বিনোদন

হুমায়ূন স্যার আমাকে প্রথম মোবাইল কিনে দিয়েছিলেন: ডা. এজাজ

বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি লেখক হুমায়ূন আহমেদ। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি তিনি নাট্যকার ও নির্মাতা হিসেবেও তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। বহুমাত্রিক গুণের এ কথাসাহিত্যিকের অধিকাংশ নাটক, টেলিছবি ও সিনেমায় অভিনয় করেছেন অভিনেতা ডা. এজাজ। হুমায়ূন আহমেদের এবারের প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে জাগো নিউজের বিশেষ আয়োজন জাগো তারকায় অতিথি হয়ে এসেছিলেন তিনি। নন্দিত এ ঔপন্যাসিকের সঙ্গে স্মৃতিচারণসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. এজাজ-

Advertisement

আরও পড়ুন: নিজ হাতে স্যারকে সমাহিত করেছি: ডা. এজাজ

জাগো নিউজ: শুরুতেই জানতে চাইবো হুমায়ূন আহমেদের অনেকগুলো নাটক, সিনেমায় আপনি অভিনয় করেছেন, আপনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

ডা. এজাজ: অবশ্যই অনেক অনেক সুন্দর অভিজ্ঞতা ছিল। এসব অভিজ্ঞতার কথা এ অল্প সময়ের আলোচনায় বলে শেষ করা যাবে না।

Advertisement

জাগো নিউজ: আপনার অভিনয় জগতে পা রাখার শুরুটা হুমায়ূন আহমেদকে দিয়ে। আপনার মাঝে হুমায়ূন আহমেদের যে ঘোর ছিল সেটা কি এখনো আছে? নাকি ঘোর কেটে গেছে?

ডা. এজাজ: আমি এখনো সেই ঘোরের মধ্যেই আছি। আমার পরিবারের বাইরে যিনি আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন তিনি হলেন স্যার (হুমায়ূন আহমেদ)। বাবা সন্তানকে যেমন ভালোবাসেন আবার সন্তান যেমন বাবাকে ভালোবাসে ঠিক তেমন।

জাগো নিউজ: হুমায়ূন আহমেদের কোন দিকটি আপনাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছে?

ডা. এজাজ: মানুষ হুমায়ূন আহমেদকে বেশি আকৃষ্ট করেছে। তার সব কিছুই আমার ভালো লেগেছে।

Advertisement

জাগো নিউজ: হুমায়ুন আহমেদের সঙ্গে অনেকেই কাজ করেছেন, কিন্তু আপনি তার এতো প্রিয় কেন?

ডা. এজাজ: এটা আমিও জানি না। স্যারের প্রতি আমার যে ভক্তি, শ্রদ্ধা সেটা থেকেই হয়তো এমনটা হতো। আমার জীবনের প্রথম মোবাইল স্যার আমাকে গিফট করেছিলেন।

আরও পড়ুন: অভিনয় শিল্পীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেবেন ডা. এজাজ

জাগো নিউজ: আপনি একজন চিকিৎসক। হঠাৎ করে আপনি অভিনয় জগতে কেন আসলেন?

ডা. এজাজ: অভিনয় অনেক আগে থেকেই করতাম। রংপুর মেডিকেল কলেজে যখন পড়তাম তখনই আমি রংপুর রেডিওতে খবর পড়তাম, তালিকাভুক্ত নাট্যশিল্পী ছিলাম। বিসিএস থেকে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করলাম। পোস্টিংয়ের সময় অনেক চেষ্টা করে গাজীপুরে পোস্টিং নিলাম। কারণ গাজীপুর থেকে যেন খুব সহজে ঢাকায় এসে অভিনয় করতে পারি। এরপর টেলিভিশনে নাটক করার জন্য চেষ্টা করতে লাগলাম। তখন গাজীপুরে একটা নাট্যগোষ্ঠী ছিল। তার যে কর্মকর্তা ছিলেন তাকে বললাম কীভাবে টেলিভিশনে ঢোকা যায়। তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন। এরপর অডিশন দিয়ে সিলেক্ট হয়েছিলাম কিন্তু আমাকে আর ডাকলেন না। খুব কষ্ট পেয়ে অভিনয় ছেড়ে দিলাম। এরপর টেলিভিশনের চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমি পোস্ট গ্রাজুয়েশনে ভর্তি হলাম এবং লেখাপড়ায় মনোযোগ দেওয়া শুরু করি এরপর স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয় এবং নতুন করে অভিনয় শুরু করেছিলাম।

জাগো নিউজ: একজন পরিপূর্ণ সৃষ্টিশীল মানুষ হুমায়ূন আহমেদ। তার জীবন দর্শন থেকে আপনি কতটা প্রভাবিত হয়েছেন?

ডা. এজাজ: স্যারের গুণ তো কিছুই পাইনি। স্যারের কিছু কথা সব সময়ই মেনে চলার চেষ্টা করেছি। সিনসিয়ারিটির জন্য স্যার আমাকে পছন্দ করতেন। আমার পরিবার কষ্ট পেলেও আমি স্যারকে কষ্ট পেতে দেইনি। এদিকটাতেই আমার জীবন স্যারের দ্বারা কিছুটা প্রভাবিত হয়েছে।

জাগো নিউজ: কিংবদন্তি হুমায়ূন আহমেদ যেদিন অনন্তলোকে পাড়ি জমিয়েছিলেন। সেই দিনের মৃত্যুর খবর শোনার সেই মুহূর্ত যদি শেয়ার করতেন।

ডা. এজাজ: যেদিন আমি শুনেছিলাম যে স্যারের ক্যানসার, সেদিনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম তিনি আর বাঁচবেন না। নুহাশপল্লির যে জায়গায় স্যার প্রথম রাতযাপন করেছিলেন ঠিক সেই জায়গায়ই স্যারের কবর। আমিই প্রথম কবরের মাটি খুঁড়েছিলাম এরপর অন্যরা।

জাগো নিউজ: হুমায়ূন আহমেদ কি তার মৃত্যু নিয়ে আপনাকে কিছু শেয়ার করেছিলেন?

ডা. এজাজ: মৃত্যু নিয়ে অনেক কিছুই শেয়ার করেছিলেন। নুহাশপল্লিতে একবার শুটিং বিরতির সময় স্যার পুকুরের পাশ দিয়ে হাঁটছিলেন। হঠাৎ করেই পেছনে তাকিয়ে দেখলেন আমি। আমাকে স্যার বলেছিলেন, ডাক্তার এই পুকুরের চারপাশে সুপারি গাছগুলো যখন অনেক বড় হবে তখন কি সুন্দর লাগবে ভাবতে পারছো? আমি বলেছিলাম জ্বী স্যার খুব সুন্দর লাগবে। হঠাৎ করেই স্যারের মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। চুপ করে থেকে বলেছিল, আমি তখন থাকবো না! স্যার তার মৃত্যুকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। মৃত্যু তার কাছে খুব কষ্টের আর নিকৃষ্ট একটি বিষয় ছিল।

জাগো নিউজ: হুমায়ূন আহমেদ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিক মানের একটি ক্যানসার হাসপাতাল বানানো হোক এমনটাই চেয়েছিলেন। আপনি স্যারের প্রিয় একজন মানুষ। আপনি কি কোনো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন?

ডা. এজাজ: আমি পরিকল্পনা করেছিলাম টেকনাফ থেকে শুরু করে সারাদেশে একটি পিকআপ নিয়ে সামনে ব্যানার টানিয়ে ক্যানসার হাসপাতাল তৈরির জন্য অর্থ সংগ্রহ করবো। এমনটা স্যারকে যখন জানানো হয় তখন স্যার চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় ছিলেন। স্যার বলেছিলেন আমি আগে দেশে আসি, ডাক্তারকে থামতে বলো। এরপর তো স্যার আর দেশে ফেরেননি। আমিতো থেমে গেলাম। স্যার বেঁচে থাকলে আমি অবশ্যই স্টেপ নিতাম।

জাগো নিউজ: হুমায়ূন আহমেদের সময়ে আপনারা কয়েকজন মানুষ বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলেন। এখন অনেকেই কাজ কমিয়ে দিয়েছেন। এটা কেন?

ডা. এজাজ: স্যার বেঁচে থাকার সময়ে কাজ যে সংখ্যায় করতাম এখন তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যায় করি। কিন্তু দুঃখের বিষয় কেউ দেখে না। আগে স্যারের সময়ে বছরে তিনটা নাটক করতাম। আর সারা বছর সেই নাটকের প্রশংসায় ভাসতাম। এখন অনেক চ্যানেলে অনেক নাটক হয় আমার। দেখার সময় নেই।

জাগো নিউজ: আগের তুলনায় এখনকার নাটকগুলো কেন ভালো হচ্ছে না?

ডা. এজাজ: ভালো হচ্ছে না এটা ঠিক নয়। ভালো হচ্ছে। কিন্তু হুমায়ূন স্যারের নাটক হচ্ছে অমর। স্যারের প্রতিটি কাজ হচ্ছে চিরন্তন সত্য৷ আগামী ১০০ বছরেও স্যারের কাজ পুরোনো হবে না।

জাগো নিউজ: সম্প্রতি কিছু খণ্ড খণ্ড নাটক আপনি ইউটিউব ও ফেসবুকে প্রকাশ করেছেন। কেমন সাড়া পাচ্ছেন?

ডা. এজাজ: খণ্ড নাটকগুলো খুব ভালো লাগে আমার নিজের কাছে। এগুলো নিজে লিখি, নিজে বানাই। অনেকে এগুলো নিয়ে দারুণ দারুণ মন্তব্য করেন, শুনে ভালো লাগে।

জাগো নিউজ: আপনাকে অনেকে গরিবের ডাক্তার বলে, এতে আপনার কেমন লাগে?

ডা. এজাজ: আমার খুব ভালো লাগে। প্রমোশন হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হওয়ার পর আমার কলিগরা (সহকর্মীরা) বিরক্ত আমার ওপর। ৩০০ টাকা ভিজিট এটা কেমন হয়, তারা বলেন। তাদের প্রেসারে একদিন ৫০০ টাকা ভিজিট নিয়েছিলাম। এরপর বলেছি ৩০০ টাকাই ভিজিট থাকবে সারাজীবন। যে যা বলার বলুক। আমার কাছে ভীষণ খারাপ লাগে। দূর-দূরান্ত থেকে আমার কাছে রোগী আসে। রোগী দেখার ফি কম বলে অনেকের অনেক অভিযোগ। অনেকে মনে করে ‘৩০০ টাকার ডাক্তার’। তবে যে যাই ভাবুক আমি আজীবন ৩০০ টাকাই রাখবো। ১০ দিন শুটিংয়ের জন্য রাখি আর ২০ দিন চেম্বার করি।

জাগো নিউজ: সম্প্রতি কি কাজ করছেন?

ডা. এজাজ: এখন করছি আলহাজেনের একটি সিরিয়াল ‘গোলমাল’, সনজিত সরকারের একটি সিরিয়াল ‘চিটাগাং জ্যান্টেলম্যান’, হানিফ খানের ‘অক্টোপাস’, কায়সার আহম্মেদের একটি সিরিয়াল টোটাল ৪টা সিরিয়াল এখন প্রচার হচ্ছে।

জাগো নিউজ: আপনার পরিবারে কে কে আছে?

ডা. এজাজ: আমার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। বড় মেয়ে ডাক্তার, ছোট মেয়ে ডাক্তার, বড় ছেলে ডাক্তার, ছোট ছেলে ঢাবি থেকে পড়াশোনা শেষ করে স্কলারশিপে ইউকে চলে যাবে। সবাই উচ্চতর ডিগ্রির জন্য পড়াশোনা করছে।

জাগো নিউজ: ছেলেমেয়েরা কেমন সাপোর্ট করে আপনাকে?

ডা. এজাজ: সবাই খুব সাপোর্ট করে। প্রশংসা করে ছেলে-মেয়েরা। শেষে বলবো সবাই প্রার্থনা করবেন স্যারের শেষ ইচ্ছে যেন পূরণ হয়। হুমায়ূন আহমেদ মেমোরিয়াল ক্যানসার হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার যেন প্রতিষ্ঠিত হয়।

এমএমএফ/এএসএম