ডেঙ্গু পরিস্থিতির জটিলতায় মানুষ আতঙ্কিত। ডেঙ্গু জ্বর দেশের প্রায় সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের প্রায় সবকটি শহরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির খবর গণমাধ্যমে উঠে আসছে। মূলত বিগত ৮ থেকে ১০ বছর বর্ষা মৌসুমে মশাবাহিত এই রোগের প্রকোপ বাড়লেও এবারের পরিস্থিতি যে কোনো সময়ের চেয়ে বিপজ্জনক।
Advertisement
শুক্রবার (২১ জুলাই) বিকেল ৪টায় শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের আয়োজনে ‘মহামারি’ ডেঙ্গুর হাত থেকে দেশবাসীকে বাঁচানোর দাবিতে মানববন্ধন হয়। সেখানে বক্তারা ডেঙ্গুর ভয়াবহ পরিস্থিতি তুলে ধরেন।
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট এসএমএ সবুর বলেন, স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। আমাদের সংবিধানে জনগণের স্বাস্থ্য সেবার নিশ্চয়তার বিধান সন্নিবেশিত আছে। এখন মহামারি আকারে যে ভাবে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে তাতে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের দৈন্যতা ও সিটি করপোরেশনের উদাসীনতায় দেশবাসী হতাশ ও ক্ষুব্ধ। আমরা অনতিবিলম্বে ডেঙ্গুকে মহামারি ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি। একই সঙ্গে ডেঙ্গু প্রতিরোধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া ও ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা ব্যয় সরকারিভাবে করতে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদ বলেন, দেশে সরকার আসে সরকার যায় কিন্তু জনবান্ধব সরকার এখনও পাওয়া যায়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতার অঙ্গীকার ছিল দেশে বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা ও শোষণমুক্ত স্বদেশ গড়ে তোলা। দুঃখজনক হলো স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা দেশে নিশ্চিত করা যায়নি। এখনও বৈশ্বিক মহামারি করোনার প্রভাব দেশে বিদ্যমান তার ওপর ফি বছর ডেঙ্গুর প্রভাবে যে হারে মানুষ আক্রান্ত ও মারা যাচ্ছে তার প্রতিকার কার্যকরে কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। আমরা দেশে জনবান্ধব সরকার চাই। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলসমূহের চলমান আন্দোলন দেখে আমাদের প্রশ্ন জাগে জনগণের দাবিকে উপেক্ষা করে যে আন্দোলন চলছে তাতে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়তো করা যাবে জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন করা যাবে না। কাজেই আসুন জনগণের ভাগ্য উন্নয়নের লড়াই করি। দেশে সমতাভিত্তিক শোষণ, বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত সমাজ গড়ি।
Advertisement
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগের দিন মৃত্যু হয়েছে রেকর্ড ১৯ জনের। গত ৬ মাসে মৃত্যু হয়েছে ১৫৫ জনের। এর আগে বাংলাদেশে বছরের প্রথম ৬ মাসে ডেঙ্গুতে এতো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটি বলা যায় যে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। কিন্তু সরকার কিংবা স্থানীয় সরকার কারও পদক্ষেপ কিংবা আচরণে এটি মনে হয় না। সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন মনে করছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়, ডেঙ্গু পরিস্থিতি মহামারি আকার ধারণ করেছে।
ডেঙ্গু কীভাবে বিস্তার ঘটালো সে বিষয়টি তুলে ধরে বলা হয়, এদেশে ডেঙ্গুর ইতিহাস নতুন নয়। এই ভূখণ্ডে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৬৫ সালে, তবে ডেঙ্গু নামে নয়, তখন এর নাম ছিল ‘ঢাকা ফিভার’। ২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গুর ভয়াবহতা দেখা দেয়। ঐ বছর ৫ হাজার ৫০০ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এবং ৯৩ জন মারা যান। বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সবচেয়ে ভয়াবহতা প্রকাশ পায় ২০১৯ সালে, সে সময় ১ লাখ ১ হাজার ৩০০ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল। একই বছর বাংলাদেশের সর্বত্র অর্থাৎ ৬৪ জেলায় ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটেছিল। এক সময় মনে করা হতো ডেঙ্গু একটি নগরের বা ঢাকার রোগ। বর্তমানে এই ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে, এর বিস্তার ও ব্যাপকতা এখন সারা দেশে। এক সময় বাংলাদেশে ডেঙ্গুকে একটি মৌসুমি রোগ মনে করা হলেও, গত কয়েক বছরে অভিজ্ঞতায় এই ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে, এটি এখন সারা বছরের রোগ, যে কোনো সময়ে যে কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারে।
ঘোষণাপত্রে এটাও বলা হয় যে বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এখানে নগর পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা হলো এখানে তথাকথিত বস্তুগত উন্নয়ন, আধুনিক সুদৃশ্য বহুতল ভবন, লাইটিং, দামি বিলাসবহুল গাড়ি, চাকচিক্যময় জীবন পরিলক্ষিত হলেও অবস্তুগত সংস্কৃতির বা মানসিকতার উন্নয়ন সেভাবে হয়নি।
এতে আরও বলা হয়, আমরা সকলেই জানি যে, ডেঙ্গু বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা। আমরা এটিও জানি যে সরকার এবং তার সকল স্টেকহোল্ডার এটি সম্পর্কে অবগত কিন্তু এটি অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং স্থানীয় সরকারসমূহের এটি প্রতিরোধে কোনো কার্যকর উদ্যোগ আমরা দেখতে পাই না, আগাম প্রস্তুতি তো দূরের কথা। বর্তমানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে যে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তা একটা গতানুগতিক উদ্যোগ। ডেঙ্গু মোকাবিলায় সরকারের কোনো আগাম প্রস্তুতি কিংবা পরিকল্পনা বা উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না। মশা দমনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো বড় ধরনের কিংবা কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। এ ছাড়াও মশা দমনে যেসব ঔষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে, তার কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। সরকারি হাসপাতালগুলোর ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি রোগী ভর্তি রয়েছে। আমরা শুধুমাত্র হাসপাতাল সূত্রে রোগীর তথ্য পাই। আমাদের ধারণা প্রকৃত রোগী ও মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকারসহ কেউই ডেঙ্গুর ভয়াবহতা এবং এর ফলাফলের দায় এড়াতে পারে না। আমরা দাবি জানাই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সরকার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে। সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচারের পদক্ষেপ নেবে।
Advertisement
ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন যেসব দাবি জানাচ্ছে সেগুলো হলো:
১. জনগণের অংশগ্রহণ এবং সম্পৃক্ততা ছাড়া কোনো ভাবেই মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। জনগণকে সম্পৃক্ত করে মশা নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই আইন বাস্তবায়ন করতে হবে।
২. স্থানীয় সরকারের প্রধান মেয়র অথবা চেয়ারম্যানকে প্রধান করে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর কমিটি গঠন এবং সব পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি ও জনগণের অংশগ্রহণে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা করতে হবে।
৩. ওয়ার্ড পর্যায়ে কাউন্সিলর অথবা সদস্যকে প্রধান করে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যকর কমিটি গঠন এবং জনপ্রতিনিধি ও জনগণের অংশগ্রহণে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা করতে হবে।
৪. সব হোল্ডিং নাম্বারকে ভিত্তি করে ডেঙ্গু প্রতিরোধ উদ্যোগ নিতে হবে। জনগণকে স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদানসহ ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
৫. বিনামূল্যে ওয়ার্ড পর্যায়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে ওয়ার্ড পর্যায়ে ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সংগঠনটির প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট এসএমএ সবুরের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক জোবাইদা নাসরিন কনা, সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদ, ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সামসুল আলম জুলফিকার, সাম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য জুবায়ের আলম, কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুল ওয়াহেদ, কামরানুর রশিদ তুহিন, নারী নেত্রী হেনা চৌধুরী, ছাত্রনেতা গৌতম শীল প্রমুখ। সভায় ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট পারভেজ হাসেম। সভা পরিচালনা করেন সংগঠনটির সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম সবুজ।
এফএইচ/এসএনআর/জেআইএম