মতামত

এবারের ডেঙ্গু-নামা

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল) ও ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবর

Advertisement

ইদানীং বাংলাদেশে বাৎসরিক দিনপঞ্জিতে ডেঙ্গু খুব ভালোভাবেই তার জায়গাটা পাকাপোক্ত করে নিয়েছে। ফি বছর বর্ষার শেষে মশারিতে ঢাকা সারি-সারি হাসপাতাল বেডে কাতরাতে থাকা ডেঙ্গু রোগীদের টিভির পর্দায় দেখে আমরা এখন আর কাতর হই না। ডেঙ্গু এখন আমাদের নৈমত্তিক জীবনযাত্রার অংশ। ডেঙ্গুকে বশে আনায় আমরা চেষ্টা-তদ্বিরও কম কিছু করি নাই। কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু হবার নয়।

আমরা কোভিডকে বশে এনেছিলাম ভালো মতনই। আমাদের অঞ্চলে এই বিষয়ে আমরা গোল্ড মেডেলিস্ট আর পৃথিবীব্যাপীও মেরিট লিস্টেই থাকছে আমাদের নাম। তবে ডেঙ্গুর কাছে এসে আমরা কেমন যেন থতমত খেয়ে যাচ্ছি। কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না ডেঙ্গু মশার পাগলা উল্লাস। এখনও ষঢ়ঋতুর বাংলাদেশের ডেঙ্গু মৌসুম শুরু হয়নি। অথচ তাতেই ভাঙছে একের পর এক রেকর্ড। নব্বই দশকের শেষের দিকে এদেশে ডেঙ্গুর রেজোরেকশনের পর, এতদিন পর আজকে এসে আমরা ভেঙ্গেই চলেছি একের পর এক ডেঙ্গুর যত রেকর্ড।

একদিনে সর্বোচ্চ সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী থেকে শুরু করে একদিনে সর্বাধিক মৃত্যু কিংবা হাসপাতালগুলোয় ডেঙ্গু ডেডিকেটেড ওয়ার্ডের পাশাপাশি ডেডিকেটেড ডেঙ্গু হাসপাতাল - এ সবই আমাদের এরই মধ্যে জানা-দেখা হয়ে গেছে। তবে এখনই ঘাবড়ে যাওয়াটা বোধহয় ঠিক হবে না। ডেঙ্গু যেমন কোভিড না, তেমনি এটি আমাদের জন্য নতুন কিছুও না। পত্র-পত্রিকা ঘেটে দেখা যাচ্ছে ২০১৯, ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সালে বাংলাদেশে যথাক্রমে ১,০১,৩৫৪ জন, ১,৪০৫ জন, ২৮,৪২৯ জন এবং ৬২,৩৮২ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল।

Advertisement

তার উপর মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মত এসে হাজির হয়েছে উটকো যত ঝামেলা। ডেঙ্গুবাহী এডিস মশা তার সম্ভ্রান্ত পরিচয়টি পুরোপুরি হারিয়ে বসেছে। এক সময় তিন-চার দিনের বেশি জমে থাকা পানিতে যে এডিস মশার ডিম পারতে রুচিতে বাধতো, সেই এডিসই এখন যত্রতত্র জমে থাকা নোংরা-ময়লা পানিতেও সমানে ডিম পেরে বংশবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

তাছাড়া এ বছর এডিসের কেমন যেন একটা খাই-খাই ভাব! আগে তাওতো জানা ছিল যে এডিস বাড়বে ঘরের কোন এক কোণায় জমে থাকা টলটলে পরিস্কার পানিতে আর মানুষকে কামড়টা দিবে সাঝের বেলায় ইভিনিং ওয়াকে বেড়িয়ে। কিন্তু সে সবই এবছর কেমন যেন আষাঢ়ে গল্প টাইপ হয়ে গেছে। এখন এডিস মশার কামড় খাওয়ার আর কোন টাইম-টেবিল নেই। এডিস যেমন এখন বাড়তে পারে যে কোন জায়গায়, তেমনি সে কামড়টাও বসাতে পারে একদিনের চব্বিশটা ঘন্টার যে কোন সময়েই।

কাজেই বাঁচতে হলে সচেতন হতেই হবে। নিজের উঠান যেমন পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, তেমনি নজর রাখতে হবে নিজ উঠানের আশেপাশের দিকেও। আর শুধু তাতেই মুক্তি।

পাশাপাশি যত দিন গড়াচ্ছে ততই জটিল হচ্ছে ডেঙ্গু রোগ নির্ণয় আর পাশাপাশি বাড়ছে রোগের জটিলতাগুলোও। এতদিন জেনে-শিখে এসেছি এবার যদি ডেঙ্গু হয় তবে ডেঙ্গুর শক সিনড্রোমের ঝুকিটা থাকে পরের বছর কিংবা আরো পরে আবারো ডেঙ্গুর আক্রান্ত হলে। কিন্তু সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। ইদানীং প্রথমবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই দেখা দিচ্ছে এই প্রাণঘাতি সিনড্রমটি। একই সাথে একাধিক স্ট্রেইনের ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণটাই সম্ভবত এ জন্য দায়ী। একটা সময় ছিল যখন এদেশে শুধু ডেঙ্গুর ২ নম্বর সেরোটাইপটাই বেশিরভাগ মানুষের ডেঙ্গুর হওয়ার জন্য দায়ী ছিল। কিন্তু হালের পরিস্থিতি ভিন্ন।

Advertisement

এখন এদেশে ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপই পাওয়া যাচ্ছে আর একই ব্যক্তি একই সময় আক্রান্ত হচ্ছেন একাধিক সেরোটাইপ দিয়েও। শুধু কি তাই? রোগ নির্ণয়টাও ইদানিং যথেষ্টই কঠিন। আগেতো একদিন দুদিন জ্বরের পর ডেঙ্গু এনএসওয়ান এন্টিজেন পরীক্ষা করেই জেনে নেওয়া যেত ডেঙ্গু আক্রান্ত কি না, কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। একই মানুষ একাধিক সেরোটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন বলে রোগ বালাইয়ের বিরুদ্ধে আমাদের শরীরের যে প্রাকৃতিক প্রতিরোধ বা ইমিউনিটি তা প্রায়শঃই বিভ্রান্ত হচ্ছে।

কাজেই ডেঙ্গু এনএসওয়ান এন্টিজেন টেস্টের ফলাফল নেগেটিভ মানেই যে ডেঙ্গু নেই, এই কথা এখন আর জোর গলায় বলা চলছে না। আর ডেঙ্গুর যে এখনও কোনো কার্যকর ওষুধ নেই, যেমন নেই ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ভ্যাকসিনও, এসব কথাতো এখন মহল্লার রকে বসে আড্ডা মারা বখাটেদেরও জানা।

ডেঙ্গুর চিকিৎসায় চিকিৎসকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সরকার যথেষ্টই করছেন। তবে এটি মূলত সরকারী চিকিৎসকদের জন্য। একজন মেডিকেল প্র্যাক্টিশনার হিসাবে মনে হয় এ বিষয়ে আরো কিছু করার সুযোগ রয়ে গেছে। বিশেষ করে বেসরকারী হাসপাতালগুলোয় যে তরুণ চিকিৎসকরা ডেঙ্গুর ঢেউটা সামাল দিচ্ছেন তাদেরও এই প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসাটা জরুরি।

কাজেই এই যখন দশা তখন ডেঙ্গু থেকে পরিত্রাণের উপায় কিন্তু ঐ একটাই আর তা হলো সচেতন হওয়া। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কদিন আগেই মনে করিয়ে দিয়েছেন, সরকারের পক্ষে মানুষের বাসার ভিতরে যেয়ে এডিস মশার বংশ ধ্বংস করা সম্ভব নয়। কোন দেশে কোন সরকার তা করতে পেরেছে এমন নজিরও নেই। আর সত্যি-সত্যি যদি সরকারী লোক ঘরের ভিতরে ঢুকে ডেঙ্গু মশা খুঁজতে চায়, এবার ভাবুন তো আমি-আপনি ওদের আপনার আমার বেডরুম কিংবা বাথরুমের ধারে-কাছেও ঘেঁষতে দিব কিনা। কাজেই বাঁচতে হলে সচেতন হতেই হবে। নিজের উঠান যেমন পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, তেমনি নজর রাখতে হবে নিজ উঠানের আশেপাশের দিকেও। আর শুধু তাতেই মুক্তি।

লেখক দ্বয়: অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশনবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় আঞ্চলিক পরামর্শক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

ডা. শেখ মোহাম্মদ ফজলে আকবরভিজিটিং রিসার্চার, এহিমে ইউনিভার্সিটি, জাপান।

এইচআর/জেআইএম