# ফিল্ড হাসপাতালের দাবিতে জনসভা করেছে জুরাইনবাসী# যাত্রাবাড়ী ও মুগদা থানা এলাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ
Advertisement
রাজধানীসহ সারাদেশে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু সংক্রমণ পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় প্রকট আকার ধারণ করছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। ঢাকার ভেতরে জুরাইন এলাকায় ভয়াবহ রূপ নিয়েছে ডেঙ্গু। এখন জুরাইন এলাকায় ঘরে ঘরে ডেঙ্গুরোগী।
স্থানীয়দের দাবি, এরই মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে অন্তত তিনজন মারা গেছেন। এছাড়া বাসা ও হাসপাতালে হাজারও রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন।
জুরাইনবাসী জানান, ডেঙ্গু আক্রান্তদের বেশিরভাগ নিম্ন আয়ের। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাওয়ার আগে সরকারিভাবে ফিল্ড হাসপাতাল (অস্থায়ী হাসপাতাল) খুলে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করার দাবি জানান তারা।
Advertisement
আরও পড়ুন>> ডেঙ্গুর চিকিৎসা খরচ জোগাতে নাভিশ্বাস নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারে
এ দাবি আদায়ে সম্প্রতি জনসভা করেছেন রাজধানীর পূর্ব জুরাইনবাসী। তাদের অভিযোগ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ‘চরম অবহেলায়’ তাদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ২০২১ সালেও জুরাইনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছে। চলতি বছরের শুরুতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তাতে এবারের পরিস্থিতি আগের চেয়েও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
রাজধানীর জুরাইন, যাত্রাবাড়ী ও মুগদা থানা এলাকায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ বলে জানিয়েছে ডিএসসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ। এ বিভাগের সংশ্লিষ্টদের দাবি, যাত্রাবাড়ী ও মুগদায় ডেঙ্গুর ভয়াবহ পরিস্থিতি সম্পর্কে তারাও অবগত। সে অনুযায়ী এডিস মশার লার্ভা ধ্বংসে কাজ করছেন। এডিস মশানিধনে স্থানীয়দেরও সচেতন হতে হবে। তবে, স্থানীয়দের অভিযোগ, সিটি করপোরেশনের কোনো উদ্যোগই কাজে আসছে না। প্রতিদিনই নতুন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।
আরও পড়ুন>> ডেঙ্গুতে ১১ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ২২৪২
Advertisement
এদিকে ডেঙ্গুর এমন পরিস্থিতির মধ্যে সম্প্রতি সপরিবারে বিদেশ ভ্রমণে গেছেন ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। এমন পরিস্থিতিতে তার বিদেশ সফর নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই সমালোচনা করছেন।
তবে, মশকনিধন কার্যক্রমে ডিএসসিসির কোনো ঘাটতি নেই বলে জানিয়েছেন দক্ষিণ সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. ফজলে শামসুল কবির। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আগে সাধারণত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ঘটতো। কিন্তু এখন সারা বছরই এডিস মশা বংশ বিস্তার করছে। সারা বছরই কেউ না কেউ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে এডিস মশার লার্ভা নিধনে কার্যক্রম শুরু করেছে ডিএসসিসি। এরই মধ্যে এপ্রিলে যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় ডেঙ্গুর উপদ্রব শুরু হয়। তারপর জুরাইন ও মুগদায়।
আরও পড়ুন>> মশা নিধন বরাদ্দে আছে, প্রয়োগে নেই
তিনি বলেন, গত জুনের মাঝামাঝি সময় থেকে এ তিন এলাকায় ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নেয়। তখন থেকে মশার লার্ভা নিধনে টানা অভিযান শুরু করে ডিএসসিসি। ফলে, গত এক মাস আগের তুলনায় এডিস মশার উপদ্রব কিছুটা কমেছে।
জুরাইন এলাকার ডেঙ্গু পরিস্থিতি২০২১ সালে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে করা এক গবেষণায় দেখানো হয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটির মধ্যে সবচেয়ে বেশি গরিব মানুষ থাকে জুরাইন এলাকায়। এ এলাকায় বসবাসের স্থান, সুপেয় পানি, গোসলের জন্য সার্বক্ষণিক পানির সুবিধা, শৌচাগারের ব্যবস্থা, জমি ভোগদখলের নিরাপত্তা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ–সংযোগ, সড়ক ও ড্রেনের (নালা) সুবিধাসহ ১৬ ধরনের নাগরিক সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে দক্ষিণ সিটির ৭৫টি ওয়ার্ডের ওপর এ গবেষণা করা হয়।
গত ১৮ জুলাই সরেজমিনে দেখা যায়, সড়ক উঁচু করায় পূর্ব জুরাইনের বেশিরভাগ ভবনের নিচতলার অবস্থান এখন রাস্তার উচ্চতা থেকে নিচে। এতে অনেক ভবনের নিচতলা ব্যবহারের অনুপযোগী, পানি জমে থাকছে। এছাড়া এ এলাকায় প্রচুর পরিত্যক্ত ভবন থাকায় এডিস মশা ব্যাপক হারে বংশবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। অন্য এলাকার তুলনায় নিচু হওয়ায় বছরের প্রায় সবসময় পানি জমে থাকে। তাই মশার বংশ বৃদ্ধি বেশি ঘটছে। এছাড়া এ বছর এলাকার ড্রেন-নালায়ও মশার প্রচুর লার্ভা দেখা গেছে।
আরও পড়ুন>> ঢাকার দুই মেয়রের পদত্যাগ দাবি তাবিথ-ইশরাকের
স্থানীয়দের অভিযোগ, আগে বৃষ্টি হলেই জুরাইনে হাঁটু থেকে কোমর পরিমাণ পানি জমে যেত। জলাবদ্ধতার কারণে মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারতেন না। চার-পাঁচ বছর আগে জলাবদ্ধতা নিরসনে সব রাস্তা চার থেকে পাঁচ ফুট উঁচু করে নির্মাণ করা হয়। ফলে বেশিরভাগ ভবনের নিচতলার অবস্থান এখন রাস্তার উচ্চতা থেকে নিচে। দু’পাশের বাসাবাড়ির নিচতলা পরিত্যক্ত হতে থাকে। তখন থেকে এ এলাকায় এডিস মশার বিস্তার শুরু হয়। এখন যা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এডিসের মৌসুম আসার আগেই এ এলাকার ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে।
শ্যামপুরের একটি প্লাস্টিক কারখানায় মাসে ৯ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন আমেনা বেগম। স্কুলপড়ুয়া দুই ছেলে-মেয়ে এবং রিকশাচালক স্বামীকে নিয়ে থাকেন পূর্ব জুরাইনের একটি ভাড়া বাসায়। ১৮ জুলাই (মঙ্গলবার) ভোরে আমেনা বেগমের তীব্র জ্বর আসে, সঙ্গে মাথাব্যথা। সন্দেহ হলে ওই দিন সকালেই ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য যান মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরীক্ষায় তার ডেঙ্গুর জীবাণু ধরা পড়ে। চিকিৎসা নিতে ভর্তি হন হাসপাতালে। একইভাবে পরদিন তার মেয়ের (৯) জ্বর আসে। রক্ত পরীক্ষায় তার ডেঙ্গুর জীবাণু ধরা পড়ে। এখন মা-মেয়ে দুজনেই মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি।
আরও পড়ুন>> ডেঙ্গুতে একদিনে রেকর্ড ১৯ জনের মৃত্যু
আমেনা বেগমের স্বামী আবুল হোসেন বলেন, এবার বর্ষা মৌসুম শুরুর দুই-তিন মাস আগ থেকেই জুরাইনে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। তারা যে বাড়িতে ভাড়া থাকেন, চারতলার ওই বাড়ির আরও চারজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। তাই জ্বর আসার শুরুতেই স্ত্রীকে হাসপাতালে পরীক্ষা করিয়েছি। এখন মেয়েসহ হাসপাতালে তারা চিকিৎসা নিচ্ছেন।
তিনি বলেন, দেশে করোনা আসার পর মানুষের মধ্যে যে ধরনের আতঙ্ক ছিল, এখন জুরাইনবাসীর মনে ডেঙ্গু নিয়ে তেমন আতঙ্ক কাজ করছে। কিন্তু মশার লার্ভা নিধনে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম চোখে পড়ছে না। উল্টো সিটি করপোরেশনের ড্রেন-নালায় মশার প্রাদুর্ভাব বাড়ছে।
জুরাইন এলাকায় জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট নাগরিক আন্দোলনে যুক্ত মিজানুর রহমান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ডেঙ্গুতে আতঙ্কিত-বিপর্যস্ত জুরাইন ও আশপাশের এলাকার লাখ লাখ মানুষ। এই এলাকায় প্রান্তিক শ্রেণির মানুষের বসবাস বেশি। তাদের অনেকেই জমানো টাকা, ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি, ঋণ এবং মানুষের কাছ থেকে ধার নিয়ে প্রিয়জনকে ডেঙ্গুর চিকিৎসা করাচ্ছেন। আমরা আর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এবং মৃত্যু চাই না। তাই গত ১৪ জুলাই জুরাইনে সরকারিভাবে অস্থায়ী হাসপাতাল খুলে বিনামূল্যে রক্ত পরীক্ষা ও ডেঙ্গু চিকিৎসা শুরু করা এবং এডিস মশা নির্মূলে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে জনসভা করেছি।
জুরাইন ডেঙ্গুর জন্য খুবই বিপজ্জনক এলাকা উল্লেখ করে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবির বলেন, জুরাইনের অধিকাংশ বাসাবাড়ি সড়ক থেকে চার-পাঁচ ফুট করে নিচে। ফলে নিচতলার বেশিরভাগ ফ্ল্যাট পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। এখন সেখানে জমে থাকা পানিতে এডিস মশা বংশ বিস্তার করছে। বাড়ির মালিক ও স্থানীয়দের সচেতনতা ছাড়া এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
যাত্রাবাড়ী-মুগদা এলাকাটানা আটদিন যাত্রাবাড়ীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বুধবার (১৯ জুলাই) বাসায় ফেরে পাঁচ বছরের শিশু তানিয়া আক্তার। আলাপকালে তানিয়ার বাবা বেসরকারি চাকরিজীবী আকিদুল ইসলাম বলেন, বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকেই যাত্রাবাড়ীতে মশার উপদ্রব বেড়েছে। তাই বাসায় ঘুমানোর সময় মশারি টাঙিয়ে ঘুমাই। কিন্তু তারপরও মশার কামড়ে মেয়ের জ্বর এলো। মেয়ের চিকিৎসার জন্য প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
গত ১৮ জুলাই মুগদা জেনারেল হাসপাতালের দশতলায় ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে ভর্তি হয়েছেন মুগদার ওয়াবদা গলির বাসিন্দা মাকসুদ হোসেন। আলাপকালে তিনি বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর দেখি মহল্লার অনেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি আগে কখনো দেখিনি। অথচ সিটি করপোরেশনের লোকজনকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ওষুধ ছিটাতে দেখা যায় না।
যাত্রাবাড়ী এবং মুগদা এলাকাটি ডিএসসিসির অঞ্চল-৫ এর আওতাধীন। এ অঞ্চল থেকেই এসব এলাকায় মশার ওষুধ ছিটানোসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। জানতে চাইলে অঞ্চল-৫ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন সরকার বলেন, মশা নিধনে প্রতিদিন সকালে লার্ভিসাইড ছিটানো হচ্ছে, বিকেলে ফগিং করা হচ্ছে। এছাড়া মশা নিধনে প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। নিজ আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে নাগরিকদের সচেতন এবং জরিমানা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, শুক্রবার (২১ জুলাই) সকাল ৮টা থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২২৪২ জন। এ সময়ে ডেঙ্গু জ্বরে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩০ হাজার ৬৮৫ জন। মারা গেছেন ১৬৭ জন।
এমএমএ/এমএএইচ/এমএস