ভালো কোম্পানির শেয়ার দীর্ঘদিন ধরে লেনদেন না হওয়ায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও কারসাজির শেয়ারে বিনিয়োগ করছেন। এর সবকিছু হচ্ছে ফ্লোর প্রাইসের কারণে। ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়া হলে বাজারে কারসাজি কিছুটা হলেও কমবে। তখন বিনিয়োগের অনেক অপশন সৃষ্টি হবে। কিন্তু ফ্লোর প্রাইসের কারণে এখন গুটিকয়েক কোম্পানি নিয়ে খেলা হচ্ছে। এতে বাজারের স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, শেয়ারবাজার এখন জুয়াড়ি দিয়ে চলছে। জুয়াড়িরা বাজারে চাহিদা সৃষ্টি করছে। চাহিদা সৃষ্টির কারণেই ৩৩ টাকা থেকে এমারেল্ড অয়েল ১৮০ টাকা হয়েছে। কারা এটা করেছে? ওরাই (জুয়াড়ি) করেছে। শেয়ারবাজার নরমাল (স্বাভাবিক) চলছে না, এটা অ্যাবনরমাল (অস্বাভাবিক) মার্কেট। জুয়াড়ি দিয়ে এ বাজার চলছে।
আরও পড়ুন>> ভালো নেই আর্থিক খাত
তিনি বলেন, সবকিছু হচ্ছে ফ্লোর প্রাইসের কারণে। ড. ফরাসউদ্দিন উনি তো আওয়ামী লীগের লোক, উনিও ফ্লোর প্রাইসের বিপক্ষে বলেছেন। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) প্রশ্ন করা উচিত ফ্লোর প্রাইস ওঠানো হবে কবে। ব্লুচিপ বাদ দিয়ে জুয়াড়িরা দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দাম বাড়াচ্ছে, এ বিষয়ে বিএসইসি কী বলে প্রশ্ন করা উচিত। আমি রেগুলেটর হলে একদিনে ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে দিতাম।
তিনি আরও বলেন, এখন পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে ওনাদের কাছে (নিয়ন্ত্রক সংস্থা) কারসাজিকারীরাই প্রিয়। শেয়ারবাজারের আসল রোগ ফ্লোর প্রাইস। ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে। বিনিয়োগকারীরা ব্লুচিপের দিকে যাবে। বিএসইসির চেয়ারম্যান বক্তব্য দিয়েছেন- বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে ফ্লোর প্রাইস দেওয়া হয়েছে। বিনিয়োগকারীদের ক্যাপিটাল কীভাবে রক্ষা করা হচ্ছে? কেউ বিক্রি করতে পারে না। ব্লুচিপ নিয়ে বসে আছে। এটা কোনো মার্কেট হলো?
একদিকে দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দাম বাড়ছে, অন্যদিকে ব্লুচিপ কোম্পানির শেয়ার দাম ফ্লোর প্রাইস বা ফ্লোর প্রাইসের আশপাশে আটকে রয়েছে। বাজারের এ পরিস্থিতিকে কীভাবে দেখছেন? এমন প্রশ্ন রাখা হলে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, বাজারে যদি এক বছর ধরে ফ্লোর প্রাইস থাকে, তাহলে বাজারের স্বাভাবিক পরিবেশ থাকতে পারে? এখন যেটা হচ্ছে জাঙ্ক শেয়ার কেনা-বেচা হচ্ছে এবং এগুলো নিয়ে নানা ধরনের ম্যানিপুলেশন (কারসাজি) হচ্ছে। আর ভালো শেয়ারগুলো দীর্ঘদিন ধরে লেনদেন বন্ধ আছে, ফ্লোর প্রাইসের কারণে।
তিনি বলেন, কিছু কোম্পানির শেয়ার দ্বিগুণ, তিনগুণ হয়ে যাচ্ছে, এটা ম্যানিপুলেশনের কারণে। ফ্লোর প্রাইস দিয়ে কারসাজি চক্রকে আরও সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। এটা কোনো বাজার নয়। যেখানে এক বছর ধরে ভালো কোম্পানিগুলোর লেনদেন বন্ধ থাকে।
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, যেসব জাঙ্ক শেয়ারের দাম সম্প্রতি বেড়েছে, সেগুলো আমরা নজরদারিতে রেখেছি। কোনো শেয়ার নিয়ে কারসাজি হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে কমিশন সব সময় সজাগ নজর রেখেছে। কারসাজির খবর পাওয়া গেলে তদন্তের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জকে (ডিএসই) খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগের বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে পরবর্তীসময়ে আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ফ্লোর প্রাইস নিয়ে নতুন কোনো পরিকল্পনা আছে কি না? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, চেয়ারম্যানের বক্তব্য হলো বাজারের সুস্বাস্থ্য ফিরে না আসা পর্যন্ত ফ্লোর প্রাইস থাকবে। ফ্লোর প্রাইস চিরস্থায়ী নয়, তবে বাজারের পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতে কমিশন ব্যবস্থা নেবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ফ্লোর প্রাইসের বিষয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
এমএএস/এএসএ/এমএস